নরওয়েতে বৈশাখী মেলা

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্টাভাঙ্গার শহরের মেয়র সিসেল কনউৎসেন হেগডাল

‘আইলো আইলো আইলো রে...রঙে ভরা বৈশাখ আবার আইলো রে...।’

২১ এপ্রিল মহা ধুমধামে নরওয়ের স্টাভাঙ্গার শহরের সুন্দে-কিরনেভিক কমিউনিটি সেন্টারে হয়ে গেল বাংলাদেশিদের বাংলা নতুন বর্ষবরণ ১৪৩১ অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি ছিলেন স্টাভাঙ্গার মেয়র সিসেল কনউৎসেন হেগডাল, আর সঙ্গে ছিলেন প্রায় তিন শ দেশি-বিদেশি অতিথি। স্টাভাঙ্গারের বাংলাদেশি অনুষ্ঠানে নরওয়েজিয়ান সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কোনো ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি এবারই প্রথম। মেয়রের আগমন এখানকার প্রবাসী বাঙালিদের জন্য একটি বড় প্রাপ্তি।

জমজমাট বৈশাখী মেলা, জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্টাভাঙ্গার মেয়র সিসেল বাংলাদেশিদের এ আয়োজনে অত্যন্ত সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি মেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন এবং মেলার বিভিন্ন খাবারের স্বাদ গ্রহণ করেন। তিনি আমাদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনারও খুব প্রশংসা করেন। তিনি মুগ্ধ ও অভিভূত হন আমাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে, আমাদের খাবারে, সর্বোপরি আমাদের আতিথেয়তায়।

বাংলাদেশ থেকে আনা হয়েছিল মেয়েদের জন্য একই রকম বৈশাখী শাড়ি। বৈশাখী সাজে একই রকম শাড়িতে সব মেয়েকে লাগছিল অসাধারণ সুন্দর। স্টাভাঙ্গারবাসীদের সঙ্গে যোগ দিতে মান্দাল, বার্গেন শহর থেকেও বাংলাদেশিরা জড়ো হয়েছিলেন সেদিন। অতিথি হয়ে এসেছিলেন স্থানীয় নরওয়েজিয়ানসহ এখানে বসবাসরত বিভিন্ন দেশের লোকজন। সবাই মিলে মেতে উঠেছিলেন প্রাণের উৎসবে।

বাংলাদেশী সাজে বিদেশীরা মেতে উঠেছিলেন বৈশাখী আমেজে

এটাই এখানে অনুষ্ঠিত প্রথমবারের মতো বৈশাখী মেলা। ঝালমুড়ি, আমমাখা, পিঠাপুলি, কেক, মিষ্টি, ভর্তা, চটপটি, ফুচকা, বিরিয়ানি, বোরহানি, পায়েস, লাচ্ছি আরও হরেক রকম খাবারের পসরা। শাড়ি, চুড়ি থেকে শুরু করে ছিল পেইন্টিংয়ের স্টল। বাদ যায়নি শিশুদের খেলনা ও মেলার ভটভটি গাড়ি, যেমনটি পাওয়া যায় বাংলাদেশের মেলায়। মেলার দোকানগুলোর নামও ছিল সেই রকম—মিঠাই, আহা!...র, লে হালুয়া !, হযবরল, ঝালমুড়ি, বৈশাখী বাজার, ঢাকাইয়া নবাবি, চটপটি নাকি ফুচকা? ইয়ানতুন খাইযান, আল্পনা, ওয়ার্ল্ড অব আর্টিস্ট্রি, নর-বান-মাত। স্টলগুলোর দায়িত্বে ছিলেন অমিত ও সুপ্রিয়া, নায়লা, তন্ময় ও সৌম্য, তানভীর ও ইলোরা, পায়েল, দীপঙ্কর ও সুবল, তিন্নি ও সামিউল, টিনা ও রাব্বানী, নিশি ও নাঈম, কান্তা ও ডা. তানভীর, পূজা, অপর্ণা ও অভি, শামীম আহসান। বার্গেন শহরের বাংলা দোকান নর-বান-মাত-এর সদাইপাতি নিয়ে এসেছিলেন শামীম আহসান।

পুরোই যেন বাংলাদেশ, পুরোই যেন বাংলাদেশের বৈশাখী মেলা। দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে এমন মেলায় এসে বাঙালিরা মেতে ওঠেন প্রাণের উল্লাসে, পেতে চান দেশের একটু ছোঁয়া। বিদেশিদের অংশগ্রহণও ছিল চোখে পড়ার মতোই। বাঙালি পোশাক শাড়ি-চুড়ি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে, আর ভর্তা থেকে শুরু করে সব ধরনের খাবারের স্বাদ নিয়ে এক দিনের জন্য যেন হতে চেয়েছিলেন বাঙালি।

নৃত্য নাট্য নতুন বিয়ের ফুল

এবার আসি সাংস্কৃতিক আয়োজনের কথায়। একেবারে ভিন্নমাত্রার একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। গান, নাচ, কোরাস, নৃত্যনাট্য, বাঁশি, কবিতা, পিয়ানো, নাটক—একটার পর একটা চমক। তানজিনা আর হুমায়ূনের উপস্থাপনায় সাংস্কৃতিক আয়োজনের বিভিন্ন পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করেন নায়লা, হাবিব, ইনু, পায়েল, তানজিনা, সুপ্রিয়া, কান্তা, দীপঙ্কর, সুবল, অভি, সৌম্য, তানভীর, অপর্ণা, জুবায়ের, দেওয়ান, ফারহানা, পূজা, মুহিদুল, সুমাইতা, অরোরা, হৈমন্তি, রূপেশ, রহিম, কর্নিকা ও অমৃতা।

অনুষ্ঠানে মেয়েদের একাংশ

বাংলাদেশের গ্রামীণ বিয়ের চিত্র নিয়ে করা নৃত্যনাট্য ‘নতুন বিয়ের ফুল’ ছিল স্টাভাঙ্গার মেয়রের উপস্থিতিতে উদ্বোধনী পরিবেশনা। নায়লা জাহানের কনসেপ্ট, মিউজিক মিক্স এবং কোরিওগ্রাফি আর সবার সাবলীল অভিনয়ে গ্রামীণ বিয়ের পাত্র-পাত্রী দেখা, গায়েহলুদ, মেহেদি, বিয়ে—সবকিছু অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। এককথায় অসাধারণ! আহমেদ তন্ময়ের লেখা আর পরিচালনায় নাটক ‘বোকার স্বর্গ’ দেখে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাওয়ার পালা। বোকার স্বর্গে বাস করা এক রাজার রাজ্যের করুণ পরিণতি! সবশেষে ধামাকা বাংলা ম্যাশআপ ডান্স। নতুন প্রজন্মের ম্যাশআপ গান এবং নাচের মিশ্রণে একটি নতুন ও আধুনিক সংযোজন, যা দর্শক-শ্রোতাদের একেবারে মাতিয়ে রাখে। ম্যাশআপ ড্যান্সের কোরিওগ্রাফি করেছেন সুমাইতা শামস ও নায়লা জাহান।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর খাওয়ার পর্ব। বৈশাখী আমেজ ছিল খাওয়াতেও; সাদা ভাত, শর্ষে ইলিশ, আলুভর্তা, ডালভর্তা, ডিম, চিকেন কারি সঙ্গে শুকনা মরিচ ভাজা। যথারীতি ছিল রাফেল ড্র আর শিশুদের জন্য উপহার।

অনুষ্ঠানে ছেলেদের একাংশ

এ রকম সুন্দর আর সফল অনুষ্ঠান আয়োজন করা সহজ কথা নয়। বাংলাদেশ সোসাইটি অব রোগাল্যান্ডের (বিএসআর) উদ্যোগে এখানে বসবাসকারী সব বাংলাদেশিকে নিয়ে এ রকম সুন্দর আর সফল অনুষ্ঠান আয়োজন সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। ধন্যবাদ সবাইকে, যাঁরা এই আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ধন্যবাদ সবাইকে, যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর অবিরাম ভালোবাসা ছিল আয়োজনের পরতে পরতে। অনুষ্ঠানের সামগ্রিক তত্ত্বাবধানের জন্য বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাতে হয় গোলাম রাব্বানী, দীপঙ্কর চৌধুরী, নাসরীন বানু টিনা আর ঋতুপর্ণা পাল পায়েলকে।

লেখক: নাসরীন বানু টিনা, স্টাভাঙ্গার, নরওয়ে

**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]