তিউনিসিয়া পারলে আমরা পারি না কেন?

পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম যা-ই বলুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তিউনিসিয়ার মানুষ গণতন্ত্রপন্থী এবং সাইয়েদের শাসনবিরোধী। এ কারণে আরব বসন্ত প্রায় নিশ্চিতভাবে ‘মরেনি’ছবি : রয়টার্স

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। আমেরিকার টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটির সঙ্গে তিউনিসিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টিউনিস—এল মানারের এক যৌথ গবেষণা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এ সুযোগে দুই সপ্তাহের জন্য আমাকে যেতে হয়েছিল তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসে। সুদূর উত্তর আফ্রিকায় ভূমধ্যসাগরের পাড়ে, লিবিয়া আর আল–জেরিয়ার মাঝখানে এক কোটি লোকের ছোট্ট দেশ তিউনিসিয়া। সে দেশের একটি বড় অংশ সাহারা মরুভূমি এমনিতে গ্রাস করে ফেলেছে। তার ওপর মরুভূমির বালুর চাদর আগ্রাসী আক্রোশে ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে তিউনিসিয়ার অবশিষ্ট সবুজ জমিনের দিকে। এই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েও তিউনিসিয়ার সংগ্রামী মানুষ টিকে আছে যুগ যুগ ধরে। তথাপি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া জেসমিন বিপ্লবের আগে, বাংলাদেশের অনেক লোক এ দেশটির নামও জানত না। সুন্দর এই দেশটির কথা আমি প্রথম শুনেছি মাত্র ১৯৭০ সালে যখন তৎকালীন জর্ডানের বাদশাহ হোসেন বিন তালাল পিএলও এবং ইয়াসির আরাফাতকে তার দলবলসহ জর্ডান থেকে বের করে দেন তখন। ওই সময় তিউনিসিয়া সরকার ইয়াসির আরাফাত ও তার অস্থায়ী ভ্রাম্যমাণ সরকারকে আশ্রয় দিয়ে মুসলিম বিশ্বের সুনাম অর্জন করেছিল।

ন্যাশভিল থেকে শিকাগো এবং প্যারিস হয়ে আমি যখন তিউনিস গিয়ে পৌঁছালাম, তখন দুপুর গড়িয়ে সূর্য পশ্চিম আকাশে মাত্র একটুখানি হেলেছে। কাস্টমস এবং ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে আধা ঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে এলাম। দূর থেকে দেখতে পেলাম, অ্যারাইভ্যাল এরিয়াতে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন পেশাগত বন্ধু ও তিউনিসে আমার হোস্ট শিহেব বোডউইন। টার্মিন্যাল থেকে নেমেই অনুভব করলাম ভরদুপুরে মরুভূমি দেশের লু হাওয়ার উত্তাপ। গাড়িতে ওঠার পরই শিহেব বললেন, ‘সন্ধ্যা নামতে এখনো অনেক দেরি, যদি তোমার আপত্তি না থাকে তাহলে চল হোটেলে যাওয়ার আগে তোমাকে এক চক্কর তিউনিস শহর ঘুরে দেখিয়ে নিয়ে যাই।’ আমি তার প্রস্তাবে সহজেই রাজি হয়ে গেলাম। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে শহরে যাওয়ার পথটা খুবই সুন্দর। সাজানো–গোছানো পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে তকতকে। দুর্দিকে রাস্তা, মাঝখানে সবুজ আইল্যান্ড। হরেক রকমের রঙিন ফুল আর নানা জাতের বাহারি গাছ-গাছালি দিয়ে খুব রুচিসম্মতভাবে সাজানো।

শিহেব গাড়ি চালাচ্ছেন। শহর ঘুরেফিরে দেখাচ্ছেন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি তাঁর কমেন্টারি-মনোলগ। এর মধ্যে একসময় সাগরতীরেও নিয়ে গেলেন। ভূমধ্যসাগরের দিকে চোখ তুলে বললেন, তিউনিসিয়ার সমুদ্রসৈকতের সঙ্গে ইতালির সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের ন্যূনতম দূরত্ব মাত্র ৩০–৩৫ মাইল। দুঃসাহসী তিউনিসিয়ানরা সাধারণ নৌকো চড়ে ওই পথে ইতালি চলে যায়। তার আগে এক জায়গায় নিয়ে তিনি আমাকে একটি তিন-চারতলা বড় ভবন দেখিয়ে বললেন, ‘১৯৭০ সালে যখন পিএলওর বহর নিয়ে চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত এদেশে এসে আশ্রয় নেন, এটাই ছিল তাঁর হেডকোয়ার্টার। কথা প্রসঙ্গে একসময় তিনি গৌরবের সঙ্গে বললেন তারা মহান মনীষী ইবনে খালদুনের উত্তরসূরি। এর আগে আমি জানতাম না, ইবনে খালদুনের মতো মহান পুরুষের জন্ম হয়েছিল ছোট্ট এই মরুভূমির দেশে। ওইবার তিউনিস থেকে ফিরে এসে ইবনে খালদুনের ওপর আমার বিশেষ আগ্রহ সৃষ্টি হয়। কিছু লেখাপড়া করি তার ওপর। এখনো পড়ছি। ইবনে খালদুন বোঝার চেষ্টা করছি। যতই পড়ছি, ততই বুঝতে পারছি ইবনে খালদুন কত বড় মাপের ইতিহাসবিদ এবং কত বড় সমাজতাত্ত্বিক ছিলেন।

শিহেবের সঙ্গে গাড়িতে করে তিউনিস ঘুরতে ঘুরতে দেশটি সম্পর্কে আমার মধ্যে একটা দারুণ ইতিবাচক ধারণা জন্মাল। যদিও আমি অর্থনীতির ছাত্র, তবু আমার জানা ছিল না আফ্রিকার কোনো দেশ এত সুন্দর, এত উন্নত হতে পারে। বন্ধু শিহেবকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমরা এত অল্প সময়ে এত এগিয়ে গেলে কেমন করে? শিহেব জানালেন, ‘সম্ভবত দুই কারণে, প্রথমত, গত দুই যুগ ধরে আমাদের সরকার উন্নয়ন পরিকল্পনায় শিক্ষা এবং মানব সম্পদের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের জিওগ্রাফিক প্রোক্সিমিটি টু ইউরোপও একটি ফ্যাক্টার।’ অর্থাৎ ইউরোপের সঙ্গে তিউনিসিয়ার ভৌগলিক নৈকট্য উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় তাদের কিছুটা হলেও বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরও বললেন, সকালবেলা উড়োজাহাজে করে তারা দুপুরে প্যারিস পৌঁছে যান। কাজ সেরে রাতে ফিরেও আসতে পারেন। ইউরোপের সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তাদের জনগণের মধ্যে একটি আস্থা এবং প্রতীতির জন্ম দিয়েছে, ‘ইউরোপ যদি পারে তো এত কাছে থেকে আমরা পারব না কেন?’

নির্বাচনে জয়ের পর রাজধানী তিউনিসে সমর্থকদের সঙ্গে বিজয় উদ্‌যাপন করছেন প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদ
ছবি: এএফপি

বুঝতে আমার অসুবিধে হলো না, শিহেব আমাকে যে পথে নিয়ে ঘুরছেন, সেটা ‘নিউ তিউনিস’ অর্থাৎ তিউনিসের অপেক্ষাকৃত সচ্ছল এবং নতুন অঞ্চল। নিশ্চয়ই তিউনিসেও ময়লা, দুর্গন্ধ, ঘিঞ্জিময় পুরোনো এলাকাও আছে, আছে বক্তিতুল্য গরিবদের থাকার জায়গাও। বোধগম্য কারণেই প্রথম দিন তিনি আমাকে সে পথে নিয়ে যাচ্ছেন না।

ঘোরাঘুরি করে যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, তখন শিহেব এক দোকান থেকে আমাকে কিছু বোতলের পানি, মিষ্টি ফল, আর শুকনা খাবার কিনে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, ‘তুমি একটুক্ষণ রেস্ট নিয়ে শাওয়ার সেরে ইচ্ছে করলে এখানেই এসব রেস্টুরেন্টে এসে ডিনার খেতে পার। আমি শাওয়ার নিলাম ঠিকই, কিন্তু বেরোতে ইচ্ছা হলো না। সফর ক্লান্তিতে চোখ দুটো বুজে আসছিল। একটি কলা, কয়েক টুকরা বিস্কুট এবং তিন চার ঢোক বোতলের পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সাধারণত বিছানা বদলে আমার ঘুমের সমস্যা হয়। কিন্তু সে রাতে তেমন কোনো অসুবিধে হলো না। অতিরিক্ত ক্লান্তির কারণে একঘুমে ভোরবেলা উঠলাম। সকালে বেজমেন্টে নাশতা খেয়ে হোটেলের সামনে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ভাবলাম, উত্তর আফ্রিকায় প্রথম এসেছি দেশটি কেমন, তার মানুষজন কেমন, একটু দেখি। হোটেলটি যে সড়কের ওপর সেটা অনেকটা ঢাকার মিরপুর রোডের মতো। চওড়া রাস্তা। যান চলাচলেও বেশ ব্যস্ত।

তিউনিসিয়ায় একটা বিষয় নজর কাড়ল। রাস্তায় রিকশাজাতীয় কোনো যানবাহন নেই। সব গাড়ি। খেয়াল করে দেখে অবাক এবং অভিভূত না হয়ে পারলাম না, গুনে দেখলাম ১০টির মধ্যে ৬টি গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে একজন নারী।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকালাম। কয়েকটি জিনিস চোখে ধরা পড়ল। প্রথমত, ছোটবড় বাড়ি, বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং সর্বত্র বিল্ডিংয়ের ছাদে, ঘরের দেওয়ালে টিভির ডিশ অ্যানটেনা। বুঝলাম, সবাই স্যাটেলাইট টিভি দেখে। উঁচু উঁচু ভবনের ছাদে, বারান্দায় ও বেলকনিতে লোকজন রং–বেরঙের ভেজা কাপড় মেলে দিয়েছেন। বুঝলাম, এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি মিল আছে। আরেকটা বিষয় আমার নজর কাড়ল। সেটা হলো রাস্তায় রিকশা বা এই জাতীয় কোনো প্রোমুভিং যানবাহন নেই। সবাই গাড়িতে চলছে। আরও ভালো করে খেয়াল করে যা দেখলাম, তাতে অবাক এবং অভিভূত না হয়ে পারলাম না। গুনে দেখলাম প্রতি ১০টি গাড়ির মধ্যে ৬টির স্টিয়ারিং হুইল ধরে যিনি বসে আছেন, তিনি একজন নারী। অর্থাৎ তিউনিসিয়ার নারী সমাজ খুব অগ্রসরমান। তারা রান্নাঘরের চার দেওয়ালে আবদ্ধ নয়। ঘরের বাইরেও তাদের আরেকটি জগৎ আছে। সেখানে তারা নিরাপদে স্বাচ্ছন্দ্য নিজে নিজে কাজ করেন। তারা বেশ ফরওয়ার্ড লুকিং। আউট গোয়িং প্রকৃতির। চেহারা সুরতে, চলনে বলনে এবং বেশ ভূষায় তিউনিসীয় রমনীগণ একেবারে ইউরোপীয়দের মতো। আধুনিক ভাষায় যাকে বলে স্মার্ট।

কতক্ষণ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকার পর হোটেলের উল্টোদিকে কিছুদূর হাঁটলাম। ওদিকে দেখলাম বিশাল আবাসিক এলাকা। সবই বড় ও মাঝারি সাইজের পাকা দালানবাড়ি। সব কটি বাড়িই দেওয়ালঘেরা। ভেতরে বাড়ির সামনে আছে সুন্দর সুন্দর ফুলের বাগান। দেখে মনে পড়ল ঘাটের দশকের ধানমন্ডির কথা। ওই সময় ঢাকার ধানমন্ডি এ রকমই সুন্দর ছিল। একেবারে ছবির মতো। আবাসিক এলাকায় লোক চলাচল তেমন নেই। নেই ফেরিওয়ালাদের হাঁকডাক ও ফকির মিসকিনদের আহাজারি। মাঝেমধ্যে দেখলাম– বাড়ির সামনে বাগানে লোকজন ফুলগাছের পরিচর্যা করছেন। দু–তিন রাস্তা পর পর ইন্টারসেকশনের কোণায় ছোট ছোট দোকান। এ সব দোকানে চাল, ডাল, ডিম, রুটি, তেল, পানি, তরি-তরকারি, ফলমূল, কুকি-বিস্কুট, চকলেট, ললিপপ ইত্যাদি পাওয়া যায়। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারলাম, রোদের তেজ বাড়ছে। আর বেশি সময় বাইরে থাকা যাবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই হোটেলে ফিরলাম।

দুপুরের দিকে শিহেব এলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে গেলেন। একটি ক্লাসে গেলাম। ছাত্র–ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বললাম। তাদের সঙ্গে পরিচিত হলাম। তাদের কতাবার্তার ধরন-ধারণ চিন্তা–ভাবনার কথা জেনে অবাক হলাম। তারা খুব চটপটে, আধুনিক। আমেরিকার প্রতি তাদের কৌতূহলের সীমা নেই। তবে তারা একেবারেই অন্ধ মার্কিন অনুসারি নয়। কথাবার্তায় পরিশীলিত। কাপড়েচোপড়ে ভদ্র ও শালীন। তারা চারটি ভাষায় কথা বলতে জানে। আরবি, ফার্সি, ইংরেজি, এবং এই তিন ভাষার মিশ্রণে চতুর্থ আরেকটি ভাষা, যার কোনো নাম নেই। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজে চারটি নয়, তিনটি নয়, মাত্র দুটি ভাষা শেখানো হয়, তা–ও কতিপয় শহুরে স্কুল ছাড়া আমাদের শিক্ষার্থীরা ইংরেজি তো জানেই না, বাংলাটাও ঠিকমতো রপ্ত করতে পারে না। এই না পারার দলে আমিও একজন। এই বুড়া বয়সে আমার মাতৃভাষা আমি এখনো শিখছি। সব মিলে উত্তর আফ্রিকার একটি ছোট্ট দেশ তিউনিসিয়ার সঙ্গে আমার জন্মভূমি বাংলাদেশের তুলনা করে হতাশ হলাম। মনে বড় কষ্ট পেলাম। ভাবলাম, আমার সোনার বাংলাদেশ কখন এমন হবে?

লেখক: অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; ম্যানেজিং এডিটর - জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ

  • ‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]