পাশের বাড়ির মেয়ে তাসনিয়া ফারিণ

তাসনিয়া ফারিণপ্রথম আলো ফাইল ছবি

দেশ ছেড়েছিলাম ২০১৫ সালের মার্চ মাসে। এর আগ পর্যন্ত ঢালিউড, টালিউড, বলিউড থেকে শুরু করে হলিউডের প্রায় সব খবরই রাখতাম এবং মুক্তিপ্রাপ্ত নাটক ও ছবিগুলো দেখতাম। আমি বরাবরই অ্যানিমেশন ছবির ভক্ত, তাই বাদ পড়ত না জাপানিজ অ্যানিমেশন ছবিগুলোও। এমনকি আমার একটা বন্ধুমহল আছে, যাদের বয়স আমার চেয়ে অনেক কম। সহজ করে বললে, ওরা সবাই জেন-জির সদস্য। ওরা কীভাবে কীভাবে যেন বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে সব ছবি নামিয়ে ফেলে। আমি সপ্তাহান্তে ওদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমার ভ্রাম্যমাণ হার্ডডিস্কে সেগুলো নিয়ে নিতাম; আর প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমি আর আমার তিন বছরের মেয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে সেগুলো দেখতাম; কিন্তু যখন সপরিবার প্রবাসী হয়ে গেলাম, তখন ওদের মুখে দুবেলা দুমুঠো খাবার তুলে দিতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে শুরু করলাম। ফলে মাথা থেকে নাটক ও ছবি দেখার ভূত নেমে গেল। একটু–আধটু উড়ো উড়ো খবর শুনতাম যে দেশের এই শিল্পমাধ্যম একেবারে গোল্লায় গেছে।  

সময়ের সঙ্গে একসময় জীবনেও স্থিতাবস্থা এল। তখন আবার সেই নাটক ও ছবি দেখার ভূত মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। নেটফ্লিক্স নামের অ্যাপের মাধ্যমে ছবিগুলো দেখা হচ্ছিল। আর নাটকের জন্য এখনো নির্ভর করি ইউটিউবের ওপরে। আমি যেকোনো নাটক বা ছবি দেখার আগে বিভিন্ন পত্রিকার অনলাইন ভার্সন থেকে সেগুলোর রিভিউ পড়ি। একদিন পত্রিকার পাতায় কাছের মানুষ দূরে থুইয়া ছবিটার রিভিউ পড়ে খুবই ভালো লেগে গেল; কিন্তু আমার চরকি অ্যাপের সাবস্ক্রিপশন না থাকায় দেখতে পারছিলাম না। হঠাৎ একদিন একটা ইউটিউব চ্যানেলে সেটিকে পেয়ে অফিসের কাজ ফাঁকি দিয়ে দুপুরের খাবারের বিরতিতে সেটি দেখে ফেললাম। সেই প্রথম তাসনিয়া ফারিণের কোনো কাজ দেখলাম। ওনার অভিনয় এতই ভালো লেগে গেল যে এরপর ইউটিউবে খুঁজে খুঁজে তাঁর অভিনীত নাটক দেখা শুরু করলাম।

প্রবাসজীবনেও আমাদের বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ বাংলাদেশের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’। আমি এখনো অবসর পেলেই ইউটিউবে খুঁজে ইত্যাদির পুরোনো পর্বগুলো দেখি; আর ঈদের ইত্যাদি ছাড়া প্রবাসের ঈদ যেন পূর্ণতা পায় না। বাংলাদেশে যখন সেটির প্রচার শুরু হয়, তখন অস্ট্রেলিয়ায় গভীর রাত। তবুও আমি জেগে থাকি এটা দেখার জন্য। তেমনই গত রোজার ঈদের ইত্যাদি দেখতে গিয়ে তাসনিয়া ফারিণের দ্বৈত সংগীত শুনলাম আমার আরেক প্রিয় শিল্পী তাহসানের সঙ্গে। গানটা এরপর থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের বাসায় বেজে চলেছে। তাহসানকে আমি সংগীতশিল্পী হিসেবেই চিনতাম। তিনি অভিনীত যে প্রথম নাটক দেখেছিলাম, সেটি ছিল অফবিট। অনেক দিন নাটক থেকে দূরে থাকায় জানতাম না যে এখনকার প্রজন্মের কাছে তাহসান গায়কের চেয়ে অভিনেতা হিসেবেই বেশি পরিচিত। এরপর আবারও ইউটিউবে খুঁজে দুজনের বেশকিছু নাটক দেখে ফেললাম। তার মধ্যে কমলা রঙের রোদ, মেড ফর ইচ আদার খুবই ভালো লাগল। নিজের গিন্নি চিকিৎসক হওয়ায় কমলা রঙের রোদ নাটকে তাসনিয়া ফারিণের অভিনয় যেন বেশিই ভালো লাগল।  

এরপর দেখলাম কারাগার ওয়েব সিরিজ। সেখানে আবিষ্কার করলাম অন্য এক তাসনিয়া ফারিণকে। অভিব্যক্তি দিয়ে চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে এতটাই মানিয়ে নিয়েছিলেন যে মনেই হতো না অভিনয় করছেন। এরপর একদিন খবর পড়লাম, তাঁর নতুন নাটক আনারকলিতে নাচে–গানে দর্শককে মাতাতে আসছেন। সেই নাটকের গান লোকাল বয় দেখা হলো বহুবার। তারপর নাটকটি দেখলাম। যাত্রাপালা একসময় গ্রামবাংলার মানুষের অন্যতম বিনোদনের বিষয় ছিল। এই নাটকে তাঁর অভিনয় দেখে মুগ্ধতা যেন আরও বেড়ে গেল। এরপর অভিনেতা তাওসিফের সঙ্গে অভিনীত আরও দেখা হলো স্মৃতিস্মারক, রূপকথা নয়, চাওয়া থেকে পাওয়া, মন দুয়ারে, বাটপার কোম্পানি। রূপকথা নয় এবং চাওয়া থেকে পাওয়া নাটক দুটিতে ফারিণের অভিনয় খুবই ভালো লাগল, বিশেষ করে দ্বিতীয় নাটকটি দেখে আবেগাক্রান্ত হয়ে গেলাম যেন।

এভাবে ফারিণের নাটক দেখতে দেখতে নতুন প্রজন্মের অনেক অভিনেতার সঙ্গে পরিচয় হলো। জোভানকে দেখেছিলাম শিশুশিল্পী হিসেবে। সেই জোভান এখন নাটকের পরিচিত নায়ক। জোভানের সঙ্গে ফারিণের অভিনয় আমার খুবই ভালো লাগল। এরপর ইউটিউব খুঁজে এই জুটির নাটক দেখা শুরু করলাম। রোমিও জুলিয়েট, লাভ এক্সপ্রেস, লাভ ইউ হেট ইউ, লাভ নট রিভেঞ্জ, ফেক প্রেম, ক্লাসমেট, জানেমান তুই আমার, তোমার পিছু ছাড়ব না, উলটা ফুলটা, টুইন ট্রাবল, সুইচ, আমি গাধা বলছি এমন অনেক নাটক দেখে ফেললাম। আমাদের বাসায় আমি রেগে গেলে বাচ্চা দুটিকে গাধার বাচ্চা বলে বকা দেয়, তাই ওরা আমি গাধা বলছি নাটক দেখে খুবই আনন্দ পেল। আর টুইন ট্রাবল নাটক দেখে বুঝলাম যে ফারিণ প্রেমিকার চরিত্রে যতটা চমৎকার অভিনয় করেন, ঠিক ততটাই বোনের চরিত্রেও শক্তিশালী। আর সুইচ নাটকে মেয়ের শরীরে আশ্রয় নেওয়া ছেলের চরিত্রটা ছিল এক কথায় দুর্দান্ত।

সেরা নবাগতা অভিনেত্রীর পুরস্কার হাতে তাসনিয়া ফারিণ
ছবি ফেসবুক থেকে নেওয়া

এরপর খবর পড়লাম ফারিণ অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র ফাতিমা মুক্তি পাচ্ছে। এটা জানার সঙ্গে সঙ্গে যাঁরা অস্ট্রেলিয়ায় বাংলা চলচ্চিত্র প্রচার করেন, তাঁদের খুদে বার্তা দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ছবিটা আনবেন কি না। তাঁরা এখনো জানাননি আনবেন কি না। গত সপ্তাহে আমার বোনের বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়েছিলাম। তখন আপু বলল, ইয়াকুব ফাতিমা ছবিটা এলে আমাকে খবর দিস। তখন বুঝলাম, আমার মতো উনিও ফারিণের অভিনয়ের ভক্ত। মাস খানেক আগে মুক্তি পেয়েছে তরুণ প্রজন্মের আরেক অভিনয় শিল্পী খায়রুল বাসারের সঙ্গে অভিনীত নাটক পরস্পর। এটাতে আরেক ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় খুবই ভালো লেগেছে। আমার মনে আছে আমি ফারিণ অভিনীত প্রথম নাটক এক্স বয়ফ্রেন্ড দেখেছিলাম। তখনই মনে হয়েছিল, নতুন এক অভিনেত্রী আসছেন রাজত্ব করতে। সেটা এখন সর্বজনবিদিত। অভিনয়, নাচে, গানে ফারিণ এখন শোবিজ জগতের সবচেয়ে আলোচিত নাম।

ফারিণের অভিনয়ক্ষমতা আমাকে মুগ্ধ করে। যে চরিত্রই করুক না কেন অত্যন্ত দরদ দিয়ে অভিনয় করেন, তাই দর্শক দ্রুতই তাঁকে গ্রহণ করেন। সামান্য সাত বছরের অভিনয় জীবনে এত বেশি নাটক ও চরিত্রে অভিনয় করেছেন যে এখন তাসনিয়া ফারিণ বাংলা নাটকের সমার্থক নাম। তাঁর অভিনয় দেখলে চরিত্রের পাশাপাশি ফারিণকেও খুব পরিচিত, খুবই আপন কেউ বলে মনে হয়। আমি নিশ্চিত বেশির ভাগ দর্শকের মতামতও একই রকম। তাঁর একটা নাটকের নাম পাশের বাসার মেয়ে। সেটা দেখার আগে থেকেই আমি ওনাকে পাশের বাড়ির মেয়ে বলে অভিহিত করেছিলাম, যিনি পাড়ার সবারই পরিচিত মুখ। পাশের বাড়ির মেয়ে তাসনিয়া ফারিণের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক। তাঁর অভিনয় প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বময়। পরিশেষে তাঁর কাছ থেকে আরও অনেক চমৎকার কাজ পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করছি।

*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]