টেল অব তাওয়াইফ-জলসা

খুব ছোট্টবেলায় আমার গুরুজি কানন সাহেবের বাড়িতে গানের ঘরের দেয়ালে টাঙানো বেগম আখতারের বিরাট ছবিটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। ভাবতাম গুরুজি এ ছবিতে কেন রোজ ফুল দেন, তখন একদিন আমার কৌতূহল বুঝতে পেরে গুরুমা আমাকে বেগম আখতারের গল্প শোনালেন।

আখতারি বাইয়ের গানের কথা, গলার তেজের কথা বলার পর গুরুমা গল্প করলেন যে ১২ বছর বয়সে আখতারি এক জায়গায় গান গাইতে গিয়েছিলেন, সেখানে আখতারি বাইকে একজন বদমাশ বুড়ো রাজা খুব বিরক্ত করেছিল। তারপর আখতারির এক মেয়ে হয়। গল্প অর্ধেক শেষ হওয়ার পর ‘গানবাজনার জগৎ মোটেই সুবিধার নয়’ বলে গুরুমা উঠে গেলেন।

আমার তখন বোধ হয় ১৩ বছর বয়স। দিন কাটে পড়ার বই, ভূতের গল্পের বই আর সাত ঘণ্টা রেওয়াজ করে। গান গেয়ে সারা পৃথিবী ঘুরব, এ স্বপ্ন চোখে নিয়ে ঘুম আসে না। গুরুমা যতবার স্টেজে বসেন, ওনার গান শুনে আর ব্যক্তিত্ব দেখে নিজেকে ওই জায়গায় কল্পনা করতে গিয়ে গুরুমার আলমারি থেকে ভারী ভারী শাড়ি নিয়ে যেমন–তেমন করে পরে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াই।

প্রখ্যাত ভায়োলিন বাদক শ্রী ভি জি যোগ আদর করে আমাকে ছোট মালবিকা ডাকেন, প্রায়ই বাড়িতে পৃথিবী বিখ্যাত আল্লারাখা খান সাহেব বা ভীম সেন জোশিজি আসেন, থাকেন, আমার সঙ্গে এক টেবিলে বসে খান, কত স্নেহ করেন, এ পরিবেশে বড় হয়ে গানবাজনার জগতে অসুবিধাটা যে ঠিক কী, সেটা বোঝার বুদ্ধি হয়নি, ধর্ষণ কাকে বলে তা–ও বুঝি না।

তাই বুড়ো রাজা বিরক্ত করার সঙ্গে আখতারির একটা মেয়ে হওয়ার সম্মন্ধ কী হতে পারে, সেটাও ওই দিন মাথায় আসেনি। পরে আর একটু বড় হওয়ার পর যেদিন সব বুঝলাম, সেই দিন আখতারি বাইয়ের জীবনের যন্ত্রণাগুলোর কথা মনে করে আর আমার চোখের জল থামে না। জানলাম, এই সব অসামান্য রূপসী, গুণবতী শিল্পীকে বলা হয় বাইজি বা তাওয়াইফ। জানতে পারলাম ওনারা অত্যন্ত মেধাবী বা সুন্দরী হলেও স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার হতো না, কী অদ্ভুত!

এ প্রতিভাময়ীদের নিয়ে ভাবনাচিন্তার সেই শুরু! তারপর নানা কাজে নানা দেশ–বিদেশ ঘুরতে গিয়ে অনেক বছর আর তাওয়াইফ বা বাইজিদের গান বা কাজ নিয়ে তেমন কিছু ভাবার অবকাশ হয়নি। বছর পাঁচেক হলো আবার এ নিয়ে পড়াশোনা, কাজকর্ম শুরু করেছি। যতই পড়ছি আর জানছি, ততই চোখের সামনে আর একটা অন্য জগৎ ভীষণ স্পষ্ট হচ্ছে।

শুধু কোটি টাকা রোজগার করে, দেশ–বিদেশ নিজের যোগ্যতায় ঘুরে খেয়াল, ঠুমরি, দাদরা বা গজল গেয়েই এ অসাধারণ নারীরা ক্ষান্ত হননি, কেউ তীর্থস্থানে ভক্তদের জন্য থাকার জায়গা বানিয়ে দিয়েছেন, কেউ পতিতালয়ে ছোট ছেলেমেদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন আবার কেউবা এক অকর্মার ঢেঁকিকে পাগলের মতো ভালোবেসে আর বিশ্বাস করে নিজের সব উপার্জন খুইয়ে জীবনের শেষ দিনগুলোতে নোংরা গোয়ালঘরে গিয়ে মাথা গুঁজেছেন।

যে সময় গওহর জান পোষা বিড়ালের বিয়ে দিতে দুই হাজার টাকা খরচ করতেন, ছয় ঘোড়ার গাড়িতে কলকাতার রাস্তায় ঘুরতে গিয়ে প্রতিদিন ব্রিটিশ সরকারকে হেসে হেসে হাজার টাকা ট্যাক্স দিতেন বা যে সময় ইন্দুবালা একটা হাতির দাঁতের পুতুল কিনতে পাঁচ শ টাকা অনায়াসে দাম দিতেন, সেই সময় কলকাতায় একজন ভালো চাকরি পুরুষের মাইনেও অনেক সময় মাস গেলে চার শ টাকার বেশি ছিল না! এতেই বোঝা যায় যে আমরা যাদের ‘তাওয়াইফ’ বা বাইজি বলি, তারা কোনো দিক থেকেই অবলা ছিলেন না। বরং অনেক দিক থেকে অনেক নামি পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি স্বনির্ভর ছিলেন এই নারীরা। এমনকি কত সময় রাজা জমিদারেরা এসব তাওয়াইফদের কাছ থেকে টাকা ধার নিতেন।

এক আসরে ওস্তাদ ফাইয়াজ খানের সঙ্গে সমানতালে খেয়াল গেয়ে টক্কর দিয়ে আসর মাত করেছেন গওহর জান, লোকজন খান সাহেবের চেয়ে গওহরের গানেরই বেশি প্রশংসা করেছে, এমন ঘটনাও কিছু কম নেই। ইন্দুবালার সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের মধুর সম্পর্কের কথাও তো কী রোমাঞ্চকর! কত গল্প-আনন্দের, সাফল্যের, বেদনার, হতাশার! এ রকম নানা ঘটনা, প্রচুর তথ্য দিয়ে আমাকে সাহায্য করছেন কলকাতা থেকে শ্রী রন্তিদেব মৈত্র। রন্তিদার সাহায্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না, কাজ করতে গিয়ে ধমকধামকও যে খাচ্ছি না, তা নয়, তবে সেসব গায়ে মাখলে কি আর চলে!

এই গল্পগুলো গুছিয়ে নিয়ে, নাটকের মতো করে লিখে গত বছর থেকে আমার সংগঠন কলাকার আর্টস পরিবেশন করছে লাইভ মিউজিক্যাল। শুধু গল্প বলাই নয়, এই অসামান্য নারীদের জীবনকে গান, নাচ, কবিতার মধ্য দিয়ে দর্শকদের কাছে তুলে ধরা। এ বছর শুরুর দিকে বেগম আখতারের জীবনকে নিয়ে যুক্তরাজ্যের বেশ কয়েকটা শহরে মিউজিক্যাল প্রোগ্রাম হয়েছে, ২০২৩–এ আরও বড় আকারে অনুষ্ঠান নিয়ে আরও অনেক জায়গায়  যাব আমরা।

এবারের যাত্রার শুরু হচ্ছে ৩ ডিসেম্বর লন্ডনের ঐতিহ্যপূর্ণ ভেন্যু ভারতীয় বিদ্যা ভবনে। এবারের মিউজিক্যালগুলো ৮ জন তাওয়াইফের জীবনী নিয়ে। কলাকারের কাজ দেখে অনেক স্বনামধন্য শিল্পী এবার যোগ দিয়েছেন আমাদের সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন আমার বন্ধুবর স্বনামধন্য শিল্পী পণ্ডিত চিরঞ্জীব চক্রবর্তী।

চিরঞ্জীব চক্রবর্তী বলেছেন, ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীতের মূলধারার সাংগীতিক পরিবেশনা ছাড়াও আমি সব সময় চাইতাম এমন কিছু কাজ করতে, যে কাজ অনেক মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে। এ ধরনের সাংগীতিক আখ্যান শুধু বিদেশে কেন, ভারতবর্ষেও হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আমরা একসঙ্গে ‘ওপেরা নর্থ’–এ কাজ করেছি। তাই আবার একসঙ্গে এই রকম আরেকটা নতুন ধরনের কাজে যুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে খুবই আনন্দিত।

জোসেলিন লাইটফুট বলেছেন, লন্ডনের সবচেয়ে নামী ওয়েস্টার্ন মিউজিক অর্গানাইজেশনের নাম London Chamber Orchrestra (LCO)–এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর জোসেলিন লাইটফুট অনেক দিন থেকেই কলাকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এ রকম কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে পারাও খুব আনন্দের।

কলকাতার অনিরুদ্ধ মুখার্জি বলেছেন, সংগীত বলতে যা বুঝি, গীত, বাদ্য আর নৃত্য—কলাকারের মিউজিক্যালে এসব কিছুই খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়। আমি আগেও কলাকারের সরস্বতী ডটার অব তানসেন মিউজিক্যালে বাজিয়েছি। প্রতিবার কাজ করতে এসে কত কিছু যে শিখি। উদ্‌গ্রীব হয়ে অপেক্ষায় আছি আগামী মিউজিক্যাল থেকেও অনেক কিছু শিখব।

এবার আমার সঙ্গে বিভিন্ন ভূমিকায় থাকছেন

পণ্ডিত চিরঞ্জীব চক্রবর্তী, চিকিৎসক বিজয় রাজপূত, এমি ফ্রেসটন, শ্রী গাঙ্গুলী, শতরূপা ঘোষ, সঙ্গীতা লাহিড়ী শ্রীবাস্তব, ইন্দ্রানী দত্ত, গৈরিকা মাথুর, শান্তনু গোস্বামী, মানস চৌধুরী, অমিত দে, অনিরুদ্ধ মুখার্জি, বালু রাগুরামন। স্টেজে উঠে গান করা বা অভিনয় করা খুব আনন্দের, কিন্তু এ আনন্দ পাওয়ার জন্য আরও কিছু মানুষের ওপর আমরা শিল্পীরা ভীষণভাবে নির্ভর করি।

ওনারা স্টেজের বাইরে থেকে মনপ্রাণ দিয়ে আমাদের সাহায্য না করলে কিছুতেই সুষ্ঠুভাবে এত বড় অনুষ্ঠান করা যায় না। এবার কলাকারে বিভিন্ন কাজে যোগ দিয়েছেন জিৎ গাঙ্গুলী, রজত মাথুর আর ব্যাক স্টেজের যাবতীয় ঝামেলা হাসিমুখে নিজের কাঁধে তুলেছেন শাহীন মিতুলী। সাহায্য করছেন ইন্ডিয়ান রাগা লন্ডনের (Indian Raga London) প্রধান মিরা বিনয়। দেবাশীষ ভট্টাচার্য একগাল হাসি, ঢাউস একখানা ক্যামেরা নিয়ে এবারও পাশে আছেন।

লেখক: চন্দ্রা চক্রবর্তী, শাস্ত্রীয় শিল্পী, সুরকার এবং সিইও, কলাকার আর্টস ইউকে