ঈদের আগে আমি কী ভাবছি
পৃথিবীতে অগণিত মানুষ যখন না খেয়ে আছে, অপুষ্টিতে ভুগছে, তখন কোটি কোটি ডলারের খাবারের অপচয়! বিশ্বের নানা সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, দারিদ্র্য ও বৈষম্যের হিসাব-নিকাশ বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে যদি সহজভাবে এ সংকট থেকে উত্তরণের পথের কথা চিন্তা করি, তাহলে কিন্তু একটি সমাধান পাওয়া সম্ভব। আর সেটা হচ্ছে সচেতনতা বৃদ্ধি। মানুষের এক দিনের খাবার অপচয়ের পরিমাণ দিয়ে যদি বিশ্বের প্রায় শতকোটি অভুক্ত প্রাণের খাবার মেলে, তাহলে এ সমস্যার সমাধান তো সচেতনতাই। এটির বিকল্প নেই। কেননা খাবার অপচয় থেকে বিরত রাখা আইনের কাজ যতটা না, তার চেয়ে বেশি অভুক্ত মানুষের কষ্টকে উপলব্ধি করা বিশেষ করে রমজান মাসে। কারণ, রমজান মাস, ত্যাগের মাস। ত্যাগ করা এবং দিতে শেখার মাস, আত্মত্যাগের মাস। ‘রোজা রাখো ক্ষমা চাও খুলে আছে দ্বার, তাকাও দু’চোখ মেলে দ্যাখো রাইয়ান, কান পেতে শোনো গায় সাত আসমান, খোশ আমদেদ এলো মাহে রমাদান।’ পবিত্র মাহে রমজান শেষ হয়ে আসছে। আর কয়েক দিন পর পবিত্র ঈদ।
গতকাল বাসায় কয়েকজন সুইডিশ মেহমান নৈশভোজে এসেছিল। খাবার টেবিলে নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়। যেমন সারাবিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা যেমন বেড়ে চলেছে ঠিক তেমনি খাদ্য নষ্ট বা অপচয়ের পরিমাণও বেড়ে চলেছে, এ বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১০ ভাগ মানুষ যখন প্রতি রাতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় আমরা পৃথিবীর মোট খাবারের পাঁচ ভাগের এক ভাগ অপচয় করছি। প্রায় ১০০ কোটি টনের অধিক খাবার নষ্ট করছি, এর চেয়ে নির্মম পরিহাস আর কী হতে পারে! জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচির এক প্রতিবেদনে খাদ্য অপচয়ের তালিকায় বাংলাদেশের নামটি অপচয়কারী প্রতিবেশী দেশগুলোর নামের পাশেই রয়েছে।
নৈশভোজের আলোচনায় উঠে আসে ইসলাম ধর্মকে সুইডেন এবং ইউরোপে আগের তুলনায় উদারভাবে দেখছে, যদিও মাঝে মধ্যে নানা সমস্যা দেখা যায়। ইউরোপ খ্রিষ্টান প্রধান হলেও এখানে মুসলমানের সংখ্যা একেবারে কম নয়। ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বসবাস রাশিয়ায়। দেশটিতে মুসলমানরা দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী। বেসরকারি হিসেবে শুধু মস্কোতেই বাস করেন প্রায় ৪০-৪৫ লাখ মুসলমান। ঈদের দিন রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলোতে একদিনের বিশেষ ছুটি ঘোষণা করা হয়। রাশিয়া একটি বিশাল বড় দেশ। ইউরোপ এবং এশিয়াজুড়ে এর অবস্থান, সেক্ষেত্রে ইউরোপের মধ্যে যে শহরগুলো রয়েছে সেখানেও ঈদ পালন হয়ে থাকে। যদিও ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ঈদ আকাশ-পাতাল ব্যবধান। কারণ, ইউরোপে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির বাইরে একটি দিনও বন্ধ রাখা হয় না। তাই ঈদ উপলক্ষে কর্মস্থলে আগেই ছুটির জন্য বলে রাখতে হয় ঈদের নামাজ পড়ার সময়সূচি এবং নামাজ শেষে ফের কর্মস্থলে যেতে হয়। ঈদের যে আনন্দ বাংলাদেশে, তা কখনো অনুভূত হয় না ইউরোপে। এদিক দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম দেশগুলোর কর্মজীবী বাংলাদেশিরা কিছুটা ঈদের আনন্দ পান।
এ পৃথিবীতে এমন অনেক দেশ আছে, যেসব দেশের কিছু কিছু অঞ্চলে সামারে দীর্ঘদিন ধরে সূর্য ডোবে না। সূর্য অস্ত গেলেও দেখা যায় দিনের আলো। যার কারণে এসব অঞ্চলের মুসলমানরা দিনের দীর্ঘ আলোতেই রোজা পালন করে থাকেন। আবার শীতের সময় বিষয়টি উল্টো হয় যেমন সূর্য দেখাই যায় না, সেক্ষেত্রে এসব অঞ্চলে রোজা সাধারণত অন্যান্য দেশের মুসলমানদের রোজার সময়ের চেয়ে কম হয়। সূর্য না ডোবা দেশ ও অঞ্চলগুলো হলো—নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, আলাস্কা, আইসল্যান্ড ও কানাডা। এসব দেশ ও দেশগুলোর কিছু কিছু অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে সূর্য ডোবে না। সেসব দেশের মুসলিমরাও যথারীতি রমজানের রোজা পালন করে থাকেন। তবে এ বছর রোজা এমন একটি সময় চলমান যখন সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়টি সুইডেনের সাউথ এবং নর্থের যে দূরত্ব তাতে করে সময়ের কিছুটা ব্যবধানে রোজা পালন করা হয়েছে। সুইডেন ছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলভেদে মুসলমানরা ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা পর্যন্ত রোজা পালন করেছেন (যা সাধারণত ১৭-২২ ঘণ্টা পর্যন্ত হয়ে থাকে)। জিনিসপত্রের দাম রোজার মাসে বাড়ানো হয়নি বরং কিছুটা কম বলা যেতে পারে। বিশ্বের সব দেশের মানুষের বাস এখানে। সে ক্ষেত্রে ধর্মচর্চায় সুযোগ-সুবিধা অনেক। কাজের ফাঁকে নামাজ রোজার সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে যা সত্যিই প্রশংসনীয়।
সুইডেনের সমাজে যাঁরা প্রভূত অর্থ সম্পদের মালিক, তাঁদের অনেকেই স্ব-অর্থায়নে সমাজসেবামূলক কাজ করেন। কিন্তু যাঁদের সম্পদ কম, তারা এলাকায় কোনো মসজিদ, মন্দির, ক্লাব, বা পাঠাগার গড়ার জন্য সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকেন। এ ধরনের সমাজসেবা হলো নিজের খেয়ে সমাজের জন্য কাজ করা। এদের প্রাপ্তি বলতে মানুষের জন্য কাজ করার আনন্দ বৈ আর কিছু না। এসব কাজ সুইডেনে সব সময় হয়ে থাকে। বাংলাদেশে রমজান মাসে আমরা অনেকেই এ ধরনের কাজ করে থাকি জাকাতের একটি অংশ হিসেবে। সুইডিশদের মধ্যেও ভালো-মন্দ আছে তা সত্ত্বেও কেন যেন মনে হয় সমাজব্যবস্থায় ইসলাম ধর্মের অনেক রীতিনীতির সঙ্গে সুইডেনে বেশ মিল খুঁজে পাই। যেমন এরা বেতনের এক তৃতীয়াংশ ট্যাক্স দেয়, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ায়। ইদানীং সুইডেনেও ইউরোপের অনেক দেশের মতো মসজিদ তৈরি এবং কমিটি নির্বাচনে লাখ লাখ টাকা খরচ করা হচ্ছে।
এতক্ষণ অনেক কথাই জানালাম এখন বলি আমার অনুভূতি ‘ঈদ তখন আর ঈদ এখন’ এ বিষয় নিয়ে। প্রথমেই মনে পড়ে গেলো সেই ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’। ছোটবেলায় আমার কাছে ঈদের আগের রাতেই ঈদ মনে হতো। সে যে কী আনন্দ যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। ঈদের আগের দিন রাতে শত চেষ্টা করে দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। কেন জানি ঘুমের ক্নান্তি শরীরে স্পর্শ করেনি। বিছানায় এদিক সেদিক গড়াগড়ি করতে করতে হঠাৎ সকাল হয়েছে। ঈদের খুশিতে সবকিছু উলট-পালট হয়ে যেত। তবুও সব কিছুতে দ্বিগুণ আনন্দের অনুভূতি পেতাম ঈদকে ঘিরে। রমজান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঈদ নিয়ে যত সব করণীয় পরিকল্পনা বেড়ে যেত। বিশেষ করে বাসাবাড়ির চাকচিক্য করা এবং নতুন পোশাক সবার জন্য এবং যার ছিল ব্যাপক চাহিদাও।
মনে পড়ে গেল প্রায় ৪০ বছর আগের স্মৃতি, ঈদের নামজের পূর্বে মিষ্টিমুখ অর্থাৎ সেমাই খেয়ে নামাজে যাওয়া যেন একটা সামাজিক রেওয়াজ। না খেলেও জোরপূর্বক খাওয়াতেন মা। এরপর নতুন পোশাক পরে সালামি নিতে অপেক্ষায় থাকতাম। বাবা-মা আত্মীয়, পরিবার, পরিজনসহ বড় সবাইকে সম্মান করলে টাকা হাতে তুলে দিতেন। সেই টাকা দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম বন্ধুদের নিয়ে কেনাকাটি করতে।
পাড়া-মহল্লা চষে বেড়াতাম। সবার বাসায় গিয়ে ক্ষীর, সেমাই খেতে খেতে একটা সময় আর খাওয়ার কোনো রুচি থাকত না। সব মিলে ছেলেবেলার ঈদ ছিল পরিপূর্ণ বিনোদনে ভরা। যা এখন শুধু স্মৃতি, তবুও—মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকে, স্মৃতি যেন আমার এ হৃদয়ে বেদনার রঙ্গে রঙ্গে ছবি আঁকে। সেই আগের মতো আনন্দ এখন আর হয় না, হবে কী করে বাবা-মা নেই, কোথাও কেউ নেই সে ছোটবেলার মতো। তিন যুগেরও বেশি সময় প্রবাসে ঈদ করছি। বিদেশে অর্থের পিছুটান না থাকলেও আনন্দ উল্লাসের অনেক ঘাটতি রয়েছে যা কোনোভাবেই পূরণীয় নয়। দেশের টানে নাড়ির টানে মন ছুটে চলে সব সময় দেশের পানে। বিশেষ করে বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে দেশকে অনেক বেশি মনে পড়ে, ফলে বোধগম্য হয় ঈদ হচ্ছে। তাই দুঃখ আর বেদনার আরেক নাম প্রবাসীদের ঈদ উদ্যাপন! যদিও গোটা বিশ্বের মুসলমান ধর্মালম্বীদের জন্য এ এক মহা আনন্দের দিন। ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানেই আনন্দ। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আল্লাহ নির্দেশে সব ধরনের পানাহার থেকে মুক্ত থাকা। এভাবে একমাস সিয়াম সাধনার পর আসে ঈদ। প্রতি বছর ঈদের এ আসা যাওয়ার মাঝে অনেক কিছু দেখেছি, অনেক কিছু শুনেছি, অনেক কিছু ভেবেছি, অনেক কিছু উপলব্ধি করেছি। শুধু প্রশ্ন করিনি ‘কেন’? কেন এই ঈদ এবং কী কারণ থাকতে পারে এর পেছনে? কেন বা কী কারণ এ বিশ্লেষণ যদি সঠিকভাবে না জানা যায়, তবে তৃপ্তি বা আত্মবিশ্বাস সঠিকভাবে গড়ে ওঠে না, গড়ে ওঠে না বোধ। ভালোবাসার বোধ, ভাতৃত্বের বোধ, ক্ষমার বোধ, ত্যাগের বোধ, বিবেকের বোধ, নৈতিকতার বোধ ইত্যাদি। এতটা বছর পার হয়ে গেল অথচ তারে (বোধ) আমি চিনতে পারিনি আজও। আলো বা অন্ধকারে মাথার ভেতরে হাজার বার যে জিনিসটি কাজ করে সে স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, এমনকি ভালোবাসাও নয়। হৃদয়ের মাঝে জন্ম নিয়েছে বোধ তারে এড়াতে পারা বড্ড কঠিন। তাইতো প্রশ্ন জেগেছে মনের মাঝে কবে হবে বোধগম্য? আমার প্রচুর আছে কিন্তু তার কিছুই নেই এটা আমার বোধগম্যে এসেছে, কিন্তু আমি কি ভাবছি যার কিছু নেই তার জন্য কিছু করতে? উত্তর হ্যাঁ বা না হতে পারে। কিন্তু বোধগম্যতা যদি সেই ‘কী ভাবছি’ অনুভূতির মূল্যায়ন না দিতে পারে তখন হ্যাঁ বা না উত্তর খুঁজে পাওয়া কঠিন।
পবিত্র ঈদের খুশি ধনী, গরিব সবার জীবনে নিয়ে আসুক সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি। আমার ভাবনায় ঢুকেছে যেমন এবারের ঈদে আমাদের মধ্যে কি বোধগম্য আসতে পারে না? যে বোধগম্য দিতে পারে সমাধান, জীবনের সমাধান! যার প্রচুর আছে এবং যার কিছু নেই এরা কি পারে না বন্ধু হতে? যার কিছু নেই এবং যার সব আছে এদের মধ্যে কি মিলন ঘটানো সম্ভব? আমার মনে হয় এ জন্যই রমজান মাসের আবির্ভাব হয়েছে।
আল্লাহ পাকের হুকুম পালন করা এবং সেই অনুযায়ী কাজ করার জন্য রমজান মাসে রোজা থাকার তাৎপর্যের গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার বোধ যদি হৃদয়ে না আসে তবে সে জীবনে সুখ আসবে বলে মনে হয় কি? আমি জানি না, আছে কি কেউ যে জানে? বড় সাধ জাগে একবার তাকে দেখার! ঈদ আমাদের জীবনের শূন্যতাকে পূর্ণ করুক। এবারের ঈদ উদ্যাপন বয়ে আনুক দেওয়া-নেওয়ার অঙ্গীকার। ঈদ পৃথিবীর সমস্ত মুসলমানের হৃদয়ের মানবতার দ্বার খুলে দিক তেমনটি কামনা করি। চালাও সে পথে যে পথে তোমার প্রিয়জন গেছে চলি।
*লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]