টাকা নয়, তবু টাকার ছায়ায় বন্দী জীবন—কখন মুক্তি
‘ভ্রমণে টাকা, সম্পর্কে টাকা, প্রেমে টাকা, বিচ্ছেদেও টাকা।’ আধুনিক জীবনের পরতে পরতে টাকার অনিবার্য উপস্থিতি এক চরম সত্যের প্রতিচ্ছবি। প্রশ্ন হলো, এটি কি শুধুই প্রয়োজন, নাকি মোহ? নাকি একধরনের মনস্তাত্ত্বিক বন্দিত্ব?
টাকা মানুষের তৈরি, কিন্তু আজ মানুষ টাকার তৈরি জীবনে বন্দী। একটি সময় টাকা ছিল কেবল লেনদেনের মাধ্যম, এখন তা হয়ে উঠেছে মানুষের সফলতা, সম্পর্ক ও সম্মানের মাপকাঠি। সন্তান কোথায় পড়বে, মা–বাবা কোথায় চিকিৎসা পাবেন, একজন তরুণ কীভাবে প্রেম করবে বা বিয়ে করবে—প্রতিটি সিদ্ধান্তে টাকা একক নিয়ামক। অথচ প্রশ্নটা এখন এই নয় যে ‘টাকা দরকার কি না?’ বরং প্রশ্ন হচ্ছে, ‘টাকা ছাড়া কি সত্যিই কিছুই হয় না?’
দুর্নীতির জন্য সাধারণত দায়ী করা হয় অভাব, সিস্টেমের গলদ বা পারিপার্শ্বিক চাপে বাধ্য হওয়া। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, দুর্নীতি মূলত হয় লোভ ও মোহের কারণে। এমন অনেক দুর্নীতিবাজ আছে, যাদের কাছে অভাব বলে কিছু নেই, কিন্তু অতৃপ্ত লালসা তাদের অন্যায় পথে ঠেলে দেয়। অভাব দুর্নীতির জন্ম দেয়, আর মোহ তাকে প্রতিষ্ঠিত করে। দুর্নীতির সূচনা হয় অর্থনৈতিক চাপে, কিন্তু তা গভীর হয় মানসিক অসীমতায়।
আজ প্রেমের প্রথম প্রশ্ন হয়, ‘ছেলে কী করে?’ সম্পর্কের ভিত্তি স্থির হয় আয় দিয়ে, আর বিচ্ছেদের ভাষ্য হয়ে দাঁড়ায় ‘পর্যাপ্ত নয়’। এমনকি বিয়ের মতো সামাজিক প্রথাও এখন ‘উইথ প্যাকেজ ডিল’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। যখন ভালোবাসা একটা খরচ হয়, তখন বিচ্ছেদ হয়ে দাঁড়ায় সাশ্রয়।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: dp@prothomalo.com
এ বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন আসে, তাহলে সৎ থেকে কি উপার্জন করা যায় না? যাওয়া যায়, তবে প্রয়োজন দক্ষতা, পরিকল্পনা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ। দক্ষতা মানেই আয়। টাকা নয়, স্কিল হোক পুঁজি। ফ্রিল্যান্সিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, আইটি, ভাষা শিক্ষা—দক্ষতা মানেই আয়। চাকরির পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং, কনটেন্ট ক্রিয়েশন বা অনলাইন বিজনেস—তরুণদের জন্য এ এক বিশাল সম্ভাবনার দ্বার। ছোট ব্যবসা, হস্তশিল্প, খাদ্য বা সেবাভিত্তিক উদ্যোগ—সৎ পথে উপার্জনের দুর্দান্ত পথ। অর্জিত অর্থ সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে না পারলে টাকার মোহ আবার মাথা তোলে। তাই শেখার প্রয়োজন সঞ্চয় ও বিনিয়োগের নীতি।
দুর্নীতিমুক্ত জীবনের পথ হলো নৈতিকতা ও আত্মসংযম, সমাজে দায়বদ্ধতা যেখানে সম্মান টাকার নয়, চরিত্রের ভিত্তিতে হয়। পরিবারে শিক্ষার সংস্কৃতি ছোট থেকেই শেখাতে হবে—সততা দুর্বলতা নয়, সাহস। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও আইন থাকা জরুরি, দুর্নীতির জন্য শাস্তির বাস্তবতা থাকতে হবে। অহংকারহীনতা ও তৃপ্তি অর্জন করতে হবে, সীমাবদ্ধতা মেনে নেওয়াই মানসিক স্বাধীনতা।
টাকা ছাড়া জীবন চলবে না—এটা বাস্তবতা। কিন্তু টাকাই যদি জীবন হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা এক ভয়াবহ দাসত্ব। জীবনের গৌরব টাকা উপার্জনে নয়, বরং টাকা কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তাতে। আমরা যদি আমাদের মানসিকতা পরিবর্তন না করি, তবে টাকার ছায়া শুধু সম্পর্ক নয়—বিবেককেও গ্রাস করবে।
জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত, ‘নট মোর মানি, বাট এনাফ মানি উইথ ইন্টেগ্রিটি।’ অর্থ থাকুক, কিন্তু মানবতা না হারিয়ে।