ব্রাহ্মণবাড়িয়া ট্রেন স্টেশনে ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে বসে আছে রাবেয়া। অদূরে বেঞ্চিতে বসে থাকা রোখসানার চোখ পড়তেই মনে হলো প্ল্যাটফর্মের ফ্লোরে যে নারীরা বসে থাকেন, এ নারী তা নয় যেন। কোথায় যেন একটু পরিচিতি আবার অসংগতি। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে দেখে রোখসানার মনটা হঠাৎ কেমন করে ওঠে। কাছে এসে বলে।
কী গো তুমি কই যাইবা?
কই আর যামু। স্টেশনে শুইয়া থাকুম।
স্টেশন কি আর শুয়ে থাকার জাগা?
হ। মাছিহাতা…। রাবেয়ার গলা আটকে এল।
কান্দো কেন, কী হইছে?
কেন কান্দি তোমার কাছে কইয়া কী লাভ?
হ। লাভ কিছুই না। লাভ–ক্ষতির হিসাব দিয়া কি আর দুনিয়া চলে।
কিছুক্ষণ পর রাবেয়া বিড়বিড় করে আপন মনেই বলতে থাকে। বড় মাইয়ার কাছে থাকতে গেছিলাম, কালিসীমা। জামাইয়ে বাইর কইরা দিছে। কয় ‘বিয়ে করছি মেয়েরে, শাশুড়িরে তো বিয়া করি নাই। এত দায় মাথায় নিয়া সংসার করণ যাইত না।’
আহা রে, এটা কি কোনো কথা? তোমার ছেলে নাই?
না মা, ছেলে নাই। দুই মেয়ে। ছোট মেয়ের জামাইর বাড়ি কাজিরখোলা।
কাজিরখোলা? এটা আবার কই?
পাঘাচংয়ের পুবে। তালতলাবন্দের ওপর দিয়া হাইট্টা গেলে আধা ঘণ্টা।
ও আচ্ছা।
ছেলেমেয়ে বইল্লা কথা না গো। কপালে দুর্গতি থাকলে সাত পুতের মা ও ভাত পায় না। ছোট মেয়ের জামাইডা রাজমিস্ত্রির জোগালি। ইট পইড়া পা ভাঙছে। বিছনায় পড়ছে আজ তিন মাস।
রোখসানা মনে মনে বলে, আহা অসহায় মানুষটা গো। এ জীবনের কত রূপ! আজকের আলো কালই অন্ধকার। কখন কার কোনো দিন আসে কে জানে। রাবেয়া তখন অঝোরে কাঁদছে। রোখসানা সেদিকে খেয়াল না করে বলে।
কী গো? তোমার ঠোঁট–মুখ শুকনা লাগছে। খাইছনি।
রাবেয়া কথা কয় না। রোখসানা কাছে এসে বলে,
কই গো, আমার সঙ্গে চলো। কাছেই হোটেল আছে। তোমার কিছু খাওন দরকার।
রাবেয়া কথা বলে না। নড়েও না।
ও বেডি। ঝিম ধইরা বইস্যা থাইকো না। আমার সঙ্গে চলো।
রাবেয়াকে নিয়ে রোখসানা সোজা চলে এল স্টেশনের পেছনে অমৃত হোটেলে। দুজনই হাত–মুখ ধুয়ে একটা কেবিনে বসে। রাবেয়া বলে,
মাগো, তোমার বাড়ি?
আমরা থাকি কলেজপাড়া। দাদাবাড়ি বিজেশ্বর।
ও আচ্ছা। তুমি কী করো?
সরকারি কলেজে অনার্সে পড়ি।
ও আচ্ছা। তুমি লেখাপড়া করো। আমারে খাওয়াইতে গিয়া খরচ করবা? তোমার নিজেরই তো কত খরচ?
হ, কথা ঠিক। আগে তুমি কিছু খাও। একজনকে খাওয়ানোর মতো টাকা আমার আছে।
এ সময় হোটেল বয় এসে বলে, আপা, কী খাবেন?
রোখসানা বলে, ‘আমাকে অল্প চিনি দিয়ে একটা চা দিয়ো। আর ওনার জন্য খাবার নিয়ে আসো। রাবেয়ার দিকে চেয়ে সে বলে। কী খাবেন আন্টি? গরু, খাসি, মুরগি, দেশি কই মাছ ভাজা, টাকি মাছ দিয়ে টমেটোর ঝোল ডাল। রোখসানা তাকানোমাত্রই রাবেয়া বলে।
মা, আমার কই মাছ আর টমেটোর ঝোল হলেই অইব।
জীবনের নানা এলোমেলো গল্পে খাওয়া শেষে রাবেয়া বলে,
আমারেও একটা চা দাও গো। মাথাটা চক্কর দিছে। কাল সহালে দুইটা রুটি খাইছিলাম। আর আজ তুমি…। আমার মেয়ের লগে এমন আবাচ্য–কুবাচ্য শুরু করছে গো। পাশের বাড়িতে গিয়া পলাইয়া রইছি। ওরা খাইতে কইছিল। আমার শইল্লের কাঁপনিই থামে না। খামু আর কী। জামাই যদি আমার মেয়েডারে মারধর করে। আল্লারে ডাকতে ডাকতে গো মা আমার গলা শুকাই গেছে। আল্লা রক্ষা করছে। শেষে সইন্ধা অইয়া গেছে। কোন রহমে রাইতটা পার করছি। ওই কালিসীমা থেইক্কা পাঁচ–ছয়বার জিরানি দিয়া স্টেশনে আইছি।
ভিজে আসা চোখ আড়াল করে রাবেয়া বলে। আমারে খাওয়াইছো। মা গো, আল্লাহ তোমারে ধনেজনে শান্তি করুক। বিদ্যা–বুদ্ধিতে রাজরানী করুক।
চা খাওয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ সময় ঘোষণা এল। কর্ণফুলী এক্সপ্রেস ২ নম্বর লাইনে এসে দাঁড়াবে। জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে কর্ণফুলীর আগেই ছেড়ে যাবে।
রোখসানার হাত ধরে রাবেয়া রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এল। প্ল্যাটফর্মে এসে উঠতেই রোখসানা মাইনুলকে ট্রেনের অপেক্ষা করতে দেখে ডাক দেয়। এই মাইনুল।
আরে রোখি তুই! স্টেশনে? কোথাও যাবি?
না। যাব না। জয়ন্তিকায় মা আসবে ঢাকা থেকে। মাকে রিসিভ করতে আসছি। এই শোন, তোদের বাড়ি মাছিহাতা না?
হ।
রাবেয়াকে দেখিয়ে বলে ওনার বাপের বাড়ি মাছিহাতা। তুই সঙ্গে করে নিয়ে যা, প্লিজ।
মাইনুল এগিয়ে এসে বলে। কী গো। মাছিহাতা কোন বাড়ির তুমি? রাবেয়ার চোখে–মুখে ঈষৎ বিষাদের ছায়া। এরই মাঝে কোথায় যেন সামান্য হাসি।
হলদি মুড়া কবরস্থানে আমার বাপের কবর আছে। বাবা নাই তো কী হইছে। বাপের কবর দেখলেও শান্তি। আমার বাবা আমারে অনেক আদর করত। বাবার কান্দে চইড়া স্টেশনে কত গেছি। মনমিয়ার দোকানের পেঁয়াজু খাইছি। চানপুর বাজারেও গেছি। বাজারে একটা জিলাপির দোকান আছে না?
হ। আছে।
রাবেয়াকে বেঞ্চিতে বসিয়ে মাইনুলকে ইঙ্গিতে ডেকে একটু দূরে গিয়ে রোখসানা বলে।
মাইনুল। শোন। মুরব্বি মানুষ। এত প্রশ্ন করিস না। তুই একটু গাইড করে নিয়ে যা।
আরে নিয়ে যাওয়া তো কোনো বিষয় না। এ মহিলা তো দেখি জিগাই একটা, কয় আরেকটা। কথাবার্তা কেমন যেন আউলা। তাই ভাবছি।
আর বলিস না। হঠাৎ করে দেখে আমার বড় মামির কথা মনে পড়ছে। মামি দেখতে ঠিক এমনই ছিল।
মাইনুল আশ্বাস দিয়ে বলে। আচ্ছা, ঠিক আছে। চিন্তা করিস না, আমি নিয়ে যেতে পারব।
অবস্থাটা একবার ভেবে দেখ। ছেলে নেই। মেয়ের বাড়ি গেছিল থাকতে। জায়গা হয়নি। কী আর বলার আছে। অভাব–অবহেলায় যা হয় আরকি। খাওয়াদাওয়ার অনিয়ম। ঘুমের অনিয়ম। অনিশ্চয়তায় মাথাটা ঠিক নেই।
আচ্ছা, ঠিক আছে। চিন্তা করিস না। নিয়ে যাব।
এই। কাল কলেজে আসবে তো।
হ, আসব।
ঠিক আছে, কাল কথা হবে।
রাবেয়ার হাতে কিছু টাকা দিয়ে ট্রেনে উঠিয়ে রোখসানা চলে গেল।
বিনা কারণে লোকজন কৌতূহলী হয়ে ওঠে এ আরেক বিড়ম্বনা। তাই ট্রেনে রাবেয়ার সঙ্গে মাইনুলের তেমন কথা হলো না। পাঘাচং স্টেশনে নেমে তখন তারা ঈদগাহের কাছাকাছি। তখন নীরব। লোকজন তেমন নেই। মাইনুল বলে,
কী গো, তোমার বাপে কি বাড়িঘর বেইচা দিছিল?
রাবেয়া কোনো কথা কয় না।
হ, এমন অনেক দেখছি। দেনার দায়ে মানুষ জায়গা–সম্পত্তি শেষ অবধি বাড়িটা পর্যন্ত বেইচ্চা চইলা যায়। এসব বাস্তহারা মানুষের আর কোনো খবরও থাহে না। কেউ আবার মাটির মায়া ছাড়তে পারে না, আশপাশে কোথাও ভাড়া থাহে। মানুষ ভালো অইলে কেউ আবার দয়া কইরা নিজের বাড়িতে থাকতে দেয়। এখন তো এসব খুব বাড়ছে। সবাই বিদেশ যাইতে চায়। দালালের খপ্পরে পইড়া মানুষ শেষ হয়। আর কারও হাতে একটু টাকাপয়সা অইলেই শুরু করে সুদের ব্যবসা। গরিবের আর উপায় নেই। হঠাৎ মাইনুল খেয়াল করে দেখে রাবেয়ার চোখ দুটো বেশ উজ্জ্বল। আবার ঠিক তেমনি রহস্যজনক।
কী গো, আমি কি কইছি, তুমি কি শুনছ?
হ, শুনছি। জন্মের ভিটা কি আর বেচা যায় রে বাবা। আমি তো অহন আমার বাবার ঘ্রাণ পাইতেছি। বাপের জায়গাজমি না অয় কিন্না নিল। এই ঘ্রাণ কি আর কেউ নিতে পারব। এই দেখ, ঈদগাহের সামনে এই যে তিন কোনা জমিডা। ঈদের দিন এহানে কত দোকান বসত। আব্বা আমারে কিন্না দিত। লাল ফিতা, চুড়ি টিপ আইসক্রিম, সন্দেশ…।
পুরান পুকুর পার হয় আরও একটু সামনে এসে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে রাবেয়া বলে। ওইটা মলাই নানার বাড়ি না।
হ। উনার ছেলেমেয়েরা এখন লন্ডনে থাকে, খুব ভালো আছে।
নানা অনেক আদর করত। বুকভরা মায়া।
হ, আগের দিনের ওই মায়া অহন আর মানুষের মধ্যে নেই।
এদিকে রাবেয়া বলেই যায়। হলদি মুড়ার কাছে মলাই নানার একটা জমি আছে। একবার আমারে কোঁচড় ভরতি কইরা বেগুন আর টমেটো দিছিল।
হ, অনেক বছর আগে মারা গেছে। হলদি মুড়াতেই উনার কবর।
আহা। আদর করার মানুষ নেই। মা নেই। বাপ নেই। তারপরও শান্তি আছে। বাপের দেশের মাডি শান্তি। বাতাসেও শান্তি।
দুবাড়িয়ার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া এ সরু রাস্তা। কত মায়ামাখা স্মৃতি। রাস্তার ঢালে মায়াভেজা ঘাস। ধান কাটা মাঠের ওই পারে মাছিহাতা। আশৈশবের মমতাজড়ানো হিম সবুজ গ্রামখানা। রাবেয়া পথের খেয়াল ভুলে চেয়ে থাকে। হলদিমুড়ার কাছে এসে মাইনুল বলে।
যাও গো। তোমার বাপের কবর দেখো গিয়া। কবরটা কই খেয়াল আছে নি?
হ, আছে, ওই যে কদমগাছটার উত্তর পাশে।
কবরস্থানের অদূরে রাস্তার পাশে একটা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইল মইনুল। রাবেয়া কাছে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বাবার কবরের দিকে অপলক চেয়ে থাকে। একপর্যায়ে কদমগাছে হেলান দিয়ে বসে পড়ে রাবেয়া। কিছুক্ষণ পর বিলাপের মতো মৃদু কান্না শোনা যায়। মাইনুল ঠিক তেমনি ঠায় দাঁড়িয়ে। মনে মনে বলে,
আহা রে। এই বয়সেও বাপের জন্য এমন কান্না। ওই যে একটা কথা আছে না। মেয়েরা হয় বাপ সোহাগী।
না, এমন কিছু মাইনুল ভাবতে পারছে না আর। এরই মধ্যে দৃশ্যটা মোড় নিচ্ছে অন্যদিকে। রাবেয়া এবার উঠে দাঁড়ায়। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে দু–একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে সোজা পূর্ব দিকে হাঁটতে থাকে।
অবাক মাইনুল বেশ কয়েক কদম এগিয়ে এসে বলে,
কী গো! তুমি তো দেহি উল্টা দিকে হাঁটা দিছো। ওই দিকে কই যাও?
না, আর কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। রাবেয়া ফিরেও তাকাল না। আটলা দরগাহ আর পাঘাচং খাদিম বাড়ির মাঝামাঝি ওই যে ফাঁকাটুকু দিয়ে বিস্তীর্ণ মাঠের দিকে হাঁটতে হাঁটতে একপর্যায়ে রাবেয়া দৃশ্যান্তরে মিশে যায়। মাইনুল তখনো দাঁড়িয়ে। একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বুকে চেপে মাইনুল বলে।
আহা, মানুষের বুকের ভেতর কত কষ্ট চাপা থাকে। কারও আবার বলার জায়গাও থাকে না।
মাইনুল দেখে, হলদি মুড়া কবরস্থানের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে কদমগাছটার তলে একটা অতৃপ্ত নিশ্বাস কেঁদে ফেরে। কত মানুষ এ পথে আসা–যাওয়া করবে, কেউ কোনো দিন টেরও পাবে না।