৬ ফেব্রুয়ারি প্রাকৃতিক বিপর্যয়: তুরস্ক ও বাংলাদেশ

তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আঘাত হানা শক্তিশালী ভূমিকম্পে ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছে
ফাইল ছবি ছবি: রয়টার্স

উচ্চতর গবেষণার কাজে দীর্ঘদিন তুরস্কে থাকার কারণে তুরস্কের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জননিরাপত্তা, অধিবাসীদের আন্তরিকতা, আতিথেয়তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে খুব কাছ থেকে জানার এবং দেখার সুযোগ হয়েছে। দেখেছি, তুরস্কের স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্যোগের সময়ে কীভাবে মানুষ মানুষের পাশে থেকে ভেঙে না পড়ে শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে নতুনভাবে দাঁড়াতে পারে।

দেখেছি, দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা কতটা সুশৃঙ্খল ও সংগঠিত হলে সমন্বিত উপায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করতে পারে। আপনারা হয়তো নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, আমি ৬ ফেব্রুয়ারি ভোররাত ৪টা ১৭ মিনিটে তুরস্কে ঘটে যাওয়া স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের কথা বলছি।

ভূমিকম্প যে মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তুরস্কের হাতায় শহরে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ভবনগুলোর এই ছবিটি দেখলেই তা বোঝা যায়
ফাইল ছবি ছবি: এএফপি

স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প বলছি কয়েকটি কারণে—

১. এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৭ এবং ৭ দশমিক ৬ রিখটার স্কেলে, যার স্থায়িত্ব ছিল টানা ৯০ সেকেন্ড। এর একটির কেন্দ্র ছিল কাহরামান মারাশ, অন্যটির মালাতিয়া প্রদেশ। দুটিই তুরস্কের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত অঞ্চল। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের গভীরতা ছিল মাত্র ৭ থেকে ১০ কিলোমিটার।

২. ভূমিকম্পের ব্যাপ্তি ছিল তুরস্কের ১০টি (কাহরামান মারাশ, হাতাই, আদিয়ামান, গাজিয়ানতেপ, শানলি উরফা, আদানা, মালাতিয়া, দিয়ারবাকির, কিলিস, ওসমানীয়ে) অঞ্চল বা প্রদেশজুড়ে, যার ব্যাপ্তি ছিল প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সরকারি হিসাব মতে, ১ কোটি ৩৫ লাখ মানুষের বসবাস ছিল।

৩. শক্তিশালী পরপর দুটি ভূমিকম্পের পরাঘাত হয়েছে তিন হাজারবারের চেয়ে বেশি, যার কারণে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির পরিমাণ অনেক বেশি হয়েছে। এখনো মানুষ এক অজানা আতঙ্ক বয়ে বেড়াচ্ছে।

তুরস্কের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণবিষয়ক সমন্বয়ক মার্টিন গ্রিফিথস তুরস্কের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, তুরস্ক এখন গত ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির মোকাবিলা করছে। তিনি তুরস্কের পদক্ষেপের প্রশংসা করে বলেছেন, এ ভয়াবহ দুর্যোগের মোকাবিলায় তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ কর্তৃক যে তৎপরতা নেওয়া হয়েছে, সেটা নজিরবিহীন। তুরস্কের অত্যন্ত প্রশিক্ষিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা টিমের (আফাদ) এক লাখের বেশি সদস্য উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নিয়েছেন।

আফাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় একযোগে ত্রাণ তৎপরতাসহ সব ধরনের সহযোগিতায় ঐক্যবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তুরস্কের এ দুর্যোগ বিশ্ব মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তুরস্কের সঙ্গে বৈরিতার ভাব পোষণ করে এমন বহু দেশ সময়ক্ষেপণ না করে তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

যাহোক, আমরা এবার দেখি তুরস্কের এই ভূমিকম্পে কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ভূমিকম্প এতটাই শক্তিশালী ছিল যে ভূমিকম্পের ফলে দুইটি বড় ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে, যার একটি প্রায় ৩০০ কিলোমিটার, আরেকটি ১২৫ কিলোমিটার লম্বা। এ যখন আপনি পড়ছেন নির্ভরযোগ্য প্রাপ্ত সূত্রমতে, কেবল তুরস্কে নিহত হয়েছে ৩৮ হাজারের বেশি। আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে ১ লাখ ৮ হাজারের বেশি। ৭ হাজার ৯০০টি ভবন পুরোপুরি ধসে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ হাজার ৫৭৬টি ভবন থেকে ২ লাখ ১১ হাজার ভবন সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। ভূমিকম্প সংঘটিত অঞ্চলে ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৩৪৬টি ভবন পরীক্ষা করা হয়েছে, যার মধ্যে ৫০ হাজার ৫৭৬টি ভবন এখনই ভেঙে ফেলার সুপারিশ করা হয়েছে।

১৯৯৯ সালে তুরস্কে সর্বশেষ বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট ছোট মাত্রার ভূমিকম্পে কিছু ক্ষয়ক্ষতি হলেও ৬ ফেব্রুয়ারি ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প তুরস্কের মহাবিপর্যয়ের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সংযোজন হলো। তুরস্কের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর ইস্তাম্বুলে গত চার বছর আগে একটি ভবন ধসে ২১ জন নিহত হলে স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা সরকারকে ভবন নির্মাণের বিধি মেনে চলা এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে ফেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার শক্তভাবে সেগুলোর বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এবারের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের তালিকায় নতুন এবং পুরোনো সব ভবনই রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যদি বিল্ডিং কোড মেনে ভবনগুলো বানানো এবং আগেই সতর্কবার্তা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হতো, তাহলে প্রাণহানির পরিমাণ হয়তো আরও কমে যেত। তবে ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনগুলো অধিকাংশই ১৯৯৯ সালের ভূমিকম্পের পূর্বে নির্মিত। ওই ভবনগুলোর ব্যাপারে যদি সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আরও সচেতনতা থাকত, অর্থাৎ ভূমিকম্পে সহনীয় কি না তার যাচাই সনদ থাকত, তাহলে হয়তো এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটত না।

যেমনটা এখন বিভিন্ন শহরে শুরু হয়েছে। ভবনগুলো পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে বসবাসের যোগ্য কি না, তার একটা সনদ প্রদান করা হচ্ছে। তবে তুরস্কের সরকারি একটি গৃহ নির্মাণ প্রকল্পের নাম হলো ‘তকি’ (TOKI)। ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এ তকির মাধ্যমে যে সরকারি ও বেসরকারি ভবনগুলো নির্মিত হয়েছিল, সেগুলো খুবই নির্ভরযোগ্য এবং এ ভূমিকম্পে তকি কর্তৃক নির্মিত কোনো ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এগুলোর মান নিয়ে এখন পর্যন্ত কেউ কোনো প্রশ্ন তুলতে পারেননি।

বাংলাদেশসহ ৬১টি দেশ ৪৪৪টি বিমানে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা প্রেরণ করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে। দুর্গত এলাকায় এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৭৫ হাজার তাবু স্থাপন করা হয়েছে। ৫ হাজার ৪০০ কনটেইনার দিয়ে অস্থায়ী ঘর স্থাপন করা হয়েছে। হাজারো ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। ১৬ লাখ আক্রান্ত পরিবারকে জীবন ধারণের জন্য সব সুযোগ–সুবিধাসহ তাৎক্ষণিক অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

ভূমিকম্পে আক্রান্ত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের ১৪ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভায় বক্তব্যের কিছু বিষয় পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো—

১. ভূমিকম্পে যত ভবন ধ্বংস হয়েছে, সবগুলো আগামী এক বছরের মধ্যে সরকার নির্মাণ করে দিবে। আগামী মার্চ থেকেই ভবন নির্মাণ শুরু হবে। ২০১৯ সালে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্দেশ্যেও একই ঘোষণা দিয়েছিলেন। সবগুলো ভবনের কাজ এক বছরের মধ্যে সম্পন্ন করেছিলেন।

২. আক্রান্ত প্রত্যেক পরিবারকে আগামী এক বছর পর্যন্ত বাড়িভাড়া দেওয়া হবে। বাড়িভাড়ার পরিমাণ প্রতি মাসে পাঁচ হাজার লিরা (বাংলাদেশি টাকায় ৩০ হাজার টাকা) হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার যেন তাদের পছন্দ অনুযায়ী বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে পারে, সরকার তার জন্য সব সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে।

৩. আক্রান্ত এলাকার প্রত্যেক পরিবারকে প্রাথমিকভাবে ১৫ হাজার লিরা (প্রায় এক লাখ টাকা) নগদ সহায়তা প্রদান করা হবে, যাতে এ অর্থ দিয়ে তারা নতুন বাসায় উঠতে পারেন।

৪. আক্রান্ত এলাকার কোনো পরিবার যদি শহর পরিবর্তন করতে চান, সে ক্ষেত্রে যারা নিজ গাড়িতে যাবেন, তাদের গাড়ির জ্বালানি মূল্য সরকার বহন করবে এবং যারা পাবলিক পরিবহনে যাবেন, তাদের ভাড়া সরকার বহন করবে।

৫. নতুন করে সবকিছু সাজিয়ে তোলার জন্য প্রত্যেক পরিবারকে সরকার এককালীন এক লাখ লিরা (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ছয় লাখ টাকা) প্রদান করবে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ‘আমাদের কোনো নাগরিককে আমরা একা ছেড়ে দেব না’—এ বাক্য দিয়ে বক্তব্যের সমাপনী টানেন। আমি তুরস্কের প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের কিছু অংশ এ জন্যই উল্লেখ করলাম যে একটি দেশের সামাজিক ন্যায়বিচার এবং জনগণের ওপর কি পরিমাণ দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ববোধ থাকলে একটা কঠিন দুর্যোগ ভালোভাবে মোকাবিলা করা যায় তুরস্ক তার অনন্য নিদর্শন।

সরকারি–বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে দুর্গত এলাকার মানুষের পাশে একযোগে এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যেন কেউ উপলব্ধি করতে না পারে যে এ বিপদে সে একা। আমি সরেজমিন দেখেছি, যার নিকট যা আছে তাই বিলিয়ে দিয়েছে আক্রান্ত এলাকার মানুষের প্রতি। দুর্গত এলাকার কেউ একবেলার জন্যও অনাহারে থাকেনি, কাউকে খোলা আকাশের নিচে একদিনও রাত্রি যাপন করতে হয়নি।

দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে আক্রান্ত জনগণের জন্য সরকার সব আশ্রয়কেন্দ্র, স্কুল–কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সব হোস্টেল খুলে দিয়ে সেখানে দুর্গত এলাকার জনগণকে পুনর্বাসন করেছে। টার্কিশ বিমানগুলো দ্রুতগতিতে দুর্গত এলাকার জনগণকে ফ্রি টিকিটে বিভিন্ন শহরে স্থানান্তর করেছে, যা এখনো অব্যাহত আছে। দুর্গত এলাকায় সব ধরনের ট্রান্সপোর্ট ফ্রি করা হয়েছে। শিশুদের কাউন্সেলিং করার জন্য মানসিক চিকিৎসকদলের নেতৃত্বে বিনোদনসহ বিভিন্ন চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সব আহত জনগণের জন্য চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে।

আমরা দেখেছি, আমাদের দেশে করোনার সময় সিলেটের হাজারো রোগীর চিকিৎসক একজন স্বনামধন্য ডাক্তারের পরিবার সামান্য একটা আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স চেয়ে পায়নি। কিন্তু তুরস্কের ভূমিকম্পে আক্রান্ত বাংলাদেশি এক ছাত্র গোলাম সায়ীদ রিংকু ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকার ৪০ ঘণ্টা পর উদ্ধার হলে তাঁকে কাল বিলম্ব না করে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে আঙ্কারার সবচেয়ে বড় হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। দুর্গত এলাকায় অবস্থানরত সব ছাত্রদের উদ্ধার করে আঙ্কারা, ইস্তাম্বুল, কোনিয়া, বুরসাসহ বিভিন্ন শহরে পাঠানো হয়। বাংলাদেশের সব স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশন এবং আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সমন্বিত আন্তরিক সহযোগিতার কারণেই এটি দ্রুত সম্ভব হয়েছে।

এত বড় একটা ভূমিকম্প হলো এবং আজ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার; হয়তো এই সংখ্যা ৫০ বা ৬০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং আহত ব্যক্তির সংখ্যা ১ লাখের ওপরে। কিন্তু তুরস্কের কোথাও মানবিক বিপর্যয় ঘটতে দেখিনি। অর্থাৎ দেশি–বিদেশি বিভিন্ন সহযোগিতায় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার কোনো সংকট এখন পর্যন্ত অনুমিত হয়নি।

দুর্গত এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরকে তাঁদের ইচ্ছেমতো তুরস্কের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রেডিট ট্রান্সফার করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সরকার ছাত্রদের কথা চিন্তা করে তাৎক্ষণিকভাবে আগামী সেমিস্টার অনলাইনের মাধ্যমে হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ সময়ক্ষেপণ করে শিক্ষাব্যবস্থাকে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেয়নি।

এ ভয়াবহ দুর্যোগে পাশে থেকে আমরা তুরস্কের সক্ষমতা, তুরস্কের জনগণের প্রতি জনগণের ভালোবাসা, এখানকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন সংস্থার কার্যকর কর্মক্ষমতা সম্পর্কে যতটা জানতে পেরেছি, বাংলাদেশ বিষয়ে আমি বা আমরা এতটা হয়তো জানি না। যত দূর জানি, বাংলাদেশও ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কিন্তু আমাদের কতটুকু প্রস্তুতি আছে, সেটা সময় থাকতেই মূল্যায়ন করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের কিছু বিষয়ে সজাগ থাকা জরুরি—

-ভূমিকম্পে সহনীয় বিল্ডিং কোড মেনে যেন ভবন নির্মাণ করা হয়।

-ভবন নির্মাণকারী আর তদারকের লোভের মূল্য হচ্ছে লাখ লাখ প্রাণ, যেমনটা আমরা তুরস্কের ক্ষেত্রে দেখেছি।

-ভূমিকম্পসহ জাতীয় যে কোন দুর্যোগ মোকাবিলায় উদ্ধারকর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে প্রয়োজনীয় উপকরণের ব্যবস্থা রাখা।

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় ৭০টি দেশ সব ধরনের সহযোগিতা নিয়ে তুরস্কের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যদিও কেউ কেউ তুরস্কের পাশে দাঁড়ানোর কারণ হিসেবে বর্তমান বিশ্বের রাজনীতিতে তুরস্ক এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের শক্তিশালী অবস্থান ও গুরুত্বের কথা তুলে ধরেছেন। কারণ, যাহোক আমি বলব, বিশ্ব আবারও মানবতার এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের আছে সম্প্রীতি এবং সৌহার্দ্যের দীর্ঘ ইতিহাস ও সংস্কৃতি।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল এখন অবস্থান করছে তুরস্কের দুর্গত এলাকা আদিয়ামান প্রদেশে। আমি কয়েক দিন সেখানেই আছি। বাংলাদেশের টিমের কার্যক্রমের প্রতি স্থানীয় জনগণের মুগ্ধতা ও ভালোবাসার যে নিদর্শন আমি প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে একজন বাংলাদেশি ছাত্র হিসেবে আমি পুলকিত এবং বাঙালি জাতি গর্বিত।

শুধু বাংলাদেশ সরকারই নয়, তুরস্কে অবস্থানরত বাংলাদেশের সব ছাত্র ও বিভিন্ন পেশার জনসাধারণের বিসিটি (Bangladesh Community in Turkey), বাসাত (Bangladesh Student Association in Turkey), বেকদের (Bangladesh Education and Cultural Foundation) সহ সব বাংলাদেশি সংগঠনগুলো এবং আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাস ও কনস্যুলেট অফিস তাদের সর্বশক্তি উজাড় করে দিয়ে তুরস্কের দুর্গত এলাকার জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে।

সব দুর্যোগ থেকে মানুষ শিক্ষা নেয়। আশা করি, বর্তমান ভূমিকম্পের প্রেক্ষাপটে তুরস্কে দীর্ঘদিন ধরে ধীরগতিতে চলা মজবুত ভবন নির্মাণ অনেক গতিশীল হবে। আমি যতটুকু বুঝি, তাতে এ কথা নিশ্চিত বলতে পারি যে ভূমিকম্পের পর তুরস্ক আর আগের মতো নেই।

তবে সরকারের প্রধান লক্ষ্য ও কাজ হবে জরুরি ভিত্তিতে জাপানের মতো একটা অবস্থায় দ্রুত পৌঁছে যাওয়া। আর তুরস্কের সেই শক্তি আছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, প্রয়োজন শুধু সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শক্তভাবে ঘুরে দাঁড়ানো।

লেখক: মুহাম্মদ শামসুজ্জামান খান রাজীব, পিএইচডি–গবেষক, সেলজুক বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্ক।