বিদেশে মা–বাবার সঙ্গে কাটানো কিছু স্মৃতি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মা–বাবাকে নিয়ে বিশ্বের নানা দেশ ঘুরেছি। মজা করেছি। সুইডেনে বসবাস সত্ত্বেও আমেরিকান কোম্পানিতে চাকরি করেছি। বাবাকে নিয়ে একবার ক্যালিফোর্নিয়ায় বেড়াতে এসেছি। সেখানে আমার মেজো বোন জলি থাকে। বাবাসহ আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী মারিয়া এবং ছেলে জনাথান। জনাথানের বয়স তখন চার বছর। লস অ্যাঞ্জেলেসের আর্টেসিয়ায় কেনাকাটা শেষে ঢুকেছি লাঞ্চ করতে। রেস্টুরেন্টে নানা ধরনের খাবার বুফে আকারে দিয়েছে। জনাথান খাওয়ার মধ্যে হঠাৎ বাবাকে প্রশ্ন করল, দাদু তুমিও কি আমার বাবাকে সব জায়গা নিয়ে ঘুরেছ, যেমনটি আমার বাবা আমারে নিয়ে ঘোরে?

 কথাটি শোনার পরে বাবা অবাক না হয়ে কাঁদছেন আর বলছেন, ‘দাদু ভাই, আমি তো তোমার বাবার মতো এত বড় চাকরি করিনি, তাছাড়া বাংলাদেশ একটি গরিব দেশ, সেখান থেকে বিশ্ব ঘোরা কখনো সম্ভব নয়।’

 বাবার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। মাত্র চার বছরের একটি ছেলের কথা এত সিরিয়াস নিলেন, আমি নিজেও বেশ অপ্রস্তুত, কিছুই বুঝতে পারছি না। জনাথানই বা কীভাবে হঠাৎ এমন একটি প্রশ্ন করতে পারল? এদিকে মারিয়া জনাথানকে সঙ্গে সঙ্গে বলল, দাদু তোমার বাবাকে বিশ্ব ঘুরায়নি, তবে যাতে করে তোমার বাবা নিজে এবং আমাদের সবাইকে ঘোরাতে পারে, সে ব্যবস্থা করেছেন।

জনাথান জিজ্ঞেস করল কীভাবে?

 মারিয়া বলল, তোমার বাবাকে সব থেকে ভালো স্কুল, কলেজ এবং বিদেশে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে, যার ফলে তোমার বাবা আজ সারা বিশ্ব ঘুরছে।

 মাত্র চার বছরের ছেলে মায়ের কথার সত্যতা যাচাই করতে সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে জিজ্ঞেস করল, মা যা বলছে তা-কি সঠিক?

 আমি বললাম হ্যাঁ বাবা, তোমার মা যা বলছে, সেটা সঠিক।

 জনাথানের মধ্যে লক্ষ করছে দাদু ভাইয়ের চোখে পানি। সে জিজ্ঞেস করছে দাদু তুমি কি দাদিকে মিস করছ? বাবা উত্তরে বললেন হ্যাঁ ভাই। (প্রসঙ্গত আমার মা তখন সুইডেনে থাকেন। আমেরিকায় আমাদের সঙ্গে আসেননি, মার শরীরটা তখন একটু খারাপ ছিল)।

মা-বাবার ভালোবাসা সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা বাংলাদেশ থেকেই জন্মেছে। পরে নিজে বাবা হয়েছি। জীবনের একটা সময়ে হঠাৎ নিজে অসুস্থ হয়েছিলাম। এ সময়টা ছিল জীবনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তখন পৃথিবীর সবকিছুর ঊর্ধ্বে যাদের নিয়ে বেশি ভেবেছি, তারা ছিল আমার ছেলেমেয়ে। বাবা হয়েছি সেই কারণে বাবাকে আরও বেশি ভালোবেসেছি। আমার ছেলেমেয়ের মাকে যখন দেখি, কী করে আর কী না করে জনাথান ও জেসিকার জন্য, তখন আমি আমার মাকে নিয়ে ভাবি। সত্যিই তো মা-বাবার সব ভালোবাসা তাঁদের সন্তানদের সুখের জন্য। কিন্তু আমরা এতটাই হতভাগা যে তা বুঝি না। যখন বুঝি, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। যাইহোক সে বছরে বাবার সঙ্গে আমেরিকা ভ্রমণের একদিন সবাই ক্যার্লিফোনিয়া ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে ঢুকেছি। স্টুডিও ভ্রমণ শেষে ঢুকেছি ক্যার্লিফোনিয়া ডিজনিল্যান্ডে। বিনোদন পার্ক মানেই হরেক রকমের মজাদার রাইড। বড় ধরনের পার্কগুলোতে আবার থাকে এমন কিছু রাইড যেগুলো শুধু মজার নয়, ভয়েরও। রোমাঞ্চের স্বাদ পেতে অনেকেই সেই রাইডগুলোতে ওঠেন। কিন্তু ওঠার পর আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার উপক্রম হয়। জনাথান কিছু রাইড নিয়েছে এবং ধরেছে আমাকে তার সঙ্গে উঠতে হবে। আমি বেশ ভিতু এসব রাইডে। তাই না করছি এবং বাবা আমার বিষয়টি দেখছেন, পরে ধরেছে দাদু ভাইকে। দাদুভাই একটা রাইড জনাথানের সঙ্গে নিয়েছে। আমি একটু অবাক হয়েছি এবং ভাবছি বাবা জীবনে তো এ ধরনের রাইডে অভ্যস্ত না! পারবেন তো? কোনো ঝামেলা হবে না তো, ইত্যাদি! উঠেছে ফর্মুলা রোসা নামক একটি রোলার কোস্টারে। রোলার কোস্টারের চলন্ত গতি এবং আপ-ডাউন থেকে শুরু করে তুমুল কাণ্ড-কারখানা শুরু হয়েছে, ভয়ে বাবার বারোটা বেজেছে, সম্ভবত বাবা তখন দোয়া-দুরুদ নিয়ে ব্যস্ত। রাইড শেষে বাবা এবং জনাথান ফিরে আসতে পথে জনাথান তার দাদুভাইয়ের সঙ্গে মশকারা করছে, এ সময় দাদুভাই সোজা বাংলায় জনাথানকে বলছে ‘বেয়াদব, এক চড়ে তোর সব দাঁত ফেলে দিব, ইয়ার্কি করো আমার সঙ্গে?’ আমরা তো সবাই নিঃস্তব্দ নীরব হয়ে গেলাম! কী ব্যাপার, বাবা এভাবে খেপলেন কারণ কী? পরে জানলাম ভয়ে বাবার সেদিন বারোটা বেজেছিল। সেদিনের সেই ঘটনটি আজও সবার মনে গাথা। বাবার মুখে ভালোবাসার গালিসহ ভয়ের ছাপ চোখে-মুখে সেদিন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। আমার বাবা যে রাইডে উঠেছিলেন এবং পরে সুইডেনে ফিরে এসে মাসহ বহু পরিচিত, অপরিচিত মানুষের সঙ্গে সে ঘটনাটি শেয়ার করেছেন, যা সত্যি একটি স্মরণীয় ঘটনা। আমার কাছে বাবার সঙ্গে যত সময় কাটিয়েছি, তার মধ্যে এ সময়টি ছিল মধুময়। তারপর কয়েক বছর যেতে মনের আকাশে এসেছিল বৃষ্টি, উঠেছিল কেঁপে মনের ঘর এক প্রচণ্ড দুঃসংবাদে। হৃদয় কেঁপে উঠেছিল ভোর রাতে যখন বাবার টেলিফোনে জানতে পারলাম মা স্ট্রোক করেছেন।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সময়টি হবে ২০০৪ সালের মে মাসে। মা হঠাৎ স্ট্রোক করেন। মার পুরো ডান সাইড পঙ্গু হয়ে যায়, যার ফলে কথা বলা থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়াসহ সব কিছুতেই জটিলতা দেখা দেয়। চিকিৎসার ত্রুটি হয়নি তবুও বয়স এবং শারীরিক দুর্বলতা, সেইসাথে বাংলাদেশে ফিরে যাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা যা সম্ভবত মানসিক দিক দিয়ে আত্মবিশ্বাস হারাতে শুরু করেন মা। বাবা এসময় মার সঙ্গেই ছিলেন। তবে যে রাতে মা স্ট্রোক করেন সেই রাতে সুইডিশ অ্যাম্বুলেন্স এসে মাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়, বাবা সঙ্গে যেতে পারেননি। মা-বাবা তখন থাকতেন স্টকহমের অদূরে অন্য আরেকটি শহর লিনসেপিং-এ। আমি থাকি তখন স্টকহোমে, পরের দিন সকাল ১০টার সময় যখন মার কাছে এসে পৌঁছালাম, দেখি মা রুমে একটি চেয়ারের ওপর বসে আছেন। মার বাম হাতটি ঠিকমতো কাজ করছে, মুখটি বাম হাতটির ওপর হেলান দিয়ে বেশ বিষণ্ন মুখে ফ্যাল ফ্যাল করে জানালা দিয়ে শূন্যতাকে দেখছেন আর হয়তো ভাবছেন, কোথাও কেউ নেই। ঠিক তখনই আমি এসে মাকে জড়িয়ে ধরলাম পেছন থেকে। মা অনুভব করছেন আমি তার ছেলে। পরে মার সামনে দাঁড়ালাম, সে যে কী আনন্দ মার মুখে, শত যাতনা ভুলে মা যেন স্বর্গের মধ্যে, শুধু আমার দেখা পেয়ে। মনে হচ্ছে কত দিন পরে এসেছি, মার বহু কথা বলার আছে কিন্তু কথা বলতে পারছেন না, তবে স্মৃতিশক্তি শতভাগ ভালো। আমি নিজেই মার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলে চলছি। এর মধ্যে নার্স দুপুরের লাঞ্চ নিয়ে এসেছে, তরলজাতীয় খাবার। আমি নিজেই মাকে সেগুলো খেতে সাহায্য করছি। হঠাৎ মা একটি হাঁচি দিয়ে আমার পুরো গা ভরে মুখের খাবারটুকু ঢেলে দিয়ে কি-না বিব্রতবোধ করতে শুরু করলেন। আমি একটু হাসি দিয়ে বললাম ছোটবেলায় আমি যেভাবে তোমাকে কষ্ট দিতাম সেটা বুঝি শোধ দিলে? মা হঠাৎ হেসে দিলেন। সেদিনের সেই মিষ্টি হাসি ছিল আমার দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ হাসি।

আমার চোখে এখনো সেদিনের হাসিভরা মায়ের মুখ ভাসে। আমার মা ৭৮+ বছর বেঁচে ছিলেন। ভালোবাসা আর দয়ার এক স্বর্গীয় প্রতিমূর্তি ছিলেন আমার মা। এখনো সেদিনের কথা মনে পড়ে, তখন আমার বয়স হবে ৮-১০ বছর। ৭১-এ শরণার্থী হয়ে দীর্ঘ ৯টি মাস ছোট ভাই-বোন নিয়ে মায়ের স্নেহতলে দেশ স্বাধীনের চেতনায় এবং তাঁর নেতৃত্বে শিখেছি কীভাবে সমস্যার সমাধান করতে হয়। মা বলতেন, ‘লুজার খোঁজে অজুহাত আর উইনার খোজে সমাধান।’ তখন আমার বাবা এবং বড় তিন ভাই নেই আমাদের মধ্যে, তো কী হয়েছে? মা তো ছিলেন আমাদের সঙ্গে।

 ৭১-এর সময়টি ছিল জীবনের একটি সময় যখন একদিকে মুক্তির সংগ্রাম, অন্যদিকে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। আমার পৃথিবী তখন শুধু মাকে ঘিরে। মায়ের আদরমাখা হাত আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে জীবনে। এখনো মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়, চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। মার ভালোবাসা, তাঁর স্নেহ, তাঁর বিশ্বাস, আমাকে শক্তি দিয়েছে। মায়ের আশীর্বাদ আর সৃষ্টিকর্তার শক্তিতে, ভয়কে জয় করতে শিখেছি জীবনে। মা তুমি ওপারে চিরন্তর ভালো থেকো। আল্লাহ যেন আমাদের সবার মা-বাবাকে সুস্থ রাখেন; এবং যাঁরা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, আল্লাহ তাঁদের যেন বেহেশত নসিব করেন।

 **দূরপরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]