জার্মান ভ্রমণকাহিনি ও কুমড়া প্রতিযোগিতা
জার্মানির লুডউইগসবার্গে আন্তর্জাতিক কুমড়া প্রতিযোগিতার কথা শোনার পর থেকেই আমার কৌতূহল চরমে পৌঁছেছিল। তাই গত ১০ অক্টোবর ২০২৫–এর সকালটা পার করে আমরা স্টুটগার্ট শহর থেকে মাত্র ৪৫ কিলোমিটার দূরে রাজপ্রাসাদের পথে রওনা হলাম, যেখানে হাজারো কুমড়া এবং উৎসবের হুলুস্থুল আমাদের জন্য প্রতীক্ষা করছিল। আমরা পৌঁছে গেলাম আন্তর্জাতিক কুমড়া প্রতিযোগিতায় রাজপ্রাসাদের সামনে। এ বছরের আয়োজন ছিল ২৩ আগস্ট থেকে ২ নভেম্বর ২০২৫ এবং প্রদর্শনীতে ছিল প্রায় ৬০০ ধরনের কুমড়া এবং বিভিন্ন আকর্ষণ।
বাংলাদেশে কুমড়া একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় সবজি। এটি শুধু রান্নার উপকরণ নয়—গ্রামীণ জীবন, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। আমাদের দেশে বিভিন্ন জাতের কুমড়া যেমন—মিষ্টিকুমড়া, জালি কুমড়া, বর্ষা কুমড়া, চালকুমড়া এবং চুনা কুমড়া ইত্যাদি নানান জাতের কুমড়া সাড়া বছর পাওয়া যায়। মোটামুটি কম মূল্যের এই সবজির কদর কতটুকুই–বা আমরা দিয়ে থাকি? কিন্তু জার্মানিতে এর চাহিদা ও কদর দেখে অবাক না হয়ে পারিনি। জার্মানদের ধারণা পাকা কুমড়া নাকি শান্তির প্রতীক আর তাই বিভিন্ন শপিং মলের বড় বড় দোকানের সামনে সুন্দর করে একটি কুমড়া সাজিয়ে রাখা হয়। কুমড়া দিয়ে যে স্যুপ হয়, বিয়ার তৈরি করা হয়, এখানের বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় দেখলাম।
প্রতিবছরের মতো এ বছরও এই কুমড়াকে নিয়ে জার্মানির বৃহৎ আয়োজন ছিল, প্রত্যেকজনকে ২০ ইউরো দিয়ে টিকিট কেটে এই প্রদর্শনীতে ঢুকতে হয়েছিল। আসলে এ দেশের যেকোনো প্রদর্শনীতে ঢুকতে হলে ওদের নির্ধারিত রেটে টিকিট কিনতেই হবে, এটাও ওদের যেন একরকম ব্যবসা।
বিশাল এলাকাজুড়ে কেবল বিভিন্ন সাইজের কুমড়া দিয়ে সাজানো আন্তর্জাতিক পামকিন ফেস্টের আসর। ১৬ শতাব্দির রাজ প্রাসাদের সামনে এ প্রতিযোগিতার আয়োজন চলছে।
দূর পরবাস-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
কুমড়ার উৎপত্তি প্রায় সাত হাজার বছর আগে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় বলে ধারণা করা হয়। মেক্সিকোতে পাওয়া প্রাচীন কুমড়ার বীজ প্রমাণ করে যে সেই সময়ের মানুষ এটি খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করত।
১৫ শতকে ক্রিস্টোফার কলম্বাস ও অন্যান্য ইউরোপীয় অভিযাত্রী যখন আমেরিকায় পৌঁছান, তাঁরা কুমড়াকে ইউরোপে নিয়ে যান। এরপর ধীরে ধীরে কুমড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ফসলে পরিণত হয়। উত্তর আমেরিকায় কুমড়া সংস্কৃতি ও উৎসবের অংশ হয়ে ওঠে—বিশেষ করে থ্যাংকসগিভিং ও হ্যালোইন উৎসবে। স্থানীয় আদিবাসীরা কুমড়া খাবার, সংরক্ষণ পাত্র ও ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করত। পরে ইউরোপীয় বসতিরাও কুমড়া দিয়ে পাই ও স্যুপ তৈরি করতে শেখে। বর্তমানে কুমড়া বিশ্বের প্রায় সব দেশেই উৎপাদিত হয়। এটি শুধু খাদ্য নয়, সাজসজ্জা, উৎসব ও শিল্পকর্মের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
এ বছর ২০২৫ সালে লুডউইগসবার্গ, জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বড় কুমড়া ওজন প্রতিযোগিতার তিনজন বিজয়ীদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন অস্ট্রিয়ার ওলফগাং নিত্তেনাওস, যাঁর কুমড়ার অজন ছিল ৯৯৮/৫ কেজি, দ্বিতীয় স্থান জার্মানির ওলিভার গ্রাফের, কুমড়ার ওজন ৮৩৬/৫ কাজি এবং তৃতীয় স্থান অধিকার করেছেন জার্মানির ডেভিড ফ্রোমমেল্ট, যাঁর কুমড়ার ওজন ছিল ৭৯৯ কেজি।
এই অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করল। কুমড়া শুধু খাদ্য নয়, এটি সংস্কৃতি, উৎসব এবং মানুষের সৃজনশীলতার প্রতীক। আমরা ফিরে এলাম আনন্দ ও বিস্ময়ে ভরপুর, হাতের মধ্যে স্মৃতি ও মোবাইলে ছবি নিয়ে।
লেখক: শাহ জালাল ফিরোজ, স্টুটগার্ট, জার্মানি