আমরা কেন ভিক্ষা করি: সাংস্কৃতিক নির্ভরতা এবং সুবিধাভোগী
আমি আমার মাস্টার্স শেষ করে প্রথম কাজে নিযুক্ত হই ইউনেসকোর সংস্কৃতি বিভাগে। আমার উদ্দেশ্য ছিল সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ নিয়ে কাজ করা। কিন্তু যেহেতু আমি সংস্কৃতি বিভাগের প্রোগ্রাম অফিসার, তাই আমাকে অন্য সব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য–সম্পর্কিত (Cultural Heritage) প্রকল্প দেখভাল করতে হতো। আপনারা জেনে অবাক হবেন, জাতিসংঘের মধ্যে ইউনেসকো একমাত্র সংস্থা, যেখানে সংস্কৃতি নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা হয়। তারপরও দুঃখের বিষয়, সংস্কৃতি সব থেকে কম অর্থায়িত এজেন্ডা!
আমরা যাঁরা বাংলাদেশে বড় হয়ে উঠেছি, তাঁরা সাধারণত সংস্কৃতি মানে বুঝি চাক্ষুষ নাচগান, সাহিত্য ইত্যাদি। কিন্তু যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (Intangible Cultural Heritage) অথবা আইসিএইচ। আমাদের মতো প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পদপূর্ণ সম্প্রদায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার মূলে আসে এই অধরা মূল্যবোধ। ইউনেসকোর সংজ্ঞা অনুযায়ী, এ মূল্যবোধ বলতে বুঝি অনুশীলন, উপস্থাপনা, অভিব্যক্তি, জ্ঞান, দক্ষতা—যেটা সম্প্রদায়ভিত্তিক ক্ষমতায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আমি আমার দীর্ঘ কর্ম ও গবেষণাজীবনে সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়ন ও সুবিধা বিতরণ নিয়ে অনেক কাজ করেছি। আমি অনেক দীর্ঘ সময় নিয়ে ভেবেছি যে আমাদের এত প্রাকৃতিক সম্পদ, তারপরও কেন ভিক্ষা করি? বিশেষ করে যতবার বাইরে যাই, কনফারেন্স অথবা সেমিনারে সর্বত্র এই বলে শুরু করতে হয় যে আমরা একটি ‘ভিখারি’ দেশ! সত্যি বলতে কি, তখন আমার আর সেমিনারে থাকতে মন চায় না।
আমাদের মতো বর্ধিত পরিবারভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় কীভাবে অর্থনৈতিক বণ্টন হয় এবং কীভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, সেটা বোঝা খুব জরুরি। আমাদের পরিবারপ্রথা বাবাভিত্তিক এবং উনি পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী। আমাদের মুসলিম আইনে ছেলেরা যেহেতু দুই–তৃতীয়াংশ পান, তাই তাঁদের বর্ধিত পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়। আমরা যেহেতু ছোটবেলা থেকে জানি, টাকাপয়সার দায়িত্ব আব্বার, তাই আমরা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোনো উপার্জনের চেষ্টা করি না। আমাদের বয়সভিত্তিক দক্ষতা এবং উপার্জনের কোনো প্রশিক্ষণ নেই। শুধু তা–ই নয়, আমরা ঘরোয়া কোনো কাজে মাকে সাহায্য করি না। আমাদের ধারণা, ঘরোয়া দায়িত্ব সব মায়ের আর গৃহকর্মীর। ফলে আমরা স্কুলভিত্তিক মুখস্থবিদ্যা ছাড়া কোনো প্রকার ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জন করতে পারি না।
আমাদের পরিবারে মায়েরা হাড়ভাঙা খাটুনি করলেও কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিতে পারেন না। এর প্রভাব সরাসরি ছেলে–মেয়েদের ওপর পড়ে, বিশেষ করে সম্পদ বিতরণ এবং নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারে। মেয়েদের যেহেতু কোনো অর্থনৈতিক দায়িত্ব নেই, তাই তাঁরা নিজেদের ক্ষমতায়নের ব্যাপারে দায়িত্বশীল নন। কীভাবে পরিবারের সঙ্গে সমন্বয় করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, এমন কোনো মানসিক ও শারীরিক প্রশিক্ষণ নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মায়েরা ভাবেন, তাঁর সন্তানকে তাঁর ওপর নির্ভরশীল করে রাখা, যাতে তিনি তাঁর ছেলে–মেয়ের ওপর আধিপত্য রাখতে পারেন। পারিবারিকভাবে নির্ভরশীল এসব ছেলে–মেয়ে পড়ালেখায় ভালো করলেও কখনো পরিবার ও কর্মজীবন সমন্বয় করে চলতে পারেন না। আমি যখন অস্ট্রেলিয়াতে পিএইচডি করছি তখন দেখেছি, বাংলাদেশি ছাত্রদের বেহাল। পরিস্থিতি এমনই যে পিএইচডির প্রথম বছর শেষ না করতেই তাঁরা বাংলাদেশ থেকে বিয়ে করে নিয়া যান এবং সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব বউটির মাথার ওপর চাপিয়া দেন। শুধু অস্ট্রেলিয়া নয়, কানাডাতেও একই সুবিধাভোগী সিস্টেম, যার জন্য অনেক নারী ধুঁকেন, বিশেষ করে কর্মজীবী!
আমাদের পারিবারিক সংস্কৃতিতে উপার্জনকারী বাবা ছাড়া আর কারও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই। আমরা যেহেতু কথা বলতে শিখি না, তাই আমরা বড় হওয়ার পরও কীভাবে সিদ্ধান্ত দেব, সেটা বুঝে উঠতে পারি না। অধিকাংশ সময় আমরা কাচুমাচু করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। আমাদের বাবা-মা যত দিন বেঁচে থাকেন, তত দিন অবসর নিতে চান না। আমি খেয়াল করেছি, এর প্রভাব সমাজ এবং রাষ্ট্রের ওপর। আমাদের দেশ চালান সরকারি কর্মকর্তা, পেশাজীবী এবং রাজনৈতিক নেতা—কেউ অবসর নিতে চান না। এর ফলে অপেক্ষাকৃত তরুণেরা কখনো নেতৃত্বে আসতে পারেন না।
আমাদের খাতাকলমে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার বয়স ১৮ থাকলেও আমরা অনাদিকাল বাবার ওপর নির্ভরশীল থাকি। বাবা আমাদের পড়ালেখা শেষ করাবেন, চাকরি খোঁজ করে দেবেন এবং তারপর বিবাহের ব্যবস্থা করবেন। আমাদের মতো গরিব একটা দেশের যেখানে অধিকাংশ মানুষ নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র, সেখানে বাবা দুই–তৃতীয়াংশ সম্পত্তি বলে কিছু থাকে না। এমনকি মধ্যবিত্তদের অবস্থা শোচনীয়—চাকরির ধরাবাঁধা টাকাই তাঁদের বউ–বাচ্চা, মা–বাবা, ভাই–বোন ও আত্মীয়স্বজন—সব সামলাতে হয়। আমাদের পরিবারভিত্তিক কোনো সঞ্চয় প্রকল্প নেই, যার কারণে অনেকে সব খরচ করে আবার হাত পাতেন। ছোটবেলা থেকে আমাদের বাজেট করা এবং খাতভিত্তিক অগ্রাধিকার দিয়ে সঞ্চয় করা শেখানো হয় না। আমি অধিকাংশ ছেলেকে দেখেছি, তাঁরা সঞ্চয় করতে পারেন না এবং ধার করে বর্ধিত পরিবার চালাচ্ছেন। পরিবার ছাড়াও আমাদের অঞ্চলভিত্তিক অনেক ধরনের অতিথেয়তা ও প্রোটোকল আছে। যেমন বিয়েতে যৌতুক, ইফতারি, জামাইষষ্ঠী, আম–কাঁঠাল এবং ঈদের পরব। প্রায় প্রতিটি পারবে বিবাহিত মেয়ের বাড়িতে অনেক ধরনের জামাকাপড়, খাদ্য ও টাকাপয়সার লেনদেন থাকে। আমার মনে হয়, আতিথেয়তার নামে সীমাহীন খাদ্য ও পয়সাকড়ি খরচ আমাদের সামাজিক নিরাপত্তাকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিচ্ছে।
আমরা আর শায়েস্তা খাঁর যুগে নেই, যেখানে এক টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। আমাদের মাথায় সীমাহীন ঋণের বোঝা এবং আমরা ভিক্ষা করাকে মর্যাদার মনে করি। আমাদের সংবাদপত্রের শীর্ষ শিরোনাম, কোন দেশ কত ‘ভিক্ষা’ দিচ্ছে। আমাদের একটি প্রকল্প নিতে হবে, যেটির নাম হতে পারে ‘ভিক্ষার জন্য মরব না!’ এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হবে, পরিবারভিত্তিক ভিক্ষা বন্ধ করে সাংস্কৃতিকভাবে স্বতন্ত্র ও সমষ্টিগত ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা। পরিশেষে আমাদের জানতে হবে, কাউকে সাহায্য করা আর ভিক্ষা করা দুটি ভিন্ন বিষয়।
*লেখক: শাহিদা খানম, পিএইচডি, বোর্ড মেম্বার, প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন, কানাডা