ডা. জাফরুল্লাহ স্মরণে
হিথরো বিমানবন্দরে সেবার আট ঘণ্টা ট্রানজিট লাউঞ্জে থাকতে হয়েছিল। বিরক্তি নিয়ে ভাবছিলাম আবারও হয়তো সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে করতে ঢাকায় ফিরব। হঠাৎ দেখি পরিচিত চেহারা। নারীপক্ষ নেত্রী শিরিন হক তাঁর ছোট্টবাবু বারিশকে বুকে ঝুলিয়ে হেঁটে হেঁটে আসছেন, পেছনে স্বামী বীরমুক্তিযোদ্ধা ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও। সেবারই প্রথম জাফরুল্লাহ ভাইয়ের সঙ্গে মুখোমুখী আলাপ। শিরিন হককে সেমিনার, ওয়ার্কশপ, রাজপথে অধিকার আদায়ের সুহৃদ হিসেবে সব সময় পেয়েছি। ওদের সঙ্গে গল্প হলো। জানলাম ওরা দিল্লিতে নেমে যাবে। আমি এসেছি নিউইয়র্ক থেকে। কথার মধ্যে নিউইয়র্ক থেকে প্লেনে সিটটা স্মোকিং জোনের কাছে থাকার বিষয়টাও জানালাম। তাতে ধোঁয়ায় কষ্ট পেয়েছি শুনলেন। আরও বললাম হয়তো আমার চামড়ার রঙের জন্যই সিটটা ওই রকম জায়গায় দিয়েছিল। তখন ডা. জাফরুল্লাহ ভাই চমৎকার এক বুদ্ধি দিলেন। তাঁর দেওয়া পরামর্শমতো ঢাকার পথে বোর্ডিংপাস নেওয়ার সময় মেয়েটিকে জানালাম, ‘আমার সিটটা স্মোকিং জোন থেকে যত দূরে সম্ভব দিতে হবে। কারণ, ধোঁয়াতে আমার ব্রিদিং প্রবলেম হয়।’ মেয়েটি চোখ বড় করে আমাকে দেখল। বোর্ডিংপাস লিখতে লিখতে বলল, একবার এক যাত্রীর অ্যাজমার কারণে মাঝপথে প্লেনকে অন্যখানে নামতে হয়েছিল।
অ্যাজমা যে এত বড় এক বিষয় আমার জানা ছিল না। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ডাক্তার মানুষ তো বুদ্ধিটা রোগবিষয়ক এবং একেবারে জিন বশ করার মতো শক্ত মন্ত্র বা দোয়ার মতো কাজ করেছিল তখন। এখন তো প্লেনে সিগারেটই নিষেধ।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে অনেক গুণীজনেরা বলছেন। দেশের প্রশ্নে কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলেননি। স্পষ্টভাষী ও মানুষকে তোয়াজ, তোষামোদ করা তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল না। দেশের ডাকে বিলাতের উচ্চশিক্ষা ও বর্ণিল বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ছুটে আসেন। গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শেষে প্রবাসী সরকারের অনুরোধ, দাবি বা প্রয়োজন অনুসারে রণাঙ্গনে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা দিতে ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তুলেন। এই কর্ম চিকিৎসক যোদ্ধার অসাধারণ কৃতিত্ব।
দেশ স্বাধীন হলে উচ্চশিক্ষার ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে দেশের দরিদ্র মানুষকে সেবা দিতে মনস্থির করেন। এ বীর মুক্তিযোদ্ধা জাফরুল্লাহর কাজের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আস্থার কারণে সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য জমি দেওয়া হয় তাঁকে। তারপরের খবর সবার জানা। সাধারণ মানুষের জন্যই মাটির কাছাকাছি ঢাকার বাইরে প্রতিষ্ঠান। এর জন্য আরও মূল্য উনি দিয়েছেন। দেশে থাকবেন গ্রামে কাজ করবেন তাঁর বিদেশি স্ত্রী এই জীবন মেনে নিলেন না। চলে গেলেন উনি। দেশভক্ত, একরোখা, জেদি জাফরুল্লাহ ভাই থেকে গেলেন এই বাংলায়। পরে ওনার জীবনসঙ্গী হয়েছেন তেমনি একজন, যার মানুষের জন্য, নারীদের প্রতি রয়েছে গভীর সহমর্মিতা তিনি শিরিন হক।
আমেরিকান এয়ারলাইনসে অবহেলার শিকার এক বাদামি চামড়ার মহিলা আর মানুষকে সম্মান দিতে জানা ইরিনার কথা বলি। বিষয়টা অপ্রাসঙ্গিক নয়। ইউক্রেনের খারকিভ শহর থেকে সে এসেছেন। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ইরিনা খারকিভের এক ফ্যাক্টরির ডিরেক্টর ছিলেন। এই দেশে এসে নতুন বিদ্যা কেশবিন্যাস শিখেছেন। ধীরে ধীরে সে এখন ভালো একটি হেয়ারড্রেসিং দোকানের মালিক। তাঁর কর্মী সংখ্যা হবে আট–নয়জন। তাঁর নেতৃত্বের ক্ষমতা বেশ সহজাত। নিজ দেশে যেমন ছিল কারখানার পরিচালক, এখানেও সে নিজ ব্যবসার মালিক-পরিচালক।
প্রায় পাঁচ ফুট সাত–আট ইঞ্চি লম্বা সুস্বাস্থ্যে ও সুষমায় ভরপুর প্রাণবন্ত মাঝবয়সী রুশ নারী যদিও ইউক্রেন থেকে এসেছেন, তবে জাতিতে সে ‘রুস্কাইয়া, (নি ইউক্রেন’) ইরিনা। খুব যত্নে আমার মাথা ধোয়ানো শেষে ভেজা চুলে যখন তোয়ালে জড়াচ্ছিল, আমি ওকে আচমকা এক প্রশ্ন করে বসলাম—
‘তোমার কি বিরক্তি লাগছে?’
‘নাহ কেন?’
দ্বিধা নিয়ে বললাম—
‘মানে বলছিলাম কি এই যে তুমি এত আন্তরিকভাবে আমার চুল ধুয়ে দিয়েছ, বাদামি চামড়ার এশিয়ান, কালো চামড়ার আফ্রিকান মানুষও তোমার কাস্টমার। তাই ইচ্ছা হলো জানতে নানা জাতের, নানা বর্ণের মানুষের চুলের যত্ন করতে তোমার খারাপ লাগে কি না;
‘খারাপ লাগার কি আছে? সাদা–কালো তাতে কি, মানুষ তো সবাই। তাই না?’
‘শোন, আমি দেখেছি বিলাত আমেরিকায় কখনো কখনো অনেক সাদা মানুষই কালো ও বাদামি চামড়ার মানুষের দিকে কেমন বিতৃষ্ণা নিয়ে তাকায়, তাঁদের আচরণে অবজ্ঞা মেশানো থাকে তাই কথাটা বলা।’
‘শোন, রাশিয়ার কখনো কলোনি ছিল না’
‘তো?’
‘তাই তারা কোনো দিন কলোনির প্রভুর চোখে বাকি সব মানুষদের দেখতে শিখেনি; যার ফলে একদল আরেক দলকে ঘেন্না করার অভ্যাসটাই গড়ে ওঠেনি। আরেকটা বিষয়ও সত্য—কলোনির বাসিন্দারাও সাদাদের ভালো চোখে দেখে না, অবশ্য এই না দেখার পেছনে কারণ হলো কলোনির বাসিন্দাদের প্রতি কলোনির মালিকদের দীর্ঘদিনের অত্যাচার ও অপমান করার জঘন্য ইতিহাস।’
ওর কথাটা আমাকে ভাবতে বাধ্য করল। আমি রাশিয়াতে (সঠিক হবে বলা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে) পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছিলাম, তখন তেমন কোনো বর্ণ বিদ্বেষ চোখে পড়েনি ওখানে। বাকি দুই দেশে কালো ও বাদামি চামড়ার মানুষের প্রতি কোনো কোনো সাদা মানুষের (সব সাদা মানুষের নয়) বিতৃষ্ণা ও অবজ্ঞা লক্ষ করেছি।
একবার আমেরিকান এয়ারলাইনসের নিউইয়র্কের জেএফকে এয়ারপোর্ট থেকে লন্ডনের হিথরোগামী প্লেনে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেটা মনে পড়ল। প্রথমত, আমি চেয়েছিলাম নন-স্মোকিং জোনে সিট। তখন সিগারেট খাওয়া যেত। প্লেনে ঢুকে বসতে গিয়ে দেখি, আমার সিট ২৮ নম্বর সারিতে। পরের সারি ২৯ নম্বর থেকেই শুরু হয়েছে স্মোকিং জোন। বড় প্লেনের আগের সারিগুলোয় অনেক সিটই খালি রয়েছে দেখলাম। আমি বিরক্তি নিয়ে আমার নিজের সিটে গ্যাট হয়ে বসে নিউইয়র্ক থেকে লন্ডন নন-স্টপ উড়াল যাত্রায় আরও কিছু বিষয় খেয়াল করলাম। সাদা মানুষ বোতাম টিপে কেবিন ক্রুকে ডেকে কিছু চাইলে চট করে এনে দিচ্ছে, একজন সাদামাটা নিরীহ এশিয়ান (উপমহাদেশীয় অর্থাৎ ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের কোন একটির হবে) নারী পানি চেয়ে তিন তিনবার বোতাম টিপলেন, কেবিন ক্রু এলেন, শুনলেনও। তারপর উধাও হয়ে যায়। পানি নিয়ে আর ফেরত আসে না। প্লেনে মানুষ ডিহাইড্রেটেড হয় খুব, তাই পানির পিপাসা পাওয়া খুব স্বাভাবিক। চতুর্থবার আমি বোতাম টিপলাম। কেবিন ক্রু এলেন। সিট নিয়ে বিরক্তি তো ছিলই আমার, সে কারণে বোধ হয় গলা চড়িয়ে কেটে কেটে জানতে চাইলাম—
‘হোয়াটস রং উইথ ইয়োর আমেরিকান এয়ারলাইনস?’ বলেই আমি থামলাম
তটস্থ বিব্রত গলায় সে বলল, ‘সরি!’।
‘লুক, দ্যাট লেডি থ্রি টাইমস আস্কড ফর ওয়াটার বাট শি ওয়াজন্ট সার্ভড?’
আমার ধীর স্বরে উঁচু গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলা কথায় আশপাশের সবাই সতর্ক চোখে তাকাল। সবার দৃষ্টিবাণে ম্রিয়মাণ হোস্টেসটি কেমন নার্ভাস গলায় বলল—
‘সরি, প্রবাবলি হার ইংলিশ ওয়াজ...
ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম—
‘লিসেন, তুমি আমার ইংলিশ বুঝতে পারছ তো?’
‘তোমারটা ফাইন ম্যাম’
‘সে–ও আমার মতোই বলেছে, আর শোন, প্যাসেঞ্জারের মুখের কথা যদি বুঝতে কষ্ট হয়, তবে হোস্টেস হিসেবে কাজ করা কি উচিত?’
আমার প্রশ্নের বাণে বিদ্ধ হয়ে সে
‘সরি!, সরি! এখনই পানি নিয়ে আসছি’
বলেই ছুটল। পানি নিয়ে যখন ফিরল, মেয়েটির পেছন পেছন ওর বসও এল। আমাকে বস বলল—
‘এই ইনসিডেন্টের জন্য আমরা রিয়েলি সরি! তুমি কি কমপ্লেইন করবে?’
‘নাহ তবে আমি ফ্রিল্যান্স রাইটার, এটা নিয়ে হয়তো পেপারে লিখতে পারি’
ওর মুখ ভীত দেখাল। পেপারে লেখালেখি হলে ওদের পেটে লাথি পড়বে, তাই ওরা ভয় পায়।
ইরিনাদের দেশে সেই সময়ে মার্কস লেনিনের মানবমুখী নীতি চর্চার ফলে মানুষকে অবজ্ঞা-অবহেলা-অপমান করার প্রবণতাটা ছিল না। তবে অন্য চামড়ার মানুষকে প্রথম দেখলে বিস্ময় আর কৌতূহল যে হতো না, তা নয়। স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা ঘৃণা নয় অবশ্যই। তেমনি এক কৌতূহলী বাচ্চা মেয়ের কাণ্ড শুনে আমরা খুব হেসেছিলাম।
এক অ্যাগ্রিকালচারাল কালেক্টিভ ফার্মে নানান দেশের ছাত্ররা এক্সারসনে গিয়েছে। ওই এলাকার মানুষ আগে কখনো কালো বা বাদামি চামড়ার মানুষই দেখেনি। ছোট্ট একটি মেয়ে শেষ পর্যন্ত কৌতূহল মিটানোর জন্য চট করে মায়ের হাত ছেড়ে ছুটে এসে একজন ভিনজাতি মানুষের হাতের পিঠে আঙুল ঘষে আঙুলটাতে গায়ের রং উঠে এসেছে কি না দেখছিল।
তখনকার ইরিনার দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নে জৌলুসের ছড়াছড়ি ছিল না ঠিকই, তবে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব দ্রব্যাদি ও বাস, ট্রেন ও প্লেনের ভাড়া ছিল খুব সস্তা। সবচেয়ে বড় কথা, সবার জন্য শিক্ষা ও চিকিৎসা ছিল নিশ্চিত। তবে হাস্যকর হলেও দাঁতমাজার জন্য ভালো টুথপেস্ট, গায়ে মাখার ভালো সাবান, চুল ধোয়ার ভালো শ্যাম্পু ছিল না।
রাষ্ট্রের একদিকে সাবমেরিন, কালাশনিকভ, মহাশূন্যযান, পরমাণু বোমা বানানোর অসাধারণ দক্ষতা থাকলেও ভালো টুথপেস্ট, গায়ে মাখার ভালো সাবান ও শ্যাম্পু তৈরির চেষ্টা ছিল না। অন্যদিকে ব্যক্তিগতভাবে কেউ উদ্যোগী হয়ে কোনো কিছু উৎপাদন করার উপায় ছিল না। কারণ, সমষ্টির স্বার্থে ব্যক্তিমালিকানা পুরোপুরি উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এককথায় জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ—সব কাজ রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিয়ে করতে হতো। জনসাধারণের জন্য শিক্ষা, চিকিৎসার নিশ্চয়তা ও কর্মসংস্থান করার পর এবার আত্মরক্ষার জন্য রাষ্ট্র সমরাস্ত্র বানাবে না কি জনগণের জন্য ভালো টুথপেস্ট, ভালো সাবান, ভালো শ্যাম্পু বানাবে? কোনটা করবে? ভেবেচিন্তে অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে রাষ্ট্রের সমরাস্ত্র বানানো ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে গুঁড়িয়ে দিতে অনেকবার দেশটিতে আক্রমণ চালানো হয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে উৎপল দত্তের লেখা ‘প্রতিবিপ্লব’ নামে একটি নাতিদীর্ঘ বই রয়েছে।
তবুও যদি সীমিত আকারে ও রাষ্ট্রের গভীর পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে রেখে ব্যক্তি উদ্যমকে অনুমোদন ও উৎসাহ দিলে হয়তো–বা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো সৎ, নিঃস্বার্থ ও উদ্যমী মানুষেরাই সাবান, শ্যাম্পু ও টুথপেস্ট বানাতেই পারত, মানুষের প্রয়োজনও মিটত। সবচেয়ে বড়কথা রাষ্ট্রকে তুচ্ছ বিষয়ে মাথা ঘামাতে হতো না।
ইরিনার সঙ্গে এসব নিয়ে কোনো কথা বলিনি, বন্ধুমানুষ পাছে কষ্ট পায়। মানুষ কথা বলতে পারত না, কথা বলার স্বাধীনতা একেবারেই ছিল না সোভিয়েত ইউনিয়নে বিষয়টা একশত ভাগ সত্যি নয়। সেই সময়েই পড়েছি ও দেখেছি ওদের কমসোমলস্কায়া প্রাভদা পত্রিকাতে (তরুণদের পত্রিকা) তরুণেরা প্রশ্ন তুলেছে, তর্কবিতর্ক করেছে যে তাদের দেশে যখন চুইংগাম, জিনসের (লিভাইস আর টেক্সাস জিনসের জন্য পাগল ছিল তখন ওরা) মতো সাধারণ জিনিস পাওয়া যায় না, তখন তারা কেন মহাশূন্য অভিযানে এত এত অর্থ খরচ করছে।
ব্যক্তিমালিকানা উচ্ছেদ হলেই মানুষের সার্বিক মঙ্গল সাধন সম্ভব—এ চিন্তা থেকেই শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন দেখা। সোভিয়েত সমাজব্যবস্থা, ব্যক্তি নয়, সমষ্টির মঙ্গলে ব্রত এক সমাজব্যবস্থা। সে ব্যবস্থা ১৯৯২ নাগাদ ভেঙে পড়ল। সেই সময় ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে কোন এক সংখ্যায় ‘সানন্দা’ পত্রিকার সম্পাদক চিত্রশিল্পী ও গুণী চিত্রনির্মাতা অপর্ণা সেন তাঁর সম্পাদকীয় কলামে লিখেছিলেন, ‘সমাজতন্ত্র ভেঙে গেল মানুষের ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠার স্বপ্ন ভেঙে গেল’। বাক্যটি অসম্ভব সুন্দর অস্বীকার করা যাবে না। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ব্যতিক্রম ছিলেন, নিজ স্বার্থকে কখনোই প্রাধান্য দেননি। মানুষ আছে নিঃস্বার্থ, তবে কয়জন তাঁর মতো নিজ মেধা ও উদ্যমকে ক্লান্তিহীনভাবে অতি সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছেন?
যে মানুষের কথা ভাবে মানুষও তাঁকে ভালোবাসে।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কোভিড ধরা পড়ল। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সব মানুষ তাঁর খোঁজখবর নিচ্ছেন, যখন–তখন অতি সাদামাটা একজন গৃহিণী সুদূর সিলেট থেকে জানালেন যে উনি জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্য দুই রাকাত নফল নামাজ পড়েছেন। ভদ্র মহিলার স্বামী কিডনি রোগে মারা গিয়েছিলেন।
আর ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যে গরিবদের সেবা দেন। গরিব কিডনি রোগীদের বিনা খরচায় বা সামান্য খরচায় ডায়ালাইসিসের মতো মূল্যবান চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন।
ঢাকা থেকে গতকাল মানে ১২/০৪/২০২৩–এ এক তরুণী মেসেজ পাঠিয়েছে
‘উনি আমার চোখে সুন্দর একজন মানুষ। আমরা শুধু আপনজনদের ভালোবাসি আর উনি ভেদাভেদ না করে গরিব মানুষের কথা ভেবেছেন, তাঁদের ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁকে কখনো আমি সামনাসামনি দেখিনি, তবু গতকাল (১২/০৪) ওনার জন্য খুব কষ্টে কেটেছে। আমি সব সময় নামাজে প্রথমে আমার বাবার আত্মার জন্য দোয়া চাই। গতকাল ওনার জন্য প্রথমে দোয়া চেয়েছি। এখন থেকে রোজ বাবার সঙ্গে উনিও আমার দোয়ায় থাকবেন।’
জাফরুল্লাহ ভাই আপনি আজ আর এই পৃথিবীতে নেই, কোনো দিন জানতেও পারবেন না ওই তরুণীর মতো কত মানুষের আন্তরিক প্রার্থনায় আপনি আছেন ও থাকবেন। হয়তো ওই সব মঙ্গল বার্তা আপনার কাছে অলৌকিক আলো হয়ে পৌঁছবে।