সোলসের সাথে এক নস্টালজিক যাত্রা
লন্ডনে সেপ্টেম্বর মানে শরতের শুরু। শিউলি ফুলের দেখা এখানে না মিললেও কোথাও কোথাও কাশবনের দেখা পাওয়া যায়, তবে সাথে থাকে ঠান্ডা হাওয়া। বৃষ্টির কথা আর না–ই বললাম, লন্ডনে বছরের যেকোনো মাসে অনাহুতের মতো এর উপস্থিতি থাকবেই। এ রকম আটপৌড়ে কোনো কোনো সন্ধ্যাও বিশেষ কিছু হয়ে যায়, যখন লন্ডনের মে ফেয়ার ভেন্যুতে ‘গানে গানে বাংলাদেশ’ নামের এক কনসার্টে গান শোনার সুযোগ হয় বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড সোলস, রেনেসাঁর নকিব খান, অরবিটের পলাশসহ অন্য অনেক গুণী শিল্পীর।
অর্ধশতাব্দী পুরোনো সোলসের লন্ডনে আসা এটাই প্রথম নয়। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যার জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশে টি এন টি আয়োজিত এই কনসার্টে তাদের এবারের আসা। সোলসের পার্থ বড়ুয়া জানালেন, এই কনসার্টে সোলস কোনো টাকা নিচ্ছে না বরং ফান্ড কালেকশনের জন্য সোলস তাদের একটি গিটার নিলামে বিক্রি করছে, যা থেকে পাওয়া সব টাকাই বন্যার্তদের জন্য দান করা হবে।
সোলস শুধু একটি ব্যান্ড নয়, একটি আবেগ, যারা আমাদের শৈশবের প্লে লিস্টে রাজত্ব করেছিল। তবে এখনকার মতো ইউটিউবে কয়েক মিনিটের বানানো প্লে লিস্ট নয়। আমরা হচ্ছি সোনালিফিতার ক্যাসেটের যুগের লোক। TDK ৬০ মিনিটের ক্যাসেটে এপিঠ–ওপিঠ মিলে ১০টি গানের জায়গা হতো। পছন্দের ১০টি গান সিলেক্ট করে ক্যাসেটের দোকানে গিয়ে অর্ডার করতে হতো। এক সপ্তাহ পর ক্যাসেটটি পাওয়ার পর শুধু নিজের পছন্দের গানগুলো নিরবিচ্ছিন্নভাবে শোনা যেত। আর শুধু শৈশবের প্লে লিস্ট বললে ভুল বলা হবে, আমাদের অনেকের গাড়ির মিউজিক পেনড্রাইভে সোলসের বা বাংলাদেশের ব্যান্ডের গান না থাকলে তা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে স্থানীয় শিল্পীদের গানের পর মঞ্চে আসেন নব্বই দশকের জনপ্রিয় ব্যান্ড অরবিটের গায়ক পলাশ। তার জনপ্রিয় ‘ওই লাল শাড়ি রে’ গান গেয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেন।
অবশেষে রাত ৯টার পর ‘এ এমন পরিচয়’ দিয়ে সোলস তাদের গান শুরু করে। সোলস তাদের ভক্তের হৃদয়ে যেভাবে পঞ্চাশ বছর ধরে আছে, সেটা তো আসলেই ভালোবাসার এক দৃঢ় বন্ধন। এখানে ফর্মাল কোনো কথার দরকার পড়েনা, এটা শুধুই হৃদয়ের অনন্তে অজানা এক ভালো লাগা।
পার্থ বড়ুয়া সোলসের কয়েক দশকের জনপ্রিয় গান একের পর এক শুনিয়ে যাচ্ছিলেন। দর্শকদের সঙ্গে সঙ্গে সোলসও যেন নস্টালজিক হয়ে পড়েছিল ফেলে আসা সময়ের গানগুলো গাইতে গাইতে। আর তাই সোলস তথা বাংলা ব্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সেরা গান ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ গাইতে গাইতে পার্থ বড়ুয়া মঞ্চে ডেকে নিয়ে আসেন এই গানের গীতিকার সোলসের সাবেক সদস্য নকিব খানকে। দর্শকদের তুমুল করতালিতে নকিব খান মঞ্চে এসে গানটি শেষ করেন।
নকিব খান বর্ণনা করেন সুরেলা ব্যান্ড থেকে ১৯৭৪ সালে কীভাবে সোলসের জন্ম হয়। গানের ফাঁকে ফাঁকে বলে যাচ্ছিলেন বিভিন্ন গানের প্রেক্ষাপট। ভাবতে অবাক লাগে এই গানগুলো তিনি লিখেছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময়। সোলসের ‘মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে’, ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’ গাওয়ার পর তিনি গাইলেন তাঁর নিজের ব্যান্ড রেনেসাঁর ‘আচ্ছা কেন’, ‘হৃদয় কাদা মাটির’, ‘ও নদী রে’সহ অনেক হিট গান। গানের ফাঁকে দর্শকদের সঙ্গে তার এই কথোপকথন গানগুলোকে করে তুলেছিল আরও আকর্ষণীয়।
সুন্দর সময়গুলো সত্যিই খুব দ্রুত চলে যায়। কীভাবে যে দুই আড়াই ঘণ্টা সুরের মূর্ছনায় কাটিয়ে দিলাম, বুঝতেই পারিনি। যখন পার্থ বড়ুয়া গাইতে শুরু করলেন ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’, তখন পুরো পরিবেশে যেন এক নিস্তব্ধ আবেগ ছড়িয়ে পড়ল। আমরা যারা সেই স্মৃতির শহর থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, বিদেশবিভুঁইয়ে জীবনের হিসাব মেলাতে ব্যস্ত, তাঁদের চোখের সামনে ভেসে উঠল ফেলে আসা দিনের মায়াবী ছবি। কিছু স্বপ্ন হয়তো হারিয়ে যায়, কিছু থেকে যায় আমাদের সঙ্গে। সেই বেঁচে থাকা স্বপ্নগুলোই আমাদের নতুন পথে চলার প্রেরণা দেয়, সাহস জোগায় এগিয়ে চলতে। আর এই সুরের মুগ্ধতা, এই মুহূর্তগুলো যেন একেকটি বেঁচে থাকা স্বপ্নেরই প্রতিচ্ছবি—যা আমাদের অন্তরে প্রজ্বলিত থাকে, আমাদের বাঁচতে শেখায়, ভালোবাসতে শেখায়।