বাবারা এমনই হয়
কাজের ক্ষেত্রে চাচার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়, কিন্তু কখনো কথা বলা হয়নি। চাচা হাফলরি (ছোটগাড়ি) চালান। প্রতিদিন তাঁর মরুভূমিতে আসা-যাওয়া। চুল–দাড়ি অনেকটা পেকে গেছে। বয়স অন্তত ৬০ বছর তো হবেই। কৌতূহলবশত একদিন জিজ্ঞেস করে বসলাম, ‘চাচা এ বয়সে আপনি কুয়েতে কী করেন? আপনার তো এখন নাতি–নাতনি নিয়ে সময় কাটানোর কথা।’
চাচা হাসিমুখে আমার দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছু না বলে চুপ হয়ে রইলেন। আমি এবার আরেকটু দুষ্টুমি করে বললাম, ‘আর কত টাকা কামাবেন? এবার দেশে যান। এই বয়সে কেউ বিদেশ করে?’
চাচা এবার উত্তর দিলেন, ‘যাব আরকি সময় হলে। চাইলেই তো আর যাওয়া যায় না। আমার তো একটা পরিবার আছে। আমি চলে গেলে আমার পরিবারকে দেখবে কে?’
‘কেন, আপনার ছেলে নেই? তারা দেখাশোনা করবে।’
চাচা মৃদুস্বরে উত্তর দিলেন, ‘আছে। আমার দুই ছেলে। দুজনই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। দুই মেয়েকে বিয়ে দিলাম। তারাও বেশ সুখে আছে।’
চাচার ছেলেরা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে শুনে আমি অবাক হলাম। উনি ময়লার গাড়ি টানছেন এখানে। আর ওনার ছেলেরা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়ালেখা করে। একদিকে যেমন অবাক হলাম, অন্যদিকে নিজের কাছে কিছুটা খারাপও লাগল। স্বপ্নের ঢাবিতে আমিও ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। কিন্তু ঢাবি তো দূরের কথা, পরিবারের অভাব-অনটনে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়াও সম্ভব হয়নি।
চাচাকে বললাম, ‘আপনি তো ভাগ্যবান। যে ভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন সবার, সেই ভার্সিটিতে আপনার দুই ছেলে আছে।’ চাচা হাসিমুখে উত্তর দিলেন, ‘এটাই তো আমার প্রকৃত সুখ। কেউ জিজ্ঞেস করলে গর্ব করে বলতে পারি, আমার ছেলেরা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।
আমি চাই, আমার ছেলেরা মানুষের মতো মানুষ হোক। আমি কষ্ট করলেও কখনো তাদের অভাব বুঝতে দেই নাই। প্রায় দুই যুগ ধরে কুয়েতে আছি। রাত দুইটায় ঘুম থেকে উঠে কোম্পানির পোশাক পরে কাজে নেমে যেতে হয়। অনেক সময় সকালে নাশতাও করা হয় না। ডিউটি অবস্থায়ই কুয়েতিরা অনেক সময় নাশতা দিলে সেগুলো খেয়ে কাটিয়ে দিই।’
চাচা কথাগুলো বললেও ওনার মুখে হতাশার কোনো ছাপ ছিল না। হাসিমুখেই কথাগুলো বলছিলেন। রাত দুইটায় ঘুম থেকে উঠে ডিউটি করা যে কত কষ্ট, সেটা যাঁরা রাতে ডিউটি করেন, তাঁরাই জানেন।
কুয়েতে আসার পর দুই মাস রাতে ডিউটি করে ছেড়ে দিয়েছি। আমার তো অফিসে বসা থাকা। দিনে যতই ঘুমাই না কেন, শেষ রাতে চোখে ঘুম চলে আসত। রাতের ডিউটি আমার কাছে খুব বিরক্তিকর।
এই যে চাচা এত কষ্ট করছেন পরিবারের জন্য, সেই পরিবার কি আদৌ বুঝতে পারে? না! কখনো বুঝবে না। অনেক সময় দেখেছি, ঘামে চাচার পুরো শরীর ভিজে গেছে। এই যে ময়লার গাড়ি, সেগুলোর বেশির ভাগের এসি নষ্ট। কুয়েতে তো গরমকালে ৫০ ডিগ্রির ওপর তাপমাত্রা থাকে। এসি ছাড়া গাড়িতে বসে থাকা তখন খুব কষ্টসাধ্য।
চাচাকে বললাম, ‘এই যে আপনি এতগুলো বছর ধরে আপনার পরিবার, আত্মীয়স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন, কখনো কি মনে হয়নি, এই আত্মত্যাগের প্রতিদান আপনি পাবেন কি না?’
চাচা বলেন, ‘আমার কোনো দুঃখ নেই। নেই কোনো আফসোস। যত দিন সুস্থভাবে বেঁচে আছি, তত দিন করে যাব। সন্তানদের কাছে আমার কোনো চাওয়া নেই।’
সন্তানেরা যদি বাবাদের এই আত্মত্যাগের কথা বুঝত, তাহলে হয়তো বৃদ্ধাশ্রম নামক জায়গায় কখনো বাবাদের ঠাঁই হতো না।