তবুও নিশ্চিত জীবনের স্বপ্নে অনিশ্চিতের পথযাত্রা...
কানাডার টরন্টো শহরের ড্যানফোর্থ এলাকা। এখানকার ভিক্টোরিয়া পার্ক সাবওয়ে (মেট্রো) ঘিরে গড়ে ওঠা কমিউনিটির সুবিন্যস্ত বাড়িগুলো কিংবা সুউচ্চ ভবনগুলো দেখলে প্রথমেই স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমানোর তৃপ্তি আচ্ছন্ন করবে সদ্য কানাডায় পা দেওয়া বাংলাদেশিদের। সবকিছু ছবির মতো সুন্দর বলতে যা বোঝায়, দৃশ্যত তা–ই এখানে। এদের মধ্যে কেউ কাজ করতে, কেউ উচ্চশিক্ষা গ্রহণে এবং একটি বড় অংশ অভিবাসী হতে দেশ ছেড়েছেন। নিজ দেশ ছেড়ে উন্নত কোনো দেশে পাড়ি জমানো সংখ্যার একটি বড় অংশই তরুণ, যাঁদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপিয়ান কিছু দেশ।
ইউনেসকোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি-লেভেল স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন ৫২ হাজার ৭৯৯ জন শিক্ষার্থী। তবে সবাই যে নিয়মিত শিক্ষার্থী তা নয়, অনেকেই রয়েছেন যাঁরা শুধু বিদেশ পাড়ি জমাতে যেনতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছেন, কারণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্টুডেন্ট ভিসা প্রাপ্তি তুলনামূলক সহজ। কেউবা এই শিক্ষা-সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সপরিবারে চলে আসছেন বিদেশে।
সম্প্রতি একটি সার্টিফিকেট কোর্সে অংশ নিতে মাসখানেকের মতো কানাডায় অবস্থান করে বাংলাদেশিদের সান্নিধ্য পেয়ে অনেক প্রশ্নই ভাবিয়ে তুলেছে। নিজ দেশের মায়া ত্যাগ করে, আত্মীয়-বন্ধু-স্বজনদের ছেড়ে প্রায় ভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশ ও সমাজ-রাষ্ট্রকাঠামোতে চ্যালেঞ্জিং জীবন বেছে নেওয়ার পেছনে মূলত কোন কোন প্রভাবক কাজ করছে? তরুণেরা শুধু উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্যই কি দেশ ছাড়ছে?
কোর্স শেষে দেশে ফেরার প্রাক্কালে দেশের উদ্ভূত কোটা সংস্কার আন্দোলনের খবর পাই আমরা। কিন্তু তখনো আমাদের আঁচ করতে বাকি কোন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ এবং শেষের দিকে দেশের সঙ্গে প্রায় সব রকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা শঙ্কার জন্ম দিয়েছিল। শুধু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরের মাধ্যমেই দেশের চলমান সংকট সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছিলাম। প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রায় সবার মধ্যেই দেশের চলমান আন্দোলন নিয়ে উৎকণ্ঠা, আলোচনা-সমালোচনা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ লক্ষণীয় ছিল। আর স্বভাবতই ভাবনায় থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর মিলছিল একে একে।
প্রসঙ্গত, দৈনিক প্রথম আলোর উদ্যোগে ২০১৭ সালে অর্গ-কোয়েস্ট বাংলাদেশের তরুণদের নিয়ে একটি জরিপ পরিচালিত হয়। জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৮২ শতাংশ তরুণই তাঁদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন, ৬৩ শতাংশ তরুণ তাঁদের জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে অনিশ্চিত এবং ৫৬ শতাংশ তরুণ তাঁদের নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ঠিক দুই বছর পরে পরিচালিত একই জরিপে দেখা গেছে, ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ তাঁদের জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে অনিশ্চিত এবং ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
ফিরে আসি ড্যানফোর্থে, যেখানে প্রতিদিন ভিড় করে বাংলাদেশিরা। সম্প্রতি এটি ‘বাংলা টাউন’ হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে। বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশ ভ্রমণ ভিসায় কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন; কিন্তু স্থায়ীভাবে থেকে যেতে চান দেশটিতে। বাংলাদেশে তাঁরা অনেকেই আর্থিকভাবে ঢের সচ্ছল ছিলেন, ছিলেন বাড়ি-গাড়ির মালিক, কেউ ছিলেন সরকারি বা বেসরকারি উচ্চ পদে কর্মরত, কারো ছিল প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা। কিন্তু সবকিছু ছেড়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থির-নিরাপদ-সুশৃঙ্খল ভবিষ্যতের লক্ষ্যেই তাঁদের দেশের মায়া কাটিয়ে একেবারে চলে আসা। ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশ থেকে কানাডায় আসা বেশির ভাগ মানুষই রাজনৈতিক আশ্রয়ের (অ্যাসাইলাম) প্রার্থনা করে। যদিও এই প্রক্রিয়াটি বেশ সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল এবং প্রক্রিয়া চলাকালীন দেশে ফিরে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ থাকে না। স্বপ্নের দেশ বললেও এখানে এসে বুঝতে পারা যায়, স্বপ্ন আর বাস্তবতার কত ব্যবধান। মজার বিষয় হচ্ছে, কানাডা থাকাকালীন যেসব বাংলাদেশির সঙ্গে আলাপ-সাক্ষাৎ হয়েছে, সবারই সাধারণ প্রশ্ন ছিল, কবে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য আবার এখানে ফিরে আসব।
অন্যদিকে ভয়াবহ চিত্র হচ্ছে, তরুণদের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্নতা, নিরাপত্তাহীনতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আনুপাতিক হারে বেড়েই চলছে। দেশে শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত বিভিন্ন উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তিগত আধুনিকায়নের পরও দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ ও সুশাসনের অভাব, লাগামহীন ঘুষ-দুর্নীতি, কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগ ও পক্ষপাতিত্বের কারণে শিক্ষার্থী ও তরুণদের দেশ ছাড়ার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই কদর্য রাজনীতি আর ক্ষমতাসীন দল ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর আধিপত্যবাদের কাছে তরুণদের লালিত স্বপ্নের পরাজয় ক্রমশ তাঁদের মধ্যে ক্রোধ-ক্ষোভের সঞ্চার করছে। ‘সততাই সর্বোৎকৃষ্ঠ পন্থা’ ছোটবেলায় মুখস্থ করা এই ভাবসম্প্রসারণ থেকে যে শিক্ষা আমরা পেয়েছি, বাস্তব বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা খুঁজে পাওয়া দুর্লভ, যা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোশ উন্মোচিত করে।
কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে ঘিরে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যে বিষবাষ্প উদ্গিরিত হচ্ছে, তা হঠাৎ করেই বাষ্পীভূত হয়ে ছড়িয়ে পড়েনি। বছরের পর বছর ধরে চলমান দুর্নীতি, সরকারের নিরঙ্কুশ প্রভুশক্তি মনোভাব, সরকার সমর্থিত দল-গোষ্ঠীর একচ্ছত্র আধিপত্য, বাক্স্বাধীনতাকে জোর করে দমিয়ে রাখাই ক্ষোভকে পুঞ্জীভূত করেছে। যে তরুণ স্বাধীন দেশে বাস করতে গিয়ে তার পরিবারের সততা, আদর্শকে উপহাসের শিকার হতে দেখছে, নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত বৈষম্যের সমাজব্যবস্থায় শুধু লুটেরা গোষ্ঠীদের ক্ষমতা-সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে দেখেছে, তখন তার সামনে কোনো স্বপ্ন-সম্ভাবনা উঁকি দেয় না। যে রাষ্ট্রব্যবস্থা তরুণদের জন্য কোনো রোল মডেল তৈরি করতে ব্যর্থ, সুস্থ বিনোদন আর বিকাশের সুযোগ দিতে অসমর্থ, তরুণ প্রতিভার মূল্যায়ন করতে অপারগ, সেখানে তরুণরা কেবলই হতাশা বুকে নিয়ে নিশ্চিত জীবনের স্বপ্নে অনিশ্চিতের পথযাত্রায় শামিল হবেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের সহিংস ভূমিকা আর জেদের কারণে কতগুলো নিষ্পাপ প্রাণ ঝরে গেছে, তারপরেও নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতা থেকে বলতে হয়, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না/এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না/এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না/এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না’।
এই মৃত্যু উপত্যকা আবার রঙিন ফুলে শোভিত হবে, নাকি জন্মভূমির মাটি আর বধ্যভূমির কাদা এক হয়ে আরও দুঃস্বপ্নময় ভবিষ্যতের পথে আমাদের হাঁটতে হবে? হতাশাকে আশায়, দুঃস্বপ্নকে স্বপ্নে পরিণত করার সময় হয়তো এখনো শেষ হয়ে যায়নি। হয়তো দেরি হয়ে গেছে অনেক, কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। স্তুতিবাক্য আর তেলমর্দনে নিমজ্জিত সরকার ব্যবস্থা কি আদৌ তরুণদের মূল্যায়ন করবে? আদৌ কি শুনবে তরুণদের মর্মব্যথা? নাকি বিষবাষ্প ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে বিস্ফোরণ আসন্ন? ভাবার সময় এখনই।
* লেখক: যোয়েল কর্মকার, বিজ্ঞানসংগঠক ও উন্নয়নকর্মী
*দূর পরবাসে ছবি, লেখা ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন প্রবাসের পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]