মরক্কো ভ্রমণের গল্প: পর্ব-৪

ছবি: সংগৃহীত

ঘুম থেকে উঠলাম সকালে। আজ আগাদির (মরক্কো) শহরের আবহাওয়া খুবই চমৎকার। ভাবছিলাম সকালে উঠে মরক্কোর ব্রেকফাস্ট খাব। কোনো রেস্তোরাঁয়। কিন্তু বউ-ছেলের ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দুপুর ১২টা। ফ্রিজে রাখা খিচুড়ি গরম করে খেলাম। তারপর ছেলে বলল, ‘চলো বাবা, সুইমিংপুলে যাই।’ ফ্ল্যাটের নিচেই বিশাল সুইমিংপুল। গেলাম। কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে, রুমে এসে গোসল করলাম। তারপর বেরুতে বেরুতে বিকেল প্রায় পাঁচটা। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে টুকটাক ড্রিংকস কিনলাম। ট্যাক্সি পেতে কয়েক মিনিট হাঁটতে হলো। এখানে ট্যাক্সি দরদাম করে নিতে হয়। যদিও ট্যাক্সিতে মিটার আছে, কিন্তু সব ট্যাক্সিচালক এটা চালায় না। বাংলাদেশের মতো। আমরা এই প্রথম একজন ট্যাক্সিচালক পেলাম, যে বলল, মিটারে যাবে। এসে নামলাম আগাদির সমুদ্রসৈকতে। সমুদ্র দেখে মন ভালো হয়ে গেল। খুশি খুশি। ছেলে বলল স্টেইক খাবে। সমুদ্রতীরে চমৎকার সব রেস্তোরাঁ। ছেলেকে বললাম, ‘এখন তো পেটভর্তি, চলো আপাতত ম্যাক ডোনাল্ড খেয়ে ফেলি। রাতে স্টেইক খাব।’ ছেলে রাজি হলো। এক দোকানদার বলল, ম্যাকডোনাল্ড পাঁচ থেকে ছয় মিনিট হাঁটাপথ। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে তো শেষ হয় না। ২০ থেকে ২৫ মিনিট হাঁটার পর পেলাম। খাবার অর্ডার দিলাম। তিনজনের খাবার দুই হাজার টাকা।

এখন বেশ রোদ। কিন্তু বাতাস থাকায় খারাপ লাগছে না। ছেলে বলল, সমুদ্রে সাঁতার কাটবে। ছেলের মা এই বালুতে হাঁটতে রাজি না। এই রোদে। কী আর করা। ছেলের সঙ্গী আমার-ই হতে হলো। সমুদ্রতীরে বসে তার কাপড়চোপড় পাহারা দিই। ঢেউ দেখি। মানুষ দেখি। বিচিত্র মানুষের উচ্ছ্বাস। একজন নারীকে দেখলাম বালুর মধ্যে শুয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। বাংলাদেশের মতো চা-ও বিক্রি করে কেউ কেউ। কেউ হাতে মেহেদি লাগিয়ে দেয়। ব্যবসা আরকি। তবে সৈকতের নিরাপত্তা খুব ভালো। সারাক্ষণ পুলিশ টহল দেয়। ছেলে শরীরে এক মণ বালু নিয়ে ফিরল। কিন্তু শরীর ধোবে কোথায়! কয়েক মাস আগে তুরস্কের সমুদ্রসৈকতে গিয়েছিলাম। সেখানে কিছুক্ষণ পরপর শরীর ওয়াশের ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু এখানে দেখছি না। অনেকক্ষণ হাঁটার পর একটা বাথরুম পেলাম। ব্যবহারের জন্য ৫ দিরহাম দিতে হলো। যা-ই হোক, এসব করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে এল। সূর্যাস্তের সময়। আমাদের ক্যামেরা সরব হয়ে উঠল। আমরা আনন্দে ছবি তুললাম বাতাস খেয়ে খেয়ে। এখন রাত প্রায় ৯টা। ছেলে বলল, ‘চলো, এখন রেস্তোরাঁয় ঢুকি।’ পাশেই রেস্তোরাঁ। মানুষে গিজগিজ করছে। রেস্তোরাঁয় ঢুকে তিনজনের জন্য একটা টেবিল চাইলাম। রেস্তোরাঁর নারী ম্যানেজার, আমাদের নিয়ে সুন্দর একটা টেবিল দিলেন। চারদিকে সাদা মানুষ। ইংরেজিতে কথা বলছে। এক-দুজন আরবিতে। আমরা খাবারের অর্ডার দিলাম। খেতে খেতে হঠাৎ ছেলে দাঁড়িয়ে গেল। সে উচ্ছ্বসিত। বিস্মিত। ব্যাপার কী!

ছেলে দূরের একটা টেবিল দেখিয়ে বলল, ওই যে ছেলেমেয়ে, তারা তো আমাদের শহরের (বারজেস হিল, ইংল্যান্ড)।

তাই নাকি!  তুই চিনলি ক্যামনে!

আরে তাদের একজন, আমাদের বাসার পাশের যে দোকান আছে, সেখানে কাজ করে।

তোকে চেনে তারা?

অবশ্যই।

তারপর সে দ্রুত ছুটে গেল তাদের কাছে। তারাও তাকে দেখে বিস্মিত। এই দূরদেশে এসে দেখা। খুশি খুশি। মনে পড়ল সিলেটি একটা গান, ‘সিলেট পাইলে যেমন তেমন, ঢাকায় পাইলে আছইন কেমন, লন্ডন পাইলে ধইরা খইন, ওহ আমার সিলেটি ভাইসাব।’

খেয়ে  বিল মিটিয়ে যখন বের হলাম, তখন রাত প্রায় এগারোটা। একটা ট্যাক্সি পেলাম। কিন্তু চালক কোথায়! চোখ ঘুরিয়ে দেখি, সে পাশেই মাদুর বিছিয়ে  নামাজ  পড়ছে। অপেক্ষা করলাম এবং তাকে নিয়ে ফিরলাম অ্যাপার্টমেন্টে।

আগামীকাল আমরা আবার মারাকাশ শহরে চলে যাব। বউ ব্যাগপত্র গোছাতে লাগল। তখন আমার মনে হলো আজকের ভ্রমণকাহিনিটা একটু লিখে রাখি। কিন্তু মুঠোফোনে চার্জ নেই। ভাবলাম, তাহলে কালই লিখব। মনে পড়ল বিখ্যাত পর্যটক ও পণ্ডিত ইবনে বতুতার কথা। বতুতার জন্ম এই মরক্কোতেই। তাঁর বিখ্যাত একটি উক্তি আছে, ‘ভ্রমণ মানুষকে নিঃসঙ্গ করে দেয়, তারপর বানায় গল্পকার।’

আমি ভ্রমণ করতে করতে গল্পকার হতে পেরেছি কি না জানি না, এই বিচার অবশ্য আপনাদের হাতেই। চলবে...

*আগামীকাল পড়ুন: মরক্কো ভ্রমণের গল্প: পর্ব-৫

দূর পরবাসে ভ্রমণ, ভিডিও, ছবি, ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]