বিশ্বজোড়া বন্ধুত্ব
প্রযুক্তির উৎকর্ষের এ যুগে পুরো বিশ্বই এখন একটি গ্রামের রূপ নিয়েছে। এখন বিশ্বব্যাপী সবাইকে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্যই ভাবতে হয়। এক দেশের জন্য যেটা সমস্যা সময়ের পরিক্রমায় অন্য দেশগুলোও তাতে কম–বেশি আক্রান্ত হয়। আবার যেকোন সুখবরও সবার জন্যই ভালো বার্তা বয়ে আনে। দেশ ও জাতি আর এখন কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ নেই। একটা দেশ থেকে মানুষ অন্য আরেকটা দেশে গিয়ে সেই দেশের ভেতরে আরেকটা ছোট দেশ তৈরি করে ফেলেন। এটাকে আমি বলি দেশের ভেতর দেশ।
মানুষ সৃষ্টির আদিকাল থেকেই যাযাবর। বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষ পৃথিবীর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হয়। সেই ধারা এখনো অব্যাহত। এখনো মানুষ জীবিকার তাগিদে, কখনো–বা বাড়তি সামাজিক নিরাপত্তার ভরসায় দেশান্তরিত হচ্ছেন। আর যে দেশেই যাচ্ছেন, সেখানে নিজেদের আরেকটা ছোট দেশ তৈরি করে নিচ্ছেন। এ অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশিরাও এখন আর পিছিয়ে নেয়। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর হাজারো মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্থানান্তরিত হচ্ছেন। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়েই মানুষ পাড়ি দিচ্ছেন দেশের গণ্ডি ও সীমানা ছেড়ে।
আমাদের কলেজজীবনের বন্ধু পান্টু কলেজজীবন শেষ করেই পাড়ি জমিয়েছিল সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ের দেশ আমেরিকায়। পান্টুর সঙ্গে আমার পরিচয় কলেজজীবনের শেষের দিকে। মফস্সল শহর কুষ্টিয়ায় আমরা বিভিন্ন স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে সবাই ভর্তি হয়েছিলাম কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। গ্রামের একটা স্কুল থেকে পাস করে কলেজে ভর্তি হওয়া আমার সামনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছিল। বন্ধু সৌরভের মাধ্যমে একদিন গিয়েছিলাম পান্টুদের বাড়িতে। আমার এখনো দিব্যি মনে আছে একটা হ্যাংলা পাতলা তালপাতার সেপাইয়ের মতো ছেলে উঠে এল বিছানা থেকে। তার মাথার কাছে ঝোলানো রয়েছে জিম মরিসনের সাদা–কালো একটা লম্বা ছবি। এরপরের ঘটনা আর এত দিন পর মনে নেই আমার।
জীবনের পরিক্রমায় একসময় আমরা সপরিবার এসে হাজির হলাম অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। বাস শুরু হলো সিডনির দক্ষিণ–পশ্চিমের সাবার্ব মিন্টোতে। অস্ট্রেলিয়া আসার প্রথম সপ্তাহেই মেয়েকে স্কুলে দিতে গিয়ে গিন্নি খবর আনল, মেয়ের স্কুলের সপ্তাহান্তে বাংলা ভাষা শেখানোর ক্লাস করানো হয়। পরের রোববার মেয়েসহ আমি গিয়ে হাজির হলাম সেই স্কুলে। জানলাম এটা অস্ট্রেলিয়া সরকারের এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের অধীনে পরিচালিত ‘কমিউনিটি ল্যাঙ্গুয়েজ’ স্কুল। এখানে প্রবাসী প্রজন্মকে প্রতি রোববার বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির শিক্ষা দেওয়া হয়। সেখানে উপস্থিত অভিভাবকদের সঙ্গেও পরিচয় হলো। আমার মধ্যে একটা ব্যাপার আছে; যার সঙ্গেই পরিচয় হয়, তার সঙ্গেই একটা আত্মীয়তার সম্বন্ধ তৈরি করে নিই, ঠিক আবহমান গ্রামবাংলার মানুষদের মতো।
সেখানে পরিচয় হলো ফয়সাল খালিদ শুভ ভাইয়ের সঙ্গে। কথায় কথায় জানতে পারলাম ওনার শ্বশুরবাড়ি কুষ্টিয়ায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, তাহলে আপনি সম্পর্কে আমার দুলাভাই হচ্ছেন। কথা প্রসঙ্গে উনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের কোন ব্যাচের ছাত্র ছিলাম।’ উত্তর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উনি বললেন, ‘আরে আমার শ্যালকও তো তোমাদের ব্যাচের ছাত্র ছিল।’ আমি বললাম, ‘ওর নাম কী?’ তখন শুভ ভাই বললেন, ‘তাসলিমুর।’ বলেই ওনার মনে পড়ে গেল ভঙ্গিতে বললেন কিন্তু ডাক নাম পান্টু। সঙ্গে সঙ্গে আমার পনেরো বছর আগের স্মৃতি মনে পড়ে গেল। কারণ, আমি জিম মরিসনের কথা একেবারে আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল।
এর পর থেকেই শুভ ভাই হয়ে গেলেন পাকাপোক্তভাবে আমাদের দুলাভাই, বর্ণি আপু আমার বড় বোন। আর ওনাদের দুই মেয়ে অপলা ও অরূপা আমার ভাগ্নি। এরপর শুভ ভাইকে দেখলেই কুষ্টিয়ার আঞ্চলিক টানে ‘দুলুভাই’ বলে ডাক দিই। মাঝেমধ্যে ওনাকে দেখলে রাজশাহীর আঞ্চলিক টানে ‘মামুর বিটা’ বলেও সম্বোধন করি। শ্যালক ও দুলাভাইয়ের এ এক মিষ্টি খুনসুটি। বিভিন্ন উপলক্ষে ওনারা আসেন আমাদের বাড়িতে আবার আমরাও হাজির হই ওনাদের ডেরায়। বর্ণি আপু ওনার মেয়েদের কাছে বলেছেন, সিডনিতে তোদের একমাত্র মামা হচ্ছে ইয়াকুব। মামা হওয়ার ব্যাপারটা যে এত আনন্দের আগে জানতাম না।
এরপর একদিন শুভ ভাই বললেন, এ তোমার বন্ধু আসতেছে অস্ট্রেলিয়া বেড়াতে। শুনে আমি খুবই খুশি হলাম। দীর্ঘ ২৩ বছর পর আবার পান্টুর সঙ্গে দেখা হবে। অবশ্য পান্টু এত দিনে বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। মিকাইলা নামে ওর একজন অতি সুন্দরী স্ত্রী আছে। পান্টু অস্ট্রেলিয়া এসেছিল অফিসের কাজে। তার ফাঁকে ফাঁকে শুভ ভাইদের বাসায় অবস্থান করছিল। এর মধ্যে একদিন আপু ফোন দিয়ে বললেন, তুই কালকে সপরিবার চলে আয়। আমিও সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু নির্দিষ্ট দিনে গিন্নির ব্যস্ততার কারণে আর যেতে পারল না। আমি একাই গিয়ে হাজির হলাম।
অবশ্য ওরা আসবে জানার পর থেকেই ওদের কী দিয়ে স্বাগত জানানো যায় সেই পরিকল্পনা করছিলাম। তখন মনে হলো ওদের ষোল আনা বাঙালিয়ানায় বরণ করে নিলে কেমন হয়। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক আমার বুয়েটের বন্ধু আসাদের বাসায় হাজির হলাম এক রাত্রে। আসাদের স্ত্রী কুমু ভাবি অনলাইনে একটা বুটিক শপ চালান ‘ডি স্যাফায়ার’ নামে। ওনার শপের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো উনি শতকরা একশত ভাগ বাংলাদেশি পণ্য আমদানি ও বিক্রি করেন। আর এগুলোর বেশির ভাগেরই জোগানদাতা বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষ আরও নির্দিষ্ট করে বললে মেয়েরা। ওনার এ উদ্যোগের উদ্দেশ্যই হলো একদিকে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশি পণ্যের প্রচার ও প্রসার অন্যদিকে বাংলাদেশের প্রান্তিক মেয়েদের ভাগ্যোন্নয়ন।
ওনার কাছ থেকে আমরা বিভিন্ন সময়ে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পোশাক আবার কখনো–বা পয়লা বৈশাখের পোশাক বা বিজয় দিবসের পোশাক কিনি। সিডনিতে খাঁটি বাংলাদেশি পণ্যের এক বিশ্বস্ত নাম ডি স্যাফায়ার। কুমু ভাবিকে আমার পরিকল্পনার কথা বলতেই উনি বললেন, তাহলে বাংলাদেশের গামছা প্রিন্টের সালোয়ার কামিজ ও পাঞ্জাবি দিতে পারেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম না ওদের কোন সাইজটা মানানসই হবে। তখন বুদ্ধি করে একটা গামছা, একটা পাখা আর একজোড়া হাতের বালা নিয়ে নিলাম। ভাবি বললেন, আমার পক্ষ থেকে নিয়ে যান একটা পার্স। এগুলো আগেই কিনে গুছিয়ে রেখেছিলাম।
নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে আপুদের ওরান পার্কের বাড়িতে দেখা হলো পান্টুর সঙ্গে। সময়ের পরিক্রমায় আমরা সবাই একটু মুটিয়ে গেছি, স্বভাবে এসেছে পরিবর্তন। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, পান্টু একটুও বদলে যায়নি। না স্বভাবে, না গঠনে। এখনো সেই হ্যাংলা পাতলায় আছে। এরপর পরিচয় হলো মিকাইলার সঙ্গে। মিকাইলা সদা হাসিখুশি আমেরিকান তরুণী। দুজনের জুটি একেবারে যেন হরিহর আত্মা। বর্ণি আপু যখন আমার সামান্য উপহারগুলো ওর হাতে তুলে দিল, তখন সে বাংলাদেশের কিশোরী মেয়েদের মতো খুশি হয়ে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো পরেও এল। এরপর আমরা সবাই মিলে তাকে পাখার ব্যবহার শেখালাম। সে খুবই আগ্রহ নিয়ে আমাদের পাগলামিতে শামিল হলো। শুভ ভাইয়ের বুদ্ধিতে আমরা বিভিন্ন ভঙ্গিতে পোজ দিয়ে ওদের একগাদা ছবি তুললাম।
এরপর দেশে–বিদেশে অবস্থান করা সব বন্ধুর সঙ্গে পান্টুর কথা বলে দিলাম। রাতের খাবার শেষে আমরা বেড়াতে বেরিয়ে পড়লাম। সেদিন আকাশে ছিল উজ্জ্বল চাঁদ। ওরান পার্ক স্প্ল্যাশ পার্কে গিয়ে আমরা সবাই মিলে দোলনায় চড়ে বসলাম। এ ছাড়া বিভিন্ন রাইডে চড়ে ছেলেমানুষী আনন্দে মেতে উঠলাম। এরপর অন্যদেরকে পার্কে রেখে আমি, পান্টু আর শুভ ভাই হেঁটে এগিয়ে গেলাম। ওরান পার্ক লাইব্রেরি ছাড়িয়ে আমরা হাজির হলাম জ্যাক ব্রাহাম রিজার্ভে। সেখানে একটা গরুর পালের আদলে অনেকগুলো লোহার গরুর মূর্তি দাঁড় করানো আছে। আমি আর পান্টু মিলে পাল্লা দিয়ে তাদের পিঠে চড়ে বসলাম। আর শুভ ভাই আমাদের ছবি তুলে দিচ্ছিলেন সময়টাকে স্মৃতির খাতায় বন্দী করতে।
লেখাটা শুরু করেছিলাম ‘বিশ্বজোড়া বাঙালিয়ানা’ শিরোনাম মাথায় রেখে। কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত এসে দাঁড়াল ‘বিশ্বজোড়া বন্ধুত্ব’ শিরোনামে। শিরোনাম যা–ই হোক, দেশে দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙ্গালদেশিরা যেন সবাই একসূত্রেই গাঁথা। বাঙ্গালদেশিরা যেখানেই গেছেন, সেখানেই একটা ছোট বাংলাদেশ গড়ে নিয়েছেন। আর আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এতই বর্ণিল এবং আকর্ষণীয় যে সেটা নিমেষেই বিদেশিদের মুগ্ধ করে। যেমন আমেরিকার মিকাইলা বাংলাদেশের পোশাকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে, তেমনি অস্ট্রেলিয়ানরাও বাংলাদেশের পোশাকে মুগ্ধ হয়।