সুইডেনের জেলহাজতের স্ট্যান্ডার্ড সর্বনিম্ন তিন তারকা হোটেলের মতো

কারাগারপ্রতীকী ছবি

বহু বছর আগের কথা, একবার সুইডিশ মিডিয়া তুলে ধরেছিল, বাংলাদেশে চোর সমিতি বলে একটি শক্তিশালী সংগঠন আছে। এই সংগঠনে যারা যুক্ত, তারা নাকি প্রতি মাসে কিছু চাঁদা দিয়ে থাকে, যাতে করে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে বা আইনগত সাহায্যের প্রয়োজন হলে এ সমিতি থেকে সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা পায়। ঘটনাটি সুইডিশ গণমাধ্যমসহ লোকালয়ে হাস্যকর নিউজ হয়। এ ধরনের খবর নিজ মাতৃভূমি সম্পর্কে শোনা এবং জানার পর আমি তখন খুব লজ্জিত বোধ করি। এ কারণে যে দুনিয়ায় এত কিছু থাকতে এটা কেন আলোড়ন সৃষ্টি করল! পরে মেনে নিয়েছিলাম এই ভেবে যে গরিব দেশ, পেটের দায়ে হয়তো বেছে নিয়েছে এ ধরনের অপরাধমূলক কাজ।

অপরাধ করা বিশ্বের সর্বত্র একটি লজ্জাজনক বিষয়, এ নিয়ে কারও দ্বিমত থাকার অবকাশ নেই। ঘটনাটির সত্য–মিথ্যা তদন্ত করা হয়নি তখন, তবে মনে মনে ভেবেছিলাম, শুধু যে ভালো কিছু করতেই বুদ্ধির দরকার হয়, তা–ই নয়, খারাপ কিছু করতেও বুদ্ধির দরকার হয়। এ ঘটনার পর কত কিছু ঘটে চলছে বিশ্বে, তার কি কোনো হিসাব আছে? তারপরও চলছে জীবন তার গতিতে। দুর্নীতি, অনীতি যে শুধু বাংলাদেশে, তা–ই নয়, এসব এখন বিশ্বের সর্বত্র কমবেশি বিরাজমান। লেখালেখি যখন করি, চেষ্টা করি ভালো–মন্দ তুলে ধরতে। বেশির ভাগ সময় সুইডেনের ভালো দিকগুলো তুলে ধরি।

ভালো কিছু নিয়ে লিখতে পারতাম, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কোনোভাবেই তা সম্ভব হলো না। সুইডেনের বর্তমান পরিস্থিতির ওপর কিছু অপ্রিয় সত্য ঘটনা আলোকপাত করা এবং শেয়ার করার মূল কারণ হলো কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করা এই ডিজিটাল যুগে।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

সুইডেন গত বছর থেকেই শতভাগ ডিজিটাল দেশ হিসেবে পরিচিত। এখানে ক্যাশ টাকার বেচাকেনা বন্ধ। কার্ড ও সুইসের মাধ্যমেই টাকাপয়সার লেনদেন হয়ে চলছে। সুইস কিছুটা বিকাশের মতো মাধ্যম বললে ভুল হবে না। প্রতিদিন সন্ত্রাসের হাতে মৃত্যুর হার যেমন বেড়েছে, বেড়েছে তেমন অনলাইন জালিয়াতি। এতে করে পুরো সুইডিশ জাতি আতঙ্কের মধ্যে জীবনযাপন করছে। নতুন বছর শুরু হয়েছে খুনোখুনির মধ্য দিয়ে। প্রায়ই জানা যাচ্ছে, পুরো দেশের কোথাও না কোথাও মৃত্যুর ঘটনা এবং সব ঘটনার সঙ্গে শোনা যাচ্ছে সন্ত্রাসী, অস্ত্র, নার্কোটিক অথবা টাকাপয়সা জড়িত। পুলিশ কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আনতে।

মাত্র এক কোটির বেশি মানুষের বসত দেশটিতে, যেখানে কারও অর্থনৈতিক সমস্যা বাংলাদেশের মতো নয়, সেখানে কেন এ ধরনের ক্রাইম? নানা কারণ রয়েছে এর পেছনে, প্রতিদিনের আলোচনায় যে তথ্যগুলো বের হয়ে আসছে, তার মধ্যে যেমন বয়স্কদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট লুটপাট করে নিচ্ছে সুইসের মাধ্যমে। বিভিন্ন দেশের মানুষের বসবাস সুইডেন, যার ফলে নানা ধরনের গ্রুপ রয়েছে, চোরাচালান নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ইউরোপের আশপাশের দেশ যেমন বসনিয়া, ইউক্রেন বা আরও অনেক দেশ থেকে বেআইনিভাবে অস্ত্র ঢুকছে দেশটিতে। বিচার বিভাগের নিয়মকানুন বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই শীতল, যার ফলে বড় বড় ক্রাইম করা সত্ত্বেও সাজা তেমন কঠিন নয়। তারপর সুইডেনের জেলহাজতের স্ট্যান্ডার্ড সর্বনিম্ন তিন তারকা হোটেলের মতো যদি বলি ভুল হবে না। সবকিছু মিলে দেশটি বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে!

বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার মধ্যেও বড় আকারে বিষণ্নতা দেখা দিয়েছে। যে অবস্থা দেখছি, তাতে মনে হয় না দুর্নীতি, অনীতিতে বাংলাদেশ বেশি দিন বিশ্বের লিডিং পজিশনটি ধরে রাখতে পারবে। সদ্য ঘটে যাওয়া একটি মর্মান্তিক ঘটনার সারাংশ দিয়ে লিখাটি শেষ করব। আমার বহু দিনের পরিচিত একজন সুইডিশ, নাম উল্লেখ না করি। ভদ্রলোকের বয়স ৮০ বছর। সারা জীবন কাজ করেছে পোস্ট অফিসে। ব্যক্তিজীবনে বিয়েশাদি করেননি। ভদ্রলোক একজন টেনিস খেলোয়াড়, অবসর জীবনে নানা সামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকলেও টেনিস খেলার পেছেনে তিনি তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করে থাকেন। আমার ছেলেমেয়ে টেনিস খেলে, ভদ্রলোক আমার ছেলের একজন ভক্ত। সে নিয়মিত তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী ছেলেকে কিছু আর্থিক সাহায্য করে থাকেন, যাতে করে জনাথন তার খেলাধুলা সঠিকভাবে চালিয়ে যেতে পারে।

বছরের শেষ সপ্তাহে অনলাইন জালিয়াতির মাধ্যমে দুটি মেয়ে তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে তাঁর জীবনের যে সঞ্চয় ছিল, পুরো অর্থই আত্মসাৎ করেছে। ইদানীং এ ধরনের ক্রাইম সচরাচর ঘটছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ ধরনের জালিয়াতির নিশ্চয়তা দিতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। কারণ, যারা এ ধরনের ক্রাইম করছে, তারা এ বিষয়ের ওপর এত দক্ষ যে কর্তৃপক্ষ তাদেরকে চিহ্নিত করতে পারছে না। প্রতিদিন অনলাইন জালিয়াতির কারণে শত শত মানুষ হয়রানি হচ্ছেন, সর্বহারা হচ্ছেন, ভদ্রলোক তাঁর মধ্যে একজন।

জানি না, সুইডিশ সমাজ তথা রাষ্ট্রের থেকে ভদ্রলোক কোনো সাহায্য পাবেন কি না! বছরের শুরুতে এমন একটি দুর্ঘটনার পর আমি নিজেই বিষণ্নতার মধ্যে আছি। একই সঙ্গে ভাবছি, শিক্ষা, আদর্শ, নৈতিকতা আমাদের কোন দিকে পরিচালিত করছে! মা তার কোলের শিশুকে বুকের দুধ দিতে পারছে না, আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে দেখছি, কিছু করছি কি? সভ্য জগতে শীতের সময়ও যুদ্ধ চলছে, আমরা দেখছি।

প্রতিদিন শত শত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, আমরা দেখছি। আমরা কোটি কোটি ডলার ব্যয় করছি যুদ্ধে, অথচ না খেয়ে যারা মরছে, তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হোক, সেটা নিয়ে তেমন কিছু করছি না। অন্যদিকে বিশ্বের বড় বড় সংগঠন যেমন জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ কত নামীদামি মর্যাদাসম্পন্ন ব্র্যান্ড নেম গরিবের রক্ত চুষে খেতে খেতে শেষে সমাধির পাশে ঢলে পড়ছে! অথচ মানবজাতি তথা আমাদের মধ্যে কেন মানবতা, বিবেক বা মনুষত্বের সঠিক দিকনির্দেশনার জন্ম নিচ্ছে না!

  • লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]