রাঙা হাতের গল্প!

অলঙ্করণ: মাসুক হেলাল

পল্টু আমার ক্লাসমেট। তাদের একটা পাগলা কুকুর ছিল, নাম টমি। আমার হাতের লেখা খুব সুন্দর ছিল। পল্টু আমার কাছে অনুরোধ নিয়ে এল। অনুরোধ না রাখলে টমিকে লেলিয়ে দেবে, যা সে আগেও দুবার করেছিল আমার সঙ্গে।

আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে জেদি মেয়ে তারানা, তাকে তার পছন্দ হয়েছে! তার হয়ে তারানাকে প্রেমপত্র লিখে দিতে হবে। তারানা আমারও ভীষণ পছন্দের, কিন্তু টমির ভয়ে যে আমি কাঁপতে কাঁপতে স্কুলে আসি, সেই আমি তারানাকে তা জানানোর সাহস কোথা থেকে পাব?

কী আর করা! লিখে আনলাম পল্টুর প্রেমপত্র। পড়েই পল্টু ছিঁড়ে ফেলল। এটা পল্টুর পছন্দ হয়নি। তার মতে দু-চার লাইনের কবিতা যদি না থাকে, তাহলে সেটা কিসের প্রেমপত্র!

কিন্তু আমি তো আর কবি নই, তবু পল্টু আর তার টমির ভয়ে লিখে ফেললাম, শুধু কবিতার লাইনগুলো বলি আপনাদের—
ওগো আমার তারানা,
সব ছেড়ে থাকতে পারব,
শুধু তোমায় ছাড়া না!

হাসছেন আপনারা? ক্লাস সেভেনপড়ুয়া ছাত্রের পক্ষে এর চেয়ে ভালো কবিতা কী করে লেখা সম্ভব?

পল্টুর অনেক পছন্দ হয়েছে এবারের চিঠি। আমাকে একটা আইসক্রিম এনে দিল, আর কথা দিল কখনো টমিকে লেলিয়ে দেবে না।

পরদিনের ক্লাসে শ্রেণিশিক্ষকের বদলে স্বয়ং প্রধান শিক্ষক এসেছেন, বড়সড় কোনো কিছু না হলে তিনি ক্লাস নিতে আসেন না।

এসেই এক এক করে সবাইকে ডেকে একটা কাগজে নাম-ঠিকানা লিখতে বললেন। সবার লেখা শেষ। আমিও লিখলাম। অনেকবার সুন্দর লেখার জন্য পুরস্কার পেয়েছি। আজও নিশ্চিত বাহবা পাব।

এরপর স্যার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে সবার লেখার সঙ্গে এক এক করে কী জানি মিল খুঁজছেন। খুব সম্ভবত উনি যা খুঁজছিলেন, তা পেয়ে গেছেন।
ক্লাসের সব ছাত্রছাত্রী বাদ দিয়ে তিনি আমাকে ডাক দিলেন।
—আরমান, এই দিকে আয়।
—বাহ! তুই তো দেখি মহাকবি হয়ে গেছিস! তা, তোর কবিতাটা একটু সবাইকে পড়ে শোনা তো!

আমি চুপচাপ। স্যার এবার হুংকার দিলেন, পড়ে শোনা বলছি।
আমি মাথা নিচু করে পড়লাম।
ওগো! আমার তারানা,
সব ছেড়ে থাকতে পারব,
শুধু তোমায় ছাড়া না!

পুরো ক্লাস তখন হো হো করে হাসছিল। আমি একবার পল্টুর দিকে তাকালাম, সে আমার দিকে চেয়ে চোখ রাঙিয়ে দিল, ভাষাটা এমন ছিল, আসল কথা বললে টমিকে লেলিয়ে দেবে।

ততক্ষণে স্যার তাঁর বিখ্যাত বেতজোড়া আনিয়ে নিয়েছেন। আমাকে হাত পাততে বললেন। আর হাত পাততেই মারতে শুরু করলেন। আমার ফরসা হাতজোড়া লাল টকটকে হয়ে গেল। তারপর স্যার শাসিয়ে দিয়ে গেলেন সবাইকে, আর কেউ যদি এমন প্রেমপত্তর-টত্তর দাও, তবে শাস্তি আরও ভয়ানক হবে।

ছুটি হওয়ার আগেই বাড়িতে এ খবর চলে এসেছে। বাড়িতে এসে আবার খেলাম উত্তম মধ্যম!

এর পর থেকে শুধু আমার ক্লাসের নয়, অন্য ক্লাসের পোলাপাইনরাও আমাকে দেখলে কোরাস গাওয়ার মতো করেই কবিতাটা শোনাত।

‘ওগো আমার তারানা,
সব ছেড়ে থাকতে পারব,
শুধু তোমায় ছাড়া না’

দেখতে দেখতে স্কুলজীবন শেষের দিকে। ওই ঘটনার পর থেকে কখনো মুখ তুলে তাকাইনি তারানার দিকে। পল্টুদের কুকুরটা মরে গেছে বছরখানেক হলো। পল্টু চলে গেছে পুরো পরিবারসহ যুক্তরাষ্ট্রে।

স্কুল থেকে পাস করার পরের বছর স্কুলের প্রাক্তন ছাত্ররা মিলে একটা ম্যাগাজিন বের করে। আমি একটা লেখা দিই ম্যাগাজিনে। গল্পের নাম ছিল ‘একজন পল্টু আর টমির গল্প’। সেই দিনের অপ্রকাশিত কাহিনি তুলে ধরি সেই লেখায়।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

যুক্তরাষ্ট্র থেকে পল্টুও একটা লেখা পাঠায়। তার গল্পের নাম ছিল ‘ক্ষমা চাই’। তার লেখার বিষয়ও ছিল সেই কাহিনি। যদিও আমরা দুজন যোগাযোগ করে লিখিনি।
আমি ঢাকায় এক কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। ছুটিতে যখন গ্রামে গেলাম, আমাদের হেড স্যার তাঁর বাড়িতে ডাকলেন। তিনি আমাদের লেখা পড়েছিলেন স্কুল সাময়িকীতে। সেদিনের কথা তুলে দুঃখ প্রকাশ করলেন। আমি স্যারকে দুঃখ পেতে নিষেধ করলাম। বললাম, সেই ঘটনার পর থেকে আমি পড়াশোনা অনেক খেয়াল দিয়েছিলাম, স্যার।
আপনারা কি তারানার কথা জানতে চাইছেন? আসলে তার কোনো খবর জানি না। শুনেছি তার বাবার বর্তমান কর্মস্থল দিনাজপুর আছে তারা।

আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দিতে গেলাম, তারানার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল কাকতালীয়ভাবে। সেও পরীক্ষা দিতে এসেছে। তার সঙ্গে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি। কুশলাদি বিনিময়ের পর সে দুঃখ প্রকাশ করল সেই দিনের ঘটনার জন্য।
জানিস, স্কুল ম্যাগাজিনে তোর লেখাটি পড়ে অনেক কেঁদেছি আমি। তারপর অনেক চেষ্টায় ছিলাম তোকে খুঁজে পেতে। ‘সরি’ বলতে। হেড স্যারের বেত মারার পর তোর সেই রাঙা দুই হাতের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠত প্রতিনিয়ত। আমি সরি রে আরমান সেদিনের জন্য। তুইও তো বোকার মতো মার খেয়ে গেলি। পল্টুর কথা বলে দিলেই পারতি!

অলঙ্করণ: মাসুক হেলাল

বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকতে থাকতে পাঁচ বছর আগের কাহিনি মনে পড়ে গেল, তাই আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করলাম...

আমি একজনের জন্য বাসস্টেশন অপেক্ষা করছি। বাস ছাড়ার সময় হয়ে যাচ্ছে অথচ ওনার দেখা নেই! ওই যে তিনি আসছেন।
—এই, তোমার আসার সময় হলো, তারানা!
—কী করব বলো, রাস্তায় যে জ্যাম!

আপনারা কী ভাবছেন? আমরা ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’তে কবে নেমে গেলাম!

সেই ভর্তি পরীক্ষার দিন দেখা, তারপর একই বিষয়ে একসঙ্গে পড়াশোনা। কখন যে তুই থেকে তুমিতে চলে এলাম, বুঝতেই পারিনি। তিন মাস হলো চাকরি হয়েছে আমার, তারানার হয়েছে আরও এক মাস আগে। দুজন গ্রামে যাচ্ছি। হাত রাঙাতে, তবে এবার হেড স্যারের বেতে নয়, মেহেদিতে, শুধু আমার একার না, সঙ্গে তারানারও!

*লেখক: জাহেদুল আলম, সৌদি জার্মান হসপিটাল, শারজাহ, সংযুক্ত আরব আমিরাত

দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]