কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো যে যে কারণে বিপাকে
কানাডার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শিগগিরই বিদায় নিতে হবে জাস্টিন ট্রুডোকে। কানাডার প্রধান তিনটি বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টি, এনডিপি এবং ব্লক ক্যুইবেক জানিয়ে দিয়েছে, তারা আর জাস্টিন ট্রুডোকে কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সমর্থন করে না। ২০২১ সালের সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর লিবারেল পার্টি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি।
সেই নির্বাচনের পর থেকে তাঁকে এনডিপির সমর্থন নিয়ে সরকার চালাতে হচ্ছে। অন্যদিকে জাস্টিন ট্রুডোর দলের প্রায় ৫০ জন পার্লামেন্ট সদস্য (এমপি) জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা তাঁকে আর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেবেন না। ২০২৫ সালের ২৭ জানুয়ারি কানাডায় পরবর্তী সংসদ অধিবেশন বসবে। অধিবেশনের দুই বা তিন কর্মদিবসের মধ্যে তাঁর ওপর অনাস্থা প্রস্তাব আনবে কনজারভেটিভ পার্টি। একেবারে অতি আশ্চর্যজনক কিছু না ঘটলে সেই দিনই তাঁর ও লিবারেল সরকারের পতন হবে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সেই দিন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে আগেই পদত্যাগের ঘোষণা দিতে পারেন। অন্যদিকে তিনি সংসদ অধিবেশন আপাতত কিছুদিনের জন্য স্থগিত করে আরেকটু দীর্ঘায়িত করতে পারেন তাঁর ক্ষমতা।
এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও তাঁর পরিবার কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় অবকাশে আছেন। জানুয়ারি মাসের ২ তারিখ তিনি অবকাশ থেকে ফিরবেন বলে জানা গেছে। তিনি অপেক্ষা করছেন পার্টির ককাসের (নীতিনির্ধারণী মহল) সিদ্ধান্তের জন্য। তবে ট্রুডোর দল অর্থাৎ লিবারেল পার্টির প্রধান সমস্যা হচ্ছে, তাঁর (ট্রুডো) বিকল্প নেতৃত্ব খুঁজে পাচ্ছে না।
২০১৫ সালে লিবারেল পার্টি জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বে কানাডার ক্ষমতায় ফিরে আসে আট বছর পর। তাঁর জনপ্রিয়তা কমের মূল কারণ হিসেবে যেগুলো এখন ধরা হচ্ছে, তা হলো—তাঁর শাসন আমলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ছিল চরম। প্রায় ৩০ থেকে ৫০ ভাগ বেড়ে গেছে সবকিছুর দাম। যে হারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, মানুষের আয় সে হারে বাড়েনি। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর বাড়িভাড়া বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, বাড়ির দামও বেড়ে হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ, যার ফলে সাধারণ মানুষের বাড়িভাড়া দিয়ে থাকা কিংবা বাড়ি কেনা একেবারে অসম্ভব হয়ে গেছে। যে হারে মানুষ বেড়েছে, তার চেয়ে কম বাড়ি তৈরি হয়েছে। এর ফলে দেখা দিয়েছে বাসস্থানসংকট। অত্যাধিক মানবতা দেখাতে গিয়ে জাস্টিন ট্রুডো সিরিয়া, ইউক্রেন, আফগানিস্তান, ইরান, ফিলিস্তিনসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণ রিফিউজি নিয়ে এসেছেন। তাঁরা কানাডায় আসার পর কানাডার ইকোনোমিতে তেমন কোনো অবদান রাখছেন না। অর্থাৎ তাঁরা কাজ না করে সরকারি বিভিন্ন সাহায্য–সহযোগিতার ওপর নির্ভর করে দিন কাটাচ্ছেন।
বেকারের সংখ্যা কানাডায় এখন দিন দিন বাড়ছে। এ মুহূর্তে কানাডায় বেকারত্বের হার ৬ দশমিক ৮ শতাংশ, যা কোভিডের পর কানাডার স্মরণকালের সর্বোচ্চ বেকারত্বের হার। সারা দেশের বেকারত্বের হার ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হলেও বড় বড় শহরগুলো যেমন টরন্টো, মন্ট্রিয়লসহ বড় শহরে বেকারত্বের হার আরও বেশি। জাস্টিন ট্রুডো তাঁর নিজের দেশের জনগণের কথা চিন্তা না করে তাঁর মিত্রদেশের কথা শুনে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছেন ইউক্রেনে। এখন পর্যন্ত তিনি ইউক্রেন যুদ্ধে ১৯ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন। এত বিশাল অঙ্কের ঘাটতি মেটাতে তাঁকে জনগণের ওপর বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্স বসাতে হয়েছে, যা সাধারণ জনগণ মেনে নিচ্ছেন না।
কোভিডের পর তিনি অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য কানাডার ভিসানীতিতে দুটি নতুন পথ বেছে নেন। প্রথম পথ, একেবারে গণহারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষকে ভিজিট ভিসায় কানাডায় নিয়ে আসা। তাঁর সরকার ভেবেছিল, এই মানুষগুলো কানাডায় এসে কিছুদিন থেকে অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলে যাবেন। কিন্তু এর ফল হয়েছে উল্টো। মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে ভিজিট ভিসায় কানাডায় এসে অ্যাসাইলাম (আশ্রয়প্রার্থী) দাবি করেছেন।
কানাডার নিয়ম অনুযায়ী, এ দেশে এসে যে কেউ অ্যাসাইলাম দাবি করতে পারেন এবং সরকারের ‘প্রোটেকটিভ পার্সন’ হিসেবে সরকার তাঁকে মাসিক নিয়মিত ভাতা, চিকিৎসাসুবিধা, সন্তানদের ১২ ক্লাস পর্যন্ত বিনা মূল্যে পড়াশোনা–সুবিধা দিতে বাধ্য। যাঁরা অ্যাসাইলাম দাবি করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই এখন পর্যন্ত ওয়ার্ক পারমিট থাকা সত্ত্বেও কোনো কাজে ঢোকেননি। আইনি মারপ্যাঁচে তার কারণে এ সমস্ত কেসগুলো নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর লেগে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় পথটি হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে বিদেশি শিক্ষার্থী (ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট) কানাডাতে নিয়ে আসা হয়েছে অর্থনীতিকে চাঙা করতে। এসব শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষে পিআরের জন্য অর্থাৎ কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার জন্য কোনোভাবেই এলিজিবল হচ্ছেন না। এর ফলে তাঁরাও পড়াশোনা শেষে নিজ দেশে ফিরে না গিয়ে সরকারের কাছে অ্যাসাইলাম (আশ্রয়) দাবি করেছেন। ট্রুডোর ও কানাডার জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে উঠেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনে বিজয়।
ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে জিতেই ঘোষণা দেন যে কানাডা থেকে যে সমস্ত পণ্য আমেরিকায় রপ্তানি হয়, সেসব পণ্যে অতিরিক্ত ২৫ ভাগ ট্যারিফ প্রদান করতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ চোখরাঙানিতে ট্রুডোর অবস্থান কানাডার জনগণের কাছে ভালো লাগেনি। অন্যদিকে বিভিন্ন সময় ঠাট্টার ছলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে আমেরিকার গভর্নর এবং কানাডাকে আমেরিকার ৫১তম অঙ্গরাজ্য বলে দাবি করাকে সাধারণ মানুষ খুবই খারাপ চোখে দেখছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প জয় লাভ করার পর কানাডিয়ান ডলারের দ্রুত দরপতন হয় আমেরিকান ডলারের বিপরীতে। কয়েক দিন ধরে ১ কানাডিয়ান ডলারের বিনিময়ে ৬৯ থেকে ৭০ সেন্ট পাওয়া যাচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে এ বিনিময় হার আরও কমে যাবে বলে অর্থনীতিবিদেরা আশঙ্কা করছেন। প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডা এখন আর জাস্টিন টুডোর হাতে নিরাপদ নয় বলে মনে করছেন অধিকাংশ কানাডিয়ান। জাস্টিন ট্রুডোর মতো একজন সুদর্শন, বাগ্মী, স্মার্ট, কানাডার ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্রের প্রতি সহানুভূতিশীল হৃদয়বান প্রধানমন্ত্রীর বিদায় এখন অবশ্যম্ভাবী শুধু তাঁর কিছু ‘তুঘলকি’ কাণ্ডের কারণে।
দূর পরবাস-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]এ