আড়াই ঘণ্টা ঢাকা বিমানবন্দরে!

ঢাকা বিমানবন্দরে (শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) আড়াই ঘণ্টা। শুক্রবার, ১০ অক্টোবর সকাল ১০টা। কাতার এয়ারওয়েজ ঢাকার আকাশ ছুঁয়ে বিমানবন্দর রানওয়ে ছুঁলো। বড্ড ক্লান্তি ভাব নিয়ে যথারীতি উড়োজাহাজ থেকে বিমানবন্দরে ঢুকলাম। সঙ্গে আমার স্ত্রী।

দীর্ঘ ২৬ ঘণ্টা জার্নি করার পর বিমানবন্দরে নেমে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে চোখে পড়ল; দেশি–বিদেশি পাসপোর্টধারী যাত্রীদের দুটি লাইনে অসহায় ক্লান্ত-শ্রান্ত বাংলাদেশিরা দাঁড়িয়ে। দেশি পাসপোর্টধারীর লাইনটা নড়লেও বিদেশি পাসপোর্টধারী যাত্রীরা মূর্তির মতো অনড়। নড়াচড়া নেই। আমার সামনে ২৫-৩০ জন, পেছনে ৬০-৭০ জন। সবার হাতে পৃথিবীর হরেক রঙের নানান দেশের পাসপোর্ট। সবার চোখেমুখে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার একটা তাড়না। যাকে অনেকে ‘এশিয়ান ইমোশন’ বলে থাকেন। এরপর পুলিশি সওয়াল-জবাব। তারপর ধাপের পর ধাপ। আমার সামনে অতিশয় এক ভদ্রলোক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তাঁকেও প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হলো। ফাঁকে উনার সঙ্গে কথা হলো, তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘আইরনি অব ফেট (Irony of fate)।’

লাইন নড়াচড়া না দেখে আমি সামনে গিয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে জানতে চাইলাম, লাইনে সমস্যা কী। উনি আমাকে উত্তরে বললেন, ‘আপনি কোথায়’। বললাম, মাঝামাঝি। চটজলদি উনি (পুলিশ) বললেন, ‘দেরি হবে।’ এক যাত্রীর হাতে একটা ফরম দেখে জানতে চাইলাম, ‘এটা কী।’ উনি বললেন, ‘এটা আপনাকে পূরণ করে লাইনে দাঁড়াতে হবে।’ ইতিমধ্যে আমার লাইনে দাঁড়ানোর টাইম পার হয়েছে ৩৯ মিনিট। আমার স্ত্রীকে বললাম, ‘তুমি গিয়ে ফরম দুটি ফিলআউট করে নিয়ে আসো, আমি লাইনে আছি।’ সে গিয়ে ফরম নিল। দুর্ভাগ্য, তার হাতে কলম নেই। অদূরে একজন কলম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, হাঁকডাক দিচ্ছেন, ‘ভাই কলম আছে। আমি আপনাদের ফরম ফিল করে দেব।’ এর বিনিময়ে উনি তোফা চান। যাক, আমার স্ত্রী হ্যান্ডব্যাগে একটা কলম খুঁজে পেল। নাম-ঠিকানা, বয়স, আগমন-নির্গমন, পাসপোর্ট নম্বর লিখে দ্রুত লাইনে এল। তারপর তো আরেক কাণ্ড। সামনে দুজন সাদা চামড়ার লোককে লাইন থেকে সরিয়ে কোথায় জানি নিয়ে যাচ্ছেন একজন ইমিগ্রেশন পুলিশ। কাউন্টার থেকে একজন চলে যাওয়াতে বাকি একজন পুলিশ (আনইফিশিয়ান) লাইনটাকে আরও স্লো করে দিলেন। তখন ১১টা ২৫।

বলে রাখা ভালো, যুক্তরাষ্ট্র ও কাতার বিমানবন্দর ক্রস করতে সময় লেগেছিল ১ ঘণ্টা। এরপর সামনের লোকজন ধীরে ধীরে এগোতে থাকলেন। বেশ কয়েকজনকে পুলিশ চৌদ্দগোষ্টির নাম, ফরমের বাইরে হয়রানিমূলক প্রশ্ন করতে থাকে। আমি তা খুব মনোযোগসহ শুনতে থাকি। এবার আমার পালা। কথার স্টাইল থেকে বুঝতে কষ্ট হয়নি, উনি (পুলিশ) আমাকে অযথা প্রশ্ন করবেন। তার আগে আমি উনাকে বললাম, ‘আমি আপনার হাতে আমেরিকান পাসপোর্ট এবং আপনাদের দেওয়া ফরম পূর্ণ করা সব উত্তর দিয়ে দিলাম। অতএব আমাকে বাড়তি কোনো প্রশ্ন করে আরও ক্লান্ত করবেন না। আমি খুব ক্লান্ত।’ এদিকে আমার লোকাল ঢাকা-চট্টগ্রাম ফ্লাইটের সময় হয়ে গেছে। তারপরও অহেতুক তিনি দেশে কদিন থাকব, কখন, কোথায় থাকব, জানতে চান। উনাকে বললাম, ‘আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই না। আমাকে এসি ইমিগ্রেশনের নম্বর দিন।’ তখন হঠাৎ যেন তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। পাশে বসা অপরজন বললেন, ‘স্যার, আপনি যান।’ এরপর আবার জামেলা-ঝটলা, সেখানে পাসপোর্ট চেক করা হচ্ছে। অসহ্য…। এরপর লাগেজ কালেকশন। ট্রলির জন্য লাইনে দাঁড়ানোর জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। কী এক নতুন বাংলাদেশে এলাম। জুলাই বিপ্লবের পর অনেক আশা নিয়ে দেশে এসে আবারও আশাহত হলাম। আমার স্ত্রীকে বললাম, তুমি এখানে দাঁড়াও আমি লাগেজের কী অবস্থা, দেখি। দেখলাম, আমার বেওয়ারিশ লাগেজের পাশে একজন পাহারা দিচ্ছেন। উনি আমাকে অফার করলেন, ‘স্যার, আপনার কি গাড়ি লাগবে। আমি আপনাকে সব ধরনের হেলপ করব।’ বাহ চমৎকার। উনাকে শরীরে হাত-পা সবই আছে বলে বিদায় দিলাম। তারপর ভেতর দিয়ে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ধরতে যেতে দুই জায়গায় স্ক্যান, তার আগে আরেক দফা স্ক্যান। মোট তিন দফা স্ক্যান। উনাদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন ছিল, আমার এ লাগেজ পৃথিবীর নিখুঁত স্ক্যান মেশিনে স্ক্যান শেষে এখানে এসেছে। দুই জায়গায় জুতা খোলা মহা বিরক্তকর। অতক্ষণে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। যাক, স্রষ্টার বিশেষ অনুগ্রহে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের অপেক্ষা করলাম, যে জায়গায়, সেখানে উৎকট প্রশ্রাবের গন্ধ। এখন ঘড়িতে বেলা ১টা ৩০। পৌনে ২টায় উড়োজাহাজে চট্টগ্রামের পথে উড়াল দিলাম।

যুক্তরাষ্ট্র  থেকে নাড়ির টানে নিজ মাতৃভূমিতে পা রেখে যে অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম। দেশে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাজ কী, তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। পুলিশ কি জানে না, বিদেশি পাসপোর্ট নিয়ে দেশে আসা এ মানুষগুলো ২০-২৬ ঘণ্টা জার্নি করে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে নিজ দেশে ফিরছেন। একটা দেশের বিমানবন্দরে পা রাখলে সে দেশের চেহারা আয়নায় ধরা পড়ে। আমার মনে হয়, আমার দেশের বিমানবন্দরে যাত্রীবান্ধব ব্যবস্থাপনা আয়োজনে সক্ষমতা অর্জন সম্ভব হয়নি এখনো। আমি এত কথা বলার পেছনের কারণ কী। দীর্ঘ এক যুগ আগে পারিবারিকভাবে চেইন অভিবাসনের সুযোগে দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলাম। সে দেশে ঠিক আমার দেশের রিকশাপুলারের মতো কষ্ট করি, রাতে ভালো ঘুম হয়। আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো আছি। সে দেশে (আমেরিকায়) সরকারি-বেসরকারি অর্গানগুলোর একচিলতে হয়রানি এক যুগেও চোখে পড়েনি।   সামাজিকভাবেও কোনো দিন মনে কষ্ট পাওয়ার মতো বাক্য ব্যবহার কারও কাছ থেকে শুনিনি। হাজারো ভালো থাকলেও নিজ জন্মভূমি বাংলাদেশের জন্য মন কাঁদে। তাই ছুটে আসি ধানসিঁড়ি নদীর তীরে। জুলাই–আগস্টের জনতার বিপ্লব চলাকালে, যেদিন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হলো, সেদিন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসীদের কাটা মুরগির মতো ছটফটানি দেখতে পেয়েছি। মা-মাটির বেদনা কী, সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। সবাই বাবা-মা, প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বলতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। আমরা সেদিন শুধু কথা বলার স্বাধীনতার জন্য প্ল্যাকার্ড হাতে আমেরিকার রাজপথে নেমেছিলাম। অতএব পৃথিবীর যে দেশ থেকেই অকুতভয় বাংলাদেশিরা (বিদেশি পাসপোর্টধারী) দেশে আসুক—সামনে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন—বিমানবন্দরে হয়রানি বন্ধে জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপনের অঙ্গীকার করার অনুরোধ রইল।