কদম ফুল
এই রিকশা যাবে?
কই যাইবেন...
সদরঘাট।
নাহ, ঐদিক যামু না।
আচ্ছা শোনেন ঘণ্টা চুক্তি, কত নেবেন?
যামু না তো সদরঘাট...
আরে আজব, শোনেন আগে পুরো বাক্যটা। সদরঘাট যাওয়া লাগবে না, বললাম তো ঘণ্টা চুক্তি, আপনার যেদিক খুশি যাবেন, এক ঘণ্টা বা দুই ঘণ্টা পর আমাকে ঠিক এই বাসার সামনেই নামায় দেবেন।
ওহ, ঘণ্টা ১০০ টাকা ...
ওকে, ঘণ্টা ১০০ টাকাই দিব, বৃষ্টি আসলে কিন্তু বলবেন না ভাড়া বাড়ায় দিতে...এক ঘণ্টার মধ্যেই বৃষ্টি আসবে... না আসলে আরও এক ঘণ্টা ঘুরবেন, ২০০ টাকা দিব...
ঠিক আছে?
রিকশাওয়ালা ছোট চোখ আরও ছোট করে তাকাল, মনে মনে বোঝার চেষ্টা করছে এইটা কোন কিসিমের পাগল আজকে জুটল, মানুষ বৃষ্টি হইব শুনলে বাড়িত যায়, আর সে আইছে বৃষ্টি আইব শুইনা রিকশায় উঠতে...
ঘোর কলিকাল,
রাজি হবে নাকি টান দিয়ে চলে যাবে...এই রকম সাতপাঁচ ভাবতেই দেখে মেয়েটা রিকশায় উঠে বসে আছে, রিকশাওয়ালা আকাশের দিকে তাকিয়ে বেজার মুখে রিকশা চালানো শুরু করল...
আপনার নাম কী?
জে, পবিত্র কুমার।
আরি বাহ্, কী নাম...পবিত্র কুমার!
সামনে কোনো পূজা আছে আপনাদের?
না, মাস দুয়েক পর...
আচ্ছা সময় বলে দিলাম, ১১টা বাজে এখন, ১২টা পর্যন্ত যেদিক খুশি যান...এরপর ঠিক ১টায় আমাকে যেখান থেকে উঠিয়েছেন ঠিক সেখানেই নামায় দেবেন।
বৃষ্টি না আসলেও?
বৃষ্টি আসবে না মানে?
বৃষ্টির বাপ-মা খালা-ফুফু, চাচা-মামা সব আসবে, আমি আবহাওয়া রিপোর্ট দেখে বের হয়েছি...
পবিত্র কুমার বুঝতেছে না কোনোদিক যাবে, আজ যে কার মুখ দেখে ঘুম ভাঙছে...
দুইডা শালিক দেইখা যতদূর মনে লয়, শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে তো দুইডা শালিকই দেখছিল ...
আচ্ছা পবিত্র কুমার, আপনি রিকশা চালায় দিনে কত টাকা পান?
একেক দিন একেক রকম, কাস্টমার বুইজা, কোন ঠিক ঠিকানা নাইকা।
মোবাইল বাজছে...
হ্যালো...
কোথায় তুমি?
রিকশায়
কেন? গাড়ি নষ্ট?
নাহ, বৃষ্টিতে ভিজব বলে বের হয়েছি, আবহাওয়া রিপোর্টে বজ্রসহ বৃষ্টি দেখাচ্ছে... গোমড়া মুখে ঘরে বসে থাকা অপেক্ষা বৃষ্টিতে ভেজা উত্তম, ঠিক না?
তুমি কি সব সময়েই এমন?
কেমন?
আচ্ছা আমি আসি?
কেন?
তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে...
তুমিও কি এমন?
কেমন?
এই যে সারাক্ষণ আমাকে কপি করো...
নিলয় বেশ উচ্চ স্বরে হেসে দিলো, হাসতে হাসতেই বলল, কোন এলাকায় আছ বলো, আসছি...
মগবাজার...
আচ্ছা ফোন রাখছি
ফোন রাখে না, নিশাত শোনো... নিশাত
নিলয় মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে...
এখন ফোন দিলে নিশাত আর ধরবে না...
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিলয় ঘড়ি দেখে বিছানা থেকে নেমে ঝটপট রেডি হয়ে দরজা খুলে নিচে নেমে গেল...
পেছন থেকে নিলয়ের মা ডাকল, নাশতা করে যাও...
এখন আসি মা, দুপুরে একসাথে খাব...
গাড়িতে উঠেই ড্রাইভার কে বললো তাড়াতাড়ি মগবাজার চলেন...
পবিত্র কুমার, আপনার বাসায় কে কে আছেন?
বাপ মা বউ আর এক মেয়ে, হেরা সব গ্রামে থাকে।
আর একটু পরেই বৃষ্টি আসবে, আপনি মাথায় টুপি বা প্লাস্টিকের পট্টি বেঁধে ফেলেন।
কিছু লাগত না আপা, আমরার তো বৃষ্টির পানিত ভেজাই লাগে,আপনাকে প্লাস্টিক দিব?
চুপচাপ রিকশা চালান, বেশি কথা বলে...
পবিত্র কুমারের খুবই মন খারাপ, বড়লোকের মেয়েদের মাথার তার ছেঁড়া থাকে, নিজেই জিগাইল, নিজেই চুপ করতে কয়...
চারপাশে দমকা হওয়া...
ঝড় আসতেছে...
নিশাত বাঁ হাতে শক্ত করে রিকশা ধরে আছে, আবারও মোবাইল বাজছে...
হ্যালো...
মগবাজার কই? আমি মগবাজারে...
মগবাজার ছিলাম ৩০ মিনিট আগে,
এখন ধানমন্ডির কাছে, রাস্তা ফাঁকা...
নিলয় কপাল কুঁচকে ফেলল,
কিছু একটা বলতে গিয়েও গিলে ফেলল।
বলল লেকের পাশে গিয়ে রিকশা থামাও আমি আসছি...
রিকশা থামানো যাবে না।
রিকশাওয়ালার সঙ্গে দুই ঘণ্টা চুক্তি, নো থামাথামি।
তাহলে তো আমি ধানমন্ডি যেতে যেতে তুমি লালমাটিয়া চলে যাবা!
গাড়ি নিয়ে যদি একটা রিকশা ধরতে না পারো,
তাহলে আমি কী করব?
তুমি এমন করো কেন?
আশ্চর্য, আমি কী করলাম।
পিছু লাগছ তো তুমি,
Catch me if you can...
নিলয় ড্রাইভারকে বলছে তাড়াতাড়ি ধানমন্ডি যান তাড়াতাড়ি... মনে মনে ভাবছে জিগাতলার দিকে যেতে হবে, নিশাত লালমাটিয়া যাবে না, এই মেয়ের কাজ—উল্টো কাজ করা...
কিছুটা দুশ্চিন্তা লাগছে।
বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল...
মেঘের গর্জন বাড়ছে।
এর মধ্যে নিশাত একা রিকশায়...
মনে হয়না বাসায় কাউকে বলে বেরিয়েছে।
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে, একটু দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
হুট ফেলে দিয়েছে নিশাত।
মন ভালো হয়ে গেল...
ভিজে একদম চুপসে গেছে, জামাকাপড় সব গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে, আড়চোখে চারপাশে তাকাল, কেউ তাকিয়ে আছে কি না...একটা কাক ব্রিজের রেলিংয়ে বসে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখছে।
পবিত্র কুমার, ব্রিজের গোড়ায় রিকশা থামান কিছুক্ষণ...
কেউ আইব আপা?
নাহ, যে আসার সে লালমাটিয়া নয়তো ঝিগাতলা যাবে, তারপরে আবার ফোন দিবে, এখানে আসবে না...
কেমনে বুঝলেন?
ছেলেরা দুই পদের হয়, এক পদ বেকুব আর এক পদ ঝামেলার।
কিন্তু সহজ একটাও না...
ওহ্, আপা যে আসতে চাইছিল সে কোন পদের?
সেইটা আপনার জানতে হবে না...
আইচ্ছা, মেয়েরা কয় পদের আপা?
অনেক পদের... গুনে শেষ হবে না...
আবার মোবাইলের রিং হচ্ছে...
কই তুমি?
শিরীষ গাছের নিচে
সে তো ধানমন্ডি লেকে
তাই তো বলেছিলাম মনে হয়...
রিকশা আর আগায়নি?
মুষলধারায় বৃষ্টি, রিকশা আগাবে কীভাবে?
সামনে কিছু দেখা যাচ্ছে না তো
তুমি বৃষ্টিতে ভিজে গেছ?
কী মনে হয় তোমার?
ওখানেই থাকবে নাকি অন্যদিকে যাবে?
নিলয় ড্রাইভারকে কাগজে লিখে দিল, ধানমন্ডি লেকে যান...
জানি না...
আচ্ছা, ফোন রাখি, ফোন ভিজে যাচ্ছে...
পবিত্র কুমার, এক ঘণ্টা হয়ে গেছে, বাসার দিকে যান...
রিকশা চলতে শুরু করল...
নিশাত মনে বেশ আনন্দ নিয়ে ভিজছে...
কেন যে গান গাইতে পারে না...
তাহলে গুনগুনিয়ে গাওয়া যেত এসো নীপবনে ছায়া...
কলাবাগান পার হয়ে যাচ্ছে রিকশা...
আবারও ফোন বাজছে...
হ্যালো,
শোনো, আমি কোথায় আমি কোথায় না বলে আমাদের বাসার সামনে যাও, তাহলে অন্তত আমার আগেই বাসায় পৌঁছাবে ...
কপাল কুঁচকে নিলয় বলল তুমি এমন কেন?
আমি সহজ, তোমার মতো বেকুব না...
এখন কই আছ বলবা?
বলে লাভ নেই ধরতে পারবে না আমাকে...
যেটা বললাম সেটা করো।
তোমার সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজার শখ ছিল...
খুব শিগগির মরে না গেলে হয়তো শখ পূরণ হবে কোনো দিন।
আজকে না কেন?
তুমি তো আমাকে ধরতে পারলে না, আমি রিকশায়।
তুমি গাড়িতে... তা–ও পারলে না,
ফোন রাখছি।
নিলয় ড্রাইভারকে বলল, মগবাজারে যান...
মনের ভেতরে চাপা কষ্ট, দুশ্চিন্তা, বিরক্তি তিনটিই—
এখনো বৃষ্টি পড়ছে, তবে তেজ কমে এসেছে...
তবুও ভিজতে ভালো লাগছে নিশাতের...
দুইটা চড়ুই কাকভেজা হয়ে ইলেকট্রিসিটির তারে বসা, আশপাশের সব রিকশা পলিথিন দিয়ে ঘেরা...
তার ভেতর থেকে কিছু জোড়া চোখ নিশাতকে দেখছে...
রিকশার হুট উঠিয়ে দিল নিশাত...
হালকা ঠান্ডা লাগছে, সঙ্গে কাঁপুনি।
মোবাইল বেজে যাচ্ছে, ধরল না আর নিশাত ...
তাড়াতাড়ি চলেন পবিত্র কুমার, ঠান্ডা লাগছে।
বৃষ্টি থামলেই রাস্তায় ভীষণ ট্রাফিক জ্যাম লেগে যাবে...
তার আগেই বাসায় যেতে হবে।
বেশ খানিক সময় পর রিকশা নিশাতের বাসার সামনে এসে থামল...
রাস্তার উল্টো পাশে নিলয়ের গাড়ি, কিন্তু নিলয় নেই গাড়িতে, শুধুই ড্রাইভার বসা...
নিশাত সেটি লক্ষ্য করে হাসল, রিকশাওয়ালাকে দুটি ১০০ টাকার নোট আর একটি ৫০০ টাকার নোট দিয়ে বলল, রেখে দেন।
২০০ টাকা আপনার ভাড়া, আর ৫০০ টাকা আপনার বাসার প্রত্যেকের জন্য, ১০০ করে, দুই মাস পরের পূজাতে নাড়ু খাওয়ার জন্য..., আপনি মানুষ ভালো।
নিশাতের ঠোঁট ঠক ঠক করে কাঁপছে কথা বলার সময়, সে রিকশা থেকে নেমে বাসার গেটের ভেতরে ঢুকে গেল...
পবিত্র কুমার তাকিয়ে আছে, সব বড়লোকের মেয়ে পাগল না, দুই একটা সহজ। আজ দুই শালিক দেখেছিল...
দুই শালিকে আসলেই খুশির খবর আসে।
আবার বৃষ্টি শুরু হলো...চোখের পানি বৃষ্টির পানিতে মিশে গেল।
দরজার সামনে নিলয় দাঁড়ানো, কদম ফুল হাতে...
নিশাতের দিকে তাকিয়ে বলল, ধরে ফেলছি কিন্তু তোমাকে।
হু, শেষ পর্যন্ত আমার কথা শুনছ যে...