মুক্তিযুদ্ধে কানাডার অবদান: কূটনৈতিক, মানবিক সহায়তা ও যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসন
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতি কানাডার সরকার, সাধারণ জনগণ ও গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অনন্য। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যা, ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কানাডা কূটনৈতিকভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, শরণার্থীদের জন্য বিপুল পরিমাণ মানবিক সহায়তা পাঠায় এবং যুদ্ধ শেষে যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে সহায়তা করে।
কানাডার কূটনৈতিক ভূমিকা—
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম অবস্থান নেওয়া দেশগুলোর একটি কানাডা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে অনেক পশ্চিমা দেশ প্রথম দিকে নীরবতা পালন করলেও কানাডা দ্রুতই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে।
১. পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করা
কানাডা যুদ্ধ চলাকালেই পাকিস্তানের প্রতি সব ধরনের আর্থিক সহায়তা স্থগিত করে। বিশেষ করে, তারা পাকিস্তানে চলমান অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর জন্য অর্থ বরাদ্দ করা বন্ধ করে দেয়।
২. স্বাধীনতার পর দ্রুত স্বীকৃতি প্রদান
যুদ্ধ শেষে অনেক পশ্চিমা দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের কথা ভেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে দেরি করছিল। কিন্তু কানাডা ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়।
৩. জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশকে সমর্থন
বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ পেতে সহায়তা করতে কানাডা কূটনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিল। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ও কানাডার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়।
৪. মানবিক সহায়তা
১৩ মিলিয়ন ডলারের ত্রাণ এবং সরাসরি শরণার্থী সহায়তা করে কানাডা। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি ভারতে আশ্রয় নেয়, যা ভারত ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি বিশাল মানবিক সংকট সৃষ্টি করে। এই সময় কানাডা শরণার্থীদের জন্য খাদ্য, ওষুধ ও জরুরি সহায়তা প্রদান করে।
ওক্সফাম কানাডা ও সিডা (CIDA)-এর সহায়তা
• ওক্সফাম কানাডা: ভারতীয় শরণার্থী ক্যাম্পগুলোর জন্য খাদ্য, পোশাক ও ওষুধ সরবরাহ করে।
• সিডা (Canadian International Development Agency): বাংলাদেশ পুনর্গঠনের জন্য আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে।
চিকিৎসা সহায়তা ও আন্তর্জাতিক দল পাঠানো
কানাডা থেকে বেশ কয়েকটি চিকিৎসাদল বাংলাদেশ ও ভারতীয় শরণার্থী ক্যাম্পে কাজ করেছে। তারা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করেছে এবং যুদ্ধাহত নারীদের সহায়তা প্রদান করেছে।
বাংলাদেশি-কানাডিয়ানদের ভূমিকা: প্রবাসীদের সংগ্রাম
১৯৭১ সালে কানাডায় বাংলাদেশি অভিবাসীদের সংখ্যা কম থাকলেও তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লবিং ও তহবিল সংগ্রহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১. কানাডায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার
বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও অভিবাসীরা কানাডায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ও সামাজিক সংগঠনে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে প্রচারণা চালান। তাঁরা কানাডার সংসদ সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অপরাধ সম্পর্কে প্রচার চালান এবং যুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন।
২. বিশিষ্ট বাংলাদেশি-কানাডিয়ানদের অবদান
• ডা. জহির উদ্দিন: তিনি কানাডার রাজনৈতিক নেতাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব তুলে ধরতে কাজ করেন।
• মোহাম্মদ এ করিম: অর্থ সংগ্রহ ও প্রচারাভিযানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
• এম নুরুল ইসলাম: তিনি শরণার্থীদের সহায়তা ও পুনর্বাসনে ভূমিকা রাখেন।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসন: কানাডার অনন্য উদ্যোগ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় দুই লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হন এবং বহু যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়। এদের অনেককে সমাজ গ্রহণ করতে চায়নি। এর ফলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়।
১. কানাডার দত্তক গ্রহণ কর্মসূচি—
• যুদ্ধ শেষে কানাডার বহু পরিবার যুদ্ধশিশুদের দত্তক নেয়
• আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকার দত্তক প্রক্রিয়ার তদারকি করে
• অনেক যুদ্ধশিশু কানাডায় বড় হয়ে সাফল্যের সঙ্গে জীবন গড়ে তোলে
২. চিকিৎসা ও মানসিক পুনর্বাসন—
কানাডা থেকে চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীদের দল বাংলাদেশে এসে যুদ্ধশিশু ও ধর্ষণের শিকার নারীদের মানসিক পুনর্বাসনে সহায়তা করে।
৩. শিক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা—
কানাডার বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও যুদ্ধশিশুদের জন্য শিক্ষা ও পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করে।
বাংলাদেশ-কানাডা সম্পর্কের ভিত্তি
১৯৭১ সালে কানাডার সহযোগিতা ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-কানাডার কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করেছে।
• কানাডা বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার
• যুদ্ধের পর থেকেই কানাডা বাংলাদেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছে
• কানাডা থেকে বছরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি বাণিজ্য হয় বাংলাদেশের সঙ্গে।
২০২৫ সালে এসে কয়েক লাখের বেশি বাংলাদেশি কানাডায় বসবাস করছেন। মুক্তিযুদ্ধে কানাডার এই অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। দুই দেশের এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ভবিষ্যতেও অটুট থাকবে বলে আশা করেন বাংলাদেশিরা।