ব্রিটিশ উপনিবেশ, বর্তমান বাস্তবতা আর আমার দেখা ব্রিটেন

রানি এলিজাবেথের মৃত্যুর পর বাংলাদেশসহ সামাজিক মাধ্যমে বেশ বিরূপ মন্তব্য দেখে আমার মনে হচ্ছিল, এই ইস্যু নিয়ে কিছুটা লেখা উচিত। বাংলাদেশে বসে কখনো ব্রিটেনের পরিবেশ আঁচ করা সম্ভব নয়, আজ যুক্তরাজ্যে প্রায় ১০ লাখ বাংলাদেশি থাকলে সেটি রানি এলিজাবেথের বদলে দেওয়া আধুনিক রাষ্ট্র ব্রিটেনের ফসল। তাঁর শাসন আমলে যুক্তরাজ্যব্যাপী সব ধর্ম-বর্ণের মানুষদের সমানভাবে বসবাসের জন্য একটি অনন্য উদাহরণের সৃষ্টি হয়েছে। ইতিহাস আমাদের সংযুক্ত করেছে, যার কারণে আজ হয়তো ব্রিটেনে আমার বসবাস।

কমনওয়েলথ দেশগুলোর সঙ্গে শক্ত ইউনিয়ন সৃষ্টি করা ও পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর জন্য অর্থসহায়তা কার্যক্রম ও সামাজিক উন্নয়নে বিভিন্ন চ্যারিটেবল কার্যক্রমে সর্বদা নিয়োজিত ছিলেন রানি ও রাজপরিবারের সদস্যরা। রানির আগের যে ব্রিটিশ শাসকেরা ছিলেন, ইতিহাসের পাতায় একেকজনের ভূমিকা একেক রকমভাবে মূল্যায়ন করা হয়। ইতিহাস মূল্যায়ন করলে যেখানে কালো অধ্যায়ই বেশি। ঔপনিবেশিক ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে ইউরোপে শুধু ব্রিটিশদের ইতিহাস নয়, ফ্রেঞ্চ, ডাচ, পর্তুগিজ সবারই কালো অধ্যায় রয়েছে।

তবে ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ক্ষমতায় আরোহনের পর বরং পূর্বের ঔপনিবেশিক ধারণার চেয়ে ব্রিটেনকে আরও আধুনিক ও মডেল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ছিল বেশি এবং তিনি তা করতে সক্ষম হয়েছেন। অনেকেই দেখছি, ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশের জন্য রানি এলিজাবেথকে দায়ী করছেন, ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয় ১৯৪৭ সালে, অথচ রানি এলিজাবেথ রাজপরিবারের ক্ষমতা বুঝে নেন ১৯৫২ সালে। ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে আসার প্রায় পাঁচ বছর পর রানি ক্ষমতা লাভ করেন, অথচ অজ্ঞতা বা সঠিক ইতিহাস না জেনে অনেকেই অন্যের শাসন আমল রানির নামে চালিয়ে দিচ্ছেন। ব্রিটিশ উপনিবেশ আর আজকের মডার্ন ব্রিটেনের চরিত্র এক নয়। সময়ের সঙ্গে বিশ্ব বদলে গেছে, বদলেছে রাজপরিবারের ধরন ও কার্যক্রমও।

রানি শাসনকার্যে তাঁর পূর্বসূরিদের অনুসরণ না করার একটি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ১৯৫৩ সালে বড়দিনের সম্প্রচারে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ বলেছিলেন, ‘কিছু মানুষ প্রত্যাশা করেছিলেন যে আমার শাসন নতুন একটি এলিজাবেথীয় যুগের সূচনা করবে। সত্যি বলতে কি, আমি নিজেকে আমার মহান পূর্বসূরিদের মতো মনে করি না।’ বিশ্বের নানা প্রান্তে এ ধরনের সফরের মাধ্যমে রানি এলিজাবেথ সাধারণ মানুষের মুখোমুখি হতেন। জীবনের পথচলায় শতাধিক দেশ সফর করেছেন তিনি এবং বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষের জীবনকে ছুঁয়েছেন, জানতে চেয়েছেন তাদের জীবন সম্পর্কে।

রানি এলিজাবেথের শাসন আমলে ব্রিটেনের অসাধারণ সব পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে সব ধর্মের আর সংস্কৃতির মানুষদের একসঙ্গে সমান অধিকার নিয়ে বসবাসের যে পরিবেশ, সেটি রানির হাতেই রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলাদেশিসহ যুক্তরাজ্যে বসবাসরত সারা বিশ্বের সব ধর্ম-বর্ণের কাজের স্বীকৃতি, সম্মান দিয়েছেন রানি। এ ব্রিটেনে কোনো গুণী মানুষের অবমূল্যায়ন হয়নি।

রানি ২০০২ সালে একটি মসজিদ পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। সেটি ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পরের বছর। সেই সময় মুসলিমদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোতে চলছে চরম বিদ্বেষ। প্রতিনিয়তই বাড়ছে ইসলামোফোবিয়া। ঠিক তখন রানি ব্রিটিশ রাজ–ইতিহাসে প্রথম কোনো শাসক হিসেবে মসজিদ পরিদর্শনে যান। এরপর তিনি আরব আমিরাতের শেখ জায়েদ মসজিদও পরিদর্শন করেন। শুধু ইসলাম ধর্মের উপাসনালয় নয়, যুক্তরাজ্যে প্রায় সব ধর্মের উপাসনালয়ে রানি ভ্রমণ করেছেন। সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, স্বীকৃতি আর সবার সমান নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে রানির প্রয়াসের এটি অন্যতম উদাহরণ।

ইউরোপের দেশে দেশে ভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্মের মানুষদের জন্য বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ খুব কম রয়েছে, যেটা যুক্তরাজ্যে বিরাজমান। ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতির অবাধ এক পরিবেশ, যা সারা বিশ্বে বিরল এবং একটি দেশ থেকে আধুনিক ব্রিটেনের এই অর্জনের অন্যতম দাবিদার রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ৭০ বছর সিংহাসনের সফল পরিচালনা আর ৯৬ বছরের কী দারুণ এক জীবন! আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা। মানুষের ভালোবাসায় আর স্মৃতিতে আপনি বেঁচে থাকবেন চিরকাল।
*লেখক: নাঈম হাসান, শুভেচ্ছাদূত, ক্যানসার রিসার্চ ইউকে, ইয়ুথ কমিটি মেম্বার, প্রিন্সস ট্রাস্ট ইংল্যান্ড।