জার্মানির ফিল্ডহাইম বায়ুবিদ্যুৎ হতে পারে আমাদের জন্য আদর্শ

এ বছরের ১৭ মার্চে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব বার্লিন (TU Berlin) কর্তৃক আয়োজিত একটি শিক্ষা সফরে গিয়েছিলাম বার্লিনের অদূরে ফিল্ডহাইম গ্রামে। এ সফরটি ছিলো আমাদের পাঠ্যসূচির সঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক। এ গ্রামটি মূলত ব্রান্ডেনবুর্গ ট্রুয়েনব্রিয়েটজেন শহরের একটি শান্ত-সুনিবিড় গ্রাম।
জার্মানির রাজধানী বার্লিন থেকে ৬০ কিলোমিটার (প্রায় ৩৭ মাইল) দক্ষিণ-পশ্চিমে এ আদর্শ গ্রামটি অবস্থিত। বাসিন্দা মাত্র ৪৯টি পরিবারের ১৩০ জন। আদর্শ বলছি এ কারণে যে এ গ্রামটি পুরোপুরি স্বনির্ভর তাদের নবায়নযোগ্য উৎস হতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে। নিজেরা তাঁদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে আবার জাতীয় গ্রিডেও সরবরাহ করছে। বাসিন্দাদের প্রত্যেকেই এ উৎপাদন কর্মকাণ্ডের অংশীদার।
ফিল্ডহাইমের এ নবায়নযেগ্য উৎস হতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যাত্রা শুরু ১৯৯৫ সালের শুরুর দিকে। প্রকৌশলী ছাত্র মাইকেল রাশেম্যান স্থানীয় কৃষি সমবায়ের মালিকানাধীন জমিতে প্রথম চারটি বায়ু টারবাইন স্থাপন করেন। সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ছিলেন ফিল্ডহাইম গ্রামের সব কটি পরিবার। ৪টি থেকে বেড়ে এখন টারবাইনের সংখ্যা ৬০টি।

অবশিষ্ট টারবাইনগুলো এখন ২৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে অথচ গ্রামবাসীর জন্য দরকার মাত্র ২ মেগাওয়াট। বাকি ২৩৮ মেগাওয়াট তাঁরা স্থানীয় গ্রিডে দিচ্ছেন। নবায়নযোগ্য উৎস হতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন তাঁরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কারও ইতিমধ্যে জিতে নিয়েছেন তাঁরা।

গ্রামবাসীর এ যৌথ উদ্যোগের নাম ‘নিউ অ্যানার্জি ফোরাম।’ পাতাল কেব্‌লের সাহায্যে তাঁদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ যাচ্ছে স্থানীয় গ্রিডে। দৃষ্টিনন্দন আর চিত্রায়িত একটি ব্যাটারি ঘরও আছে এই অ্যানার্জি ফিল্ডে। এ ব্যাটারি ঘরটি দুই দিন চলার উপযোগী পরিমাণ বিদ্যুৎ সঞ্চয় করে রাখতে পারে। পাওয়ার প্ল্যান্টে শক্তি প্রবাহ সঠিকভাবে না থাকলে ব্যাটারি ঘর তা তাদের নিজেদের গ্রিডে ফিরিয়ে দেয়। ১০ দশমিক ৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চয় করে রাখতে পারে এই ব্যাটারি ঘর।

এ গ্রামে এখনো একটি সুন্দর প্রথা চালু আছে, আর তা হলো এখানে কোনো নতুন শিশুর জন্ম হলে তাঁদের উদ্যানে একটি নতুন চারাগাছ রোপণ করা। তবে তা বছরে তিনটার বেশি হয় না কখনো, কারণ তাদের নিম্ন জন্মহার।

অনেক চড়াই–উৎরাই পার হতে হয়েছে বিদ্যুতে এমন স্বনির্ভরতা পেতে। এখন তাদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ গ্রামের বাসিন্দাদের চাহিদার তুলনায় প্রায় শতগুণ বেশি। তাই নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর পর অবশিষ্ট ৯৯ শতাংশ বিদ্যুৎ জার্মানির এনার্জি বাজারে বিক্রি করে দিতে পারছে এ ফোরাম।

প্রথমে উয়িন্ড টারবাইন দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যাত্রা শুরু হলেও পরে গ্রামবাসীরা একটি বায়োগ্যাস প্ল্যান্টও নির্মাণ করেন। ভুট্টাজাতীয় খাদ্যশষ্যের সাইলেজ ও তাদের পশু খামারের সার থেকে মিথেন গ্যাস তৈরি করে আর সেই গ্যাস থেকেই ফিল্ডহাইমের বাড়িগুলোর ঘর গরম করার কাজ চলে। তাঁদের এখন নিজস্ব একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রিডও আছে। নবায়নযোগ্য শক্তি সংস্থা ‘এনার্জিকুয়েল’ আর গ্রামবাসীরা সবাই মিলে একটি সৌর খামারও তৈরি করেছেন আর সেই খামার থেকে কমপক্ষে ৬০০ পরিবার চলার মতো বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। তাঁদের এই সিটিজেন মোবাইল সোলার সূর্যকে ট্র্যাক করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এখন ফিল্ডহাইম সম্পূর্ণ কার্বন নিরপেক্ষ একটি গ্রাম। তেল, গ্যাস আর কয়লা থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ক্ষতিকর কার্বন নির্গমনের প্রভাব থেকে বের হয়ে আসার প্রতিজ্ঞা করেছিলরন তাঁরা, তাই আজ তাঁদের এ সাফল্য। কার্বন নিঃসরণ কমানোর পক্ষে গ্রামবাসীদের পরিপূর্ণ মত থাকলেও রাশেম্যানের কাছে ছিল তাঁদের হাজারো প্রশ্ন এর সফলতা নিয়ে। আর এ সফল গ্রামটি এখন জার্মানির সবার কাছে আদর্শ একটা গ্রাম। বছরে তিন হাজারেরও বেশি দর্শনার্থী আসেন ফিল্ডহাইমে, গ্রামবাসীর সফলতা নিজ চোখে দেখতে।

পর্যটকদের আগমনে গর্বিত ফিল্ডহাইমবাসী। আমাদের পুরু দল খুব সমাদ্রিত হয়েছি এখানে। পুরো গ্রাম ঘুরে দেখেছি অবাক বিস্ময় নিয়ে। ফিল্ডহাইম এখন একটি পূর্ণ পৌরসভা। কৃষিতেও শতভাগ সফলতা এনেছে তাঁরা সমবায় সমিতির মাধ্যমে। তাঁদের উৎপাদিত প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের (ঘণ্টায়) ১৬.৬ সেন্ট। জার্মানির অন্যান্য জায়গায় বিদ্যুতের দাম এর প্রায় দ্বিগুণ।

শুরুতে সম্ভবত স্বয়ং রাশেম্যানের মনেও এর অভূতপূর্ব সফলতা নিয়ে এমন নিশ্চিত ছিলেন না। রাশেম্যান ১৯৯৫ সালের এক বসন্তে মাত্র ৪টি উইন্ড টারবাইন নিয়ে এর যাত্রা শুরু করলেও এর সম্ভাবনা নিয়ে গ্রামবাসীর মনেও ছিল একরাশ চৈত্রের খরা। ফিল্ডহাইমের সাফল্যের অগ্রনায়ক সেদিনের ছাত্র রাশেম্যান আজ একটি জ্বালানি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ঋণ আর অথোরাইজেশন ম্যানেজ করে এ সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদনের যাত্রার শুরুটা খুব সহজ ছিল না। তবে এখন তাঁদের ব্যর্থতার হার শূন্যের কোঠায়। আশপাশের গ্রামে কদাচিৎ বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলেও ফিল্ডহাইমে কখনোই বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়নি। বর্তমান মেয়র পেট্রা রিখটারও তখন গ্রামবাসী হিসেবে এই অভূতপূর্ব যাত্রায় সামিল ছিলেন। এ গ্রামে এখনো একটি সুন্দর প্রথা চালু আছে, আর তা হলো এখানে কোনো নতুন শিশুর জন্ম হলে তাঁদের উদ্যানে একটি নতুন চারাগাছ রোপণ করা। তবে তা বছরে তিনটার বেশি হয় না কখনো, কারণ তাঁদের নিম্ন জন্মহার।

জার্মানির অফশোর বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র উত্তর এবং বাল্টিক সাগরে অবস্থিত, সেখান থেকে ৭.৭ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। বর্তমানে বৈশ্বিক জ্বালানির উৎসের অপ্রতুলতার মধ্যে জার্মানি ২০৩০ সালের মধ্যে এই বায়ুবিদ্যুৎ থেকে ৩০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। জার্মানি বিশ্বে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে তৃতীয়।

প্যারিস চুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য অন্যান্য দেশের মতো আমার বাংলাদেশও তার লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে। নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৪১০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে। বঙ্গোপসাগর হতে পারে আমাদের জন্য অফশোর বায়ু উৎপাদনের উপযুক্ত স্থান। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রিনিউয়েবল এনার্জি ল্যাবরেটরি ২০১৮ সালে তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশ দৈনিক ৩০ হাজার মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম।

আমাদের দেশে ইতোমধ্যে সোলার পিভি প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যাত্রা শুরু হয়েছে বেশ জোরেশোরে। অনশোর উইন্ডও আছে আমাদের সীমিত আকারে। নবায়নযোগ্য উৎস হতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের জন্যে তাই ফিল্ডহাইম গ্রামটি হতে পারে একটি আদর্শ।

লেখক: তৌহিদা নাজনীন। টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব বার্লিন, জার্মানিতে European and International Energy Law (Masters of Business Law-M.B.L) বিষয়ে অধ্যয়নরত