যদি ভালো না লাগে তো দিয়ো না মন

অলংকরণ: আরাফাত করিম

এখন একটু একা, একান্ত কিছু সময় রিয়ার প্রয়োজন। জীবনের হিসাব-নিকাশ মেলাতে হবে। ও বসে আছে পাহাড়ের চূড়ায়। সামনে প্রশান্ত মহাসাগর। সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়। অনেক ইচ্ছা ছিল, সূর্যাস্ত দেখবে একদিন কারও হাত ধরে। কিন্তু সূর্যাস্তের পরপরই মাগরিবের নামাজের সময় হয় বলে আয়েজ কোনো দিন আসতে চায়নি। রিয়ারও নামাজের চেয়ে প্রয়োজনীয় কিছু দেখার ইচ্ছা হয়নি কখনো। আজকে দেখছে, সূর্যাস্তের পর গাড়িতে নামাজ পড়ে নিল ও আজকে।
ও বসে আছে টোরি পাইন সমুদ্রসৈকতে পাহাড়ের ওপর একটা জায়গায়। দেখছে স্বাস্থ্যসচেতন মানুষেরা হাঁটছে। পাশেই ইউসিএসডি ক্যাম্পাস। ছাত্রছাত্রীরা দৌড়াচ্ছে আর কিছু যুগল হাত ধরে হাঁটছে। কি অপার্থিব সুন্দর একটা পরিবেশ! তবে ওর জীবনে সন্ধ্যা নেমে এসেছে এই তো কয়েক বছর হয়েছে। ২০ বছরের বিবাহিত জীবন। সন্তান আছে। অথচ…
রিয়ার বিয়ে হয়েছে ২০ বছর হয়েছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স পড়ে তখন ও। বাসা থেকেই পড়ে। বাসার ছোট মেয়ে, মা, বাবা বা একমাত্র ভাই পৌঁছে দিত ভার্সিটিতে। কখনোই একা যেতে দিত না। এটা নিয়ে ওর সহপাঠীদের সে কি হাসাহাসি। এর মধ্যে দূরসম্পর্কের চাচাতো ভাই আয়েজ দেশে বেড়াতে এসেছিল। বয়সে প্রায় ১০ বছরের বড়। বিয়ের কনে দেখতে। চাচা-চাচির বাসায় বেড়াতে এসে রিয়াকে দেখে। একটা চঞ্চল প্রজাপতি যেন। ওকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করব না, সে জানিয়ে দেয়। রিয়ার পরীক্ষার অল্প কয়েক মাস বাকি তখন। মা-বাবাকে আয়েজ বলেই ফেলল, পড়াশোনার দরকার কী। বিয়ের পর তো ও আমেরিকা থাকবে। আমি চাকরি করি, আমার ঘরের রানি হয়ে থাকবে ও।

সব শুনে রিয়া মাকে বলেছিল, মা, আমি তার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। ছেলে আমেরিকা থেকেও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে জেনে রিয়ার মায়ের খুব পছন্দ আয়েজকে। বলেছিলেন, খবরদার, উল্টাপাল্টা কোনো কথা বলবি না। রিয়া বলেছিল, মা একটু কথা না বলে কীভাবে জানব, মানুষটা কেমন? মা মুঠোফোন নম্বরটা দিলেন। রিয়া ফোন করে বলেছিল, আপনি আপনার সংসারের কাজকর্মের জন্য একজন বুয়া চাইছেন, বউ না। গ্রাম থেকে বিয়ে করে নিয়ে যান প্লিজ। সেই বউ কাজও করবে ঘরের, বাইরে কাজ করার জন্য ইচ্ছাও প্রকাশ করবে না। আয়েজ খুব হেসেছিল শুনে। তারপর বলেছিল, আমি যে তোমাকেই চাই। বিয়ের পর তুমি কী করবে, সেটা নাহয় দুজনে মিলে ঠিক করব। কথাটায় এমন কিছু ছিল, রিয়া কেমন যেন প্রেমে পড়ে গেল লোকটার। বিয়ে হয়ে গেল এর কিছুদিন পর। আয়েজ চলে গেল আমেরিকায়। রিয়া মন দিয়ে পড়ে পরীক্ষা দিল। এই কয় মাসে ভিসার ব্যবস্থা হয়েছে। রিয়া চলে এল আমেরিকা।

সংসারটাকে আপন করে নিল ও। বাসা গোছানো, আয়েজ বিকেলে এলে তাদের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট থেকে একটু সময়ের জন্য বাসার সামনের পার্কে ঘুরে আসা। সবকিছু সুন্দর চলছিল। কিন্তু পড়াশোনা করতে চাইলে বা গাড়ি চালানো শিখতে চাইলেই আয়েজ সরাসরি না করত। বলত, আমার আয়ে সংসার চলছে, এভাবেই চলবে। অথচ একটা কিছু খেতে গেলে বা সামান্য কিছু কিনতে গেলেও চেয়ে নিতে হয় টাকা। আয়েজ যথেষ্ট কৃপণ। রিয়ার প্রজাপতি মনটা খুব কষ্ট পেত, কিন্তু মানিয়ে নিত মন। তবু আয়েজ ভালো থাকুক। তিন বছরে মেয়ে সাবিহা এল তাদের জীবনে।

মেয়ে এলিমেন্টরিতে থাকতে হেঁটেই স্কুলে নিয়ে যেত রিয়া। তখন কয়েকটা বাচ্চার মায়েদের সঙ্গে ওর অনেক বন্ধুত্ব হয়েছে। তাদেরই একজনের কাছে বিনা পয়সায় গাড়ি চালানো শিখতে শুরু করল রিয়া। আয়েজ জানল অনেক পরে। প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল সেদিন সে। কিন্তু পরের বছর মিডল স্কুল অনেকটা দূরে হওয়াতে একটা ছোট পুরোনো গাড়ি আয়েজকে কিনে দিতে হয়েছিল। ড্রাইভিং টেস্ট দিতে অবশ্য ও নিয়ে যায়নি। সাবিহার বান্ধবীর মা নিয়ে গিয়েছিলেন। পাস করামাত্র কি যে খুশি হয়েছিল রিয়া, অথচ বাসায় এসে দেখেছিল আয়েজের অন্ধকার মুখ। শুনেছিল, আমেরিকা যাকে-তাকে পাস করিয়ে দিচ্ছে, আর লাইসেন্স দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে গ্রাম থেকে হাত-পা ধুয়ে আসা মূর্খদের কাছে। তারা কি গাড়ি চালায় দেখব।

তবু রিয়ার নিজের সংসার, সব আনন্দ সংসারের এই প্রিয় মুখগুলোর মধ্যে। ও প্রায়ই চিন্তা করত, মেয়েটা বড় হয়ে গেলে তারা বুড়াবুড়ি তার সংসারে সাহায্য করতে পারবে। প্রথম জেনারেশন আমেরিকান হয়ে টিকে থাকতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তাদের। মেয়ের জন্য যেন অন্তত ব্যাপারটা সহজ হয়। তখনো রিয়া অনেক চেয়েছিল একটু পড়াশোনা করতে, একটা চাকরি করতে। আয়েজ অনুমতি দেয়নি।

অলংকরণ: তুলি

শেষের তিন-চারটা বছর রিয়ার অনেক কষ্টে গেছে। আয়েজের কাছে সবার বউ সুন্দর, স্মার্ট, কোয়ালিফায়েড রিয়া ছাড়া। রিয়ার এমএসসি ডিগ্রি এ দেশে কোনো কাজে লাগে না ইত্যাদি। রিয়া বলেছিল, একটু চেষ্টা করে দেখি তাহলে। আয়েজের মেজাজ সপ্তমে উঠেছে দেখে ও চুপ করে ছিল। প্রায়ই ওমরাহ করার নামে, বেড়ানোর নামে আয়েজ চলে যেত ১০ থেকে ১৫ দিনের জন্য, কোথাও। ফিরে এলে আরও নোংরা ব্যবহার করত, রিয়াকে বাসা থেকে চলে যেতেও বলত। রিয়ার জীবনের অঙ্কের হিসাব মিলছে না আর।

কয়েক সপ্তাহ আগে পুলিশ ডেকে এনেছিল বাসায় রিয়াকে ধরে নিয়ে যেতে আয়েজ। প্রমাণের অভাবে তারা ধরে নেয়নি। অভিযোগ ছিল, রিয়ার নাকি অনেক মেজাজ। আয়েজকে গালি দিয়েছে। মেয়েটা সঙ্গে থাকাতে এবং মাকে ডিফেন্ড করাতে সে যাত্রা বেঁচে গিয়েছিল ও। তারপরই জানতে পারল, আয়েজ এ দেশে মসজিদে গিয়ে এক মহিলাকে বিয়ে করেছিল। পর্যাপ্ত টাকা না দেওয়াতে সে চলে গেছে। দেশে গিয়ে আরেকজনকে বিয়ে করেছে আয়েজ। রিয়া ওর কাছে পুরোনো বাতিল সোফা এখন।

রিয়া প্রচুর কেঁদেছে। তারপর ওয়ালমার্টে চাকরি নিয়েছে। মেয়েটা কলেজে গেলেই ও ডিভোর্স দিয়ে মা-মেয়ের জীবন সুন্দর করে কাটাবে, এতটুকু ভাবতে পেরেছে। ঘুমহীন কষ্ট চেপে বুকে এর বেশি কিছু ভাবতে পারছিল না ও। এরই মধ্যে আজকে পেল ও রিস্ট্রেন অর্ডার। বাসার ২০০ গজের মধ্যে ও যেতে পারবে না। প্রায় এক কাপড়ে বের হয়ে যেতে হয়েছে। বাচ্চার বান্ধবীদের কয়েকজন মাকে টেক্সট করে ও এসেছে সাগরের পাড়ে। ওর কান্না যাতে আর কেউ না দেখে। ও নাকি আয়েজের ক্ষতি করবে একই বাসায় থাকলে, অথচ গত বিশ বছরে আয়েজ কোনো দিন রান্না করেনি, নিজের প্লেটটাও ধুয়ে রাখেনি খেয়ে।

ঠিক এমন সময় একটা ফোন পেল রিয়া, লরেনের। ওর মেয়ের বান্ধবীর মা। বলল, কই তুমি, রিয়া? ডিভোর্স ফাইনাল হতে ছয় মাসের মতো লাগবে। এই সময়টা আমাদের সঙ্গে থাক, প্লিজ। তোমার বাড়ির অর্ধেক অংশের টাকা আর নিজের চাকরি দিয়ে ভালো চলতে পারবে সিস। একটু শক্ত হও।

রিয়া চোখ মুছল। একজনের প্রতি এক আকাশসমান ভালোবাসাই শুধু ওকে কষ্ট দেবে। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একটা পুতুল যে ওর আছে। ওর জন্য যেকোনো কিছু করতে ও রাজি। লরেনকে বলল, আসছি আমি লরেন।

(লেখাটা সত্য ঘটনার নির্যাস নিয়ে লেখা। আমেরিকার আইনের ফাঁকফোকরে সৎ মানুষ অনেক সময় বিপদে পড়ে। তবে সৎ মানুষের জন্য আল্লাহ আছেন। শুধু ধৈর্য ধরে চেষ্টা করে যেতে হয়।)

*প্রবাস থেকে দূর পরবাসে ভ্রমণের গল্প, লেখা, গল্প, ছবি, ভিডিও পাঠাতে পারবেন আপনিও। ঠিকানা [email protected]