প্রতিটি ক্রিয়ার একটি প্রতিক্রিয়া রয়েছে
নিউটনের তৃতীয় সূত্র সহজভাবে বলে যে প্রতিটি ক্রিয়ার বা কর্মের জন্য একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। সুতরাং, যদি বস্তু এ বস্তু বি–এর ওপর একটি বল প্রয়োগ করে, তাহলে বস্তু বি বস্তু এ–এর ওপর একটি বিপরীত কিন্তু সমান বল প্রয়োগ করবে। নিউটনের তৃতীয় সূত্র নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনা করার প্রয়াসে আমার এ লেখা নয়। আমি নিউটনের তৃতীয় সূত্রের আধ্যাত্মিক কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক একটি ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি।
সুইডেন আধুনিক একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সে গণতন্ত্রে দোষত্রুটি থাকলেও বিশ্বের হাতে গোনা সত্যিকার যে কয়টি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র রয়েছে, তার মধ্যে সুইডেন অন্যতম। জাতিগতভাবে সুইডেনের নাগরিকদের মধ্যে ৯৮ শতাংশ ধর্ম মানে না। অথাৎ তারা নাস্তিক। তবে আনুষ্ঠানিকতা হোক বা সংস্কৃতির আলোকে হোক, এই ৯৮ শতাংশ খ্রিষ্টধর্মের বিভিন্ন রীতিনীতি বা আচার–আচরণ পালন করে, যেমন বড়দিন বা ইস্টার সানডে। নাগরিকদের বাকি ২ শতাংশ কোনো না কোনো ধর্মের অনুসারী।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, ৯৮ শতাংশ নাগরিক কিন্তু বাস্তবিকভাবে বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মের ভালো উপদেশগুলো মেনে চলে বা চলার চেষ্টা করে। আমি এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর কথাই বলছি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তারা মিথ্যা কথা বলে না, অন্যের অনুপস্থিতে কথা বলে না, ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যের ক্ষতি করে না, আচার–আচরণে তারা সাবধানতা অবলম্বন করে, যাতে অন্য কেউ দুঃখ না পায়। অফিস–আদালতে একটি কথা প্রচলিত আছে, ‘তার সম্পর্কে কথা বলবেন না, তার সঙ্গে কথা বলুন।’ তারা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলার চেষ্টা করে। অযথা গাছ কেটে ফেলে না, যেখানে–সেখানে ময়লা ফেলবে না, সর্বক্ষত্রে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা মেনে চলবে, বিতর্ক পরিহার করার জন্য প্রয়োজনে রণে ভঙ্গ দেয়। পরিবেশ, জীবজন্তু, গাছগাছারি ইত্যাদিকে তারা মানুষের মতোই লালন–পালন করে। তারা আইনকে শ্রদ্ধা করে এবং আইন মেনে চলে। ৯৮ শতাংশের মধ্যে অবশ্যই কিছু মানুষ পাওয়া যাবে, যারা উপরিউক্ত গুণাবলি পুরোপুরি ধারণ করে না।
আমরা প্রবাসী মুসলিমরা অবাক হয়ে মাঝেমধ্যে বলি, তারা মুসলিম না হয়েও মুসলমানদের কৃষ্টি পালন করে অথচ আমরা সে ব্যাপারে অনেকাংশেই উদাসীন। আমাদের বাংলাদেশে চিত্রটি বিপরীত। আমি অনুমান করি, ৯৮ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ধর্মের অনুসারী আর ২ শতাংশ নাস্তিক। দেশে কোনো গোষ্ঠী কোনো গুণাবলি ধারণ বা লালন করে, সে বিচারের ভার আমি পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিউটনের তৃতীয় সূত্রের সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ সুইডিশদের সংযোগ নিয়ে আলোচনায় যাচ্ছি।
সুইডিশদের ধারণা, কারও সঙ্গে মিথ্যা কথা বললে অন্যরা তার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবে। তাতে করে দুজনার কেউই লাভবান হবে না। একজন সুইডিশ জানে, কারও ক্ষতি করলে হয়তোবা সে অন্য কারও দ্বারা ক্ষতির শিকার হবে। সবাই একটি করে গাছ কাটলে এক কোটি গাছ কাটা পড়বে সুইডেনে। তাতে পরিবেশ প্রতিশোধ নেবে সুইডিশদের ওপর অন্যভাবে। তাই তারা বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটে না। ব্যবসায়িক প্রয়োজনে গাছ কাটার নিয়ম থাকলেও তাদের পুনরায় গাছ লাগাতে হয়, বনায়ন করতে হয়। পশুকে তারা যত্নœ করে আইনের কারণে নয়, মানবিক কারণে। পশুপাখি না বাঁচলে পরিবেশ বাঁচবে না আর পরিবেশ না বাঁচলে মানুষ বাঁচবে না। এটা সুইডিশরা জানে। যেখানে–সেখানে ময়লা ফেললে সে ময়লা পানিতে গিয়ে মিশবে আর ছড়াবে ভাইরাসযুক্ত দুর্গন্ধ। সে পানি গড়াবে মাটির গভীরে, পানির স্তরে। তখন সে পানি পান করতে হবে সুইডিশদের।
সেটা তারা জানে এবং সে জন্য সতর্কতা। দুর্গন্ধ থেকে ছড়াবে ভাইরাস, ভাইরাস থেকে রোগ। নদীতে বা সাগরে প্লাস্টিক ফেললে সেটা মাছের পেটে যাবে আর পরবর্তী সময়ে মানুষের পেটে আসবে সেটা মাছ থেকে। তাই তারা সজ্ঞানে নদী বা সাগরে প্লাস্টিক ফেলে না। সড়কে এরা আইন ভঙ্গ করে সবার আগে যাওয়ার চেষ্টা করে না। কারণ, তাতে যানজট সৃষ্টি হলে কেউই আসলে এগোতে পারবে না। সবাই আটকে পড়বে সড়কে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধৈর্য ধরে এরা সড়কে অপেক্ষা করে উদ্ধারকার্য শুরু হওয়া পর্যন্ত। সড়ক অবরোধ করে এরা কখনো মিটিং–মিছিল করে না। করে না ভাঙচুর। কারণ, সবই রাষ্ট্রের সম্পদ। মানে সবার সম্পদ। সুইডিশরা জানে, রাষ্ট্র ও তার যাবতীয় সম্পদের মালিক আর কেউ নয়। ওরা নিজেরাই তার মালিক। নিজ সম্পদ কেন তারা ভাঙচুর করবে?
সুইডেনে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুর্নীতি নেই বললেই চলে। করপোরেট পর্যায়ে দুর্নীতি আছে, তবে সেটা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এখানেও একই নীতির ব্যবহার হচ্ছে। দুর্নীতি করলে আমিও দুর্নীতির শিকার হতে পারি। তাহলে ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে? আমার কর্মকাণ্ডের জন্য অন্যের যদি ভোগান্তি হয়, তাহলে আমিও অন্যের কর্মকাণ্ডের জন্য ভুগতে পারি। আমি যদি সেটা মানতে না পারি বা মানতে না চাই, তাহলে আমি অন্যের ভোগান্তির কারণ হব না।
সুইডিশরা ওপরে উল্লেখিত মতবাদের মাধ্যমে নিউটনের তৃতীয় সূত্রের আধ্যাত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাকে সত্যি বলে দাঁড় করাল।
আমরা বাংলাদেশিরা কি নিউটনের তৃতীয় সূত্রের আধ্যাত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাকে মানতে রাজি আছি? অর্থাৎ ‘আমার কৃতকর্মের ফল আমাকেই আবার সমভাবে ভোগ করতে হবে’। সে ফল হয়তো বর্তাবে আমার সন্তানের ওপর বা তাদের সন্তানের ওপর।