বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও কানাডার অভিজ্ঞতা

১.

অফিসের গাড়িতে বাসায় ফেরার পথে এক সহকর্মী দিলেন মজার এক তথ্য, বাংলাদেশে নাকি শুধু দুটি ডিগ্রি অর্জন করতে পাঁচ বছর সময় লাগে। একটি হচ্ছে এমবিবিএস, যা লাগে চিকিৎসক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে। আর অন্যটি হচ্ছে ক্লাস ওয়ান পাস করতে! প্রথমটির ব্যাপারে বেশ ভালোভাবে জানা থাকলেও দ্বিতীয়টির ব্যাপারে খুব অবাক হলাম। বাসায় এসে একটু ইন্টারনেট ঘেঁটেই বুঝতে পারলাম, ঘটনা মোটামুটি সত্য। প্রি–প্লে, প্লে, নার্সারি, কেজি-১, কেজি-২ এবং ক্লাস ওয়ান—এসবের বিভিন্ন কম্বিনেশনে ক্লাস ওয়ান পার হতে একটি শিশুর মোটামুটি বছর পাঁচেকই লেগে যায়! প্রাইমারি ও টারশিয়ারি দুটি ডিগ্রির এই অদ্ভুত সামঞ্জস্য দেখে স্বাভাবিকভাবেই অবাক হলাম।

২.

স্কুল শেষে ছেলের মাকে কাছে ডেকে মিস আমতা আমতা করে বললেন, অনেক কষ্ট করেও নাওয়াফকে স্কুলে কথা বলানো যাচ্ছে না। বেশির ভাগ সময় ও শুধু চুপচাপ বসে থাকে। দু-একজন বন্ধু ছাড়া খুব একটা কারও সঙ্গে মিশছেও না। অবাক হয়ে ওর মা যখন জিজ্ঞাসা করল, ও কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। বাসায় এসে একটু একটু করে ইজি হয়ে আমি যখন জানতে চাইলাম, কেন ও স্কুলে কথা বলে না, আমার ছয় বছরের ছেলে খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিল, ওর স্কুল ভালো লাগে না। আমি বললাম, কেন বাবা, কানাডায় তুমি সব সময় স্কুলে যেতে, বন্ধুদের সঙ্গে অনেক খেলা করতে এবং অনেক সময় স্কুল থেকে বাসায় আসতে চাইতে না, তাহলে এখন কেন এমন করছ? ছেলে কিছুটা মন খারাপ করেই বলল, ‘বাবা, মিস শুধু পড়তে বলে। স্কুলে আমার খালি পড়তে ভালো লাগে না, খেলতেও ইচ্ছা করে। আমি বাংলাদেশের স্কুলে যাব না, আমি আবার কানাডার স্কুলে যেতে চাই, বাবা।’

৩.

সংস্কৃতি ও আবহাওয়ার শক কাটিয়ে কানাডায় যখন কিছুটা থিতু হলাম, চেষ্টা করলাম পড়াশোনায় পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার জন্য। শুরুতে আমার ক্লাসমেটদের প্রায় সবাইকেই আমার কাছে মনে হচ্ছিল, অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট এবং আমার চেয়ে অনেক বেশি অ্যাডভান্সড। কিন্তু আস্তে আস্তে একটা সময় বুঝতে পারি, ওরা আসলে এক্সট্রা অর্ডিনারি নয়, সবাই অনেক অনেক স্মার্ট এবং এই স্মার্টনেস ওরা অনেকটা পায় ওদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই। ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬ মাসের মাস্টার্স করার সময় আমি ছোট-বড় মিলে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়েছিলাম ৩৭টি, একক বা গ্রুপ প্রেজেন্টেশন দিয়েছিলাম ১৮টি, আর ছোট ছোট কুইজ দিয়েছিলাম মোট ১৯টি। এই পুরো সময়টাতে একটিবারের জন্যও কোনো লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি, কিছু মুখস্থ করার দরকার হয়নি, যা বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী!

৪.

পিএইচডি শুরুর পর প্রথম যে কোর্সের টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করি, তা হলো ‘এনভায়রনমেন্টাল পলিসি’। খুবই চমৎকার একটি কোর্স এবং বন্ধুবৎসল অধ্যাপক। ‘চ্যাটজিপিটি’র দৌরাত্ম্যে পুরো কোর্স থেকে সব অ্যাসাইনমেন্ট বাদ দিয়ে দিল। মিডটার্মে রাখল গ্রুপ ডিবেট আর ফাইনালে ওরাল এক্সাম। ২০ মিনিটের ওরাল এক্সামে স্টুডেন্টরা সবাই হাতে ছোট ছোট নোট নিয়ে আসছে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে নিজের নোট দেখে উত্তর গুছিয়ে নিচ্ছে, প্রফেসরের সঙ্গে তর্ক করছে, পাল্টা প্রশ্ন করছে। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ চিত্র কি কখনো চিন্তা করা যায়?

৫.

বুঝতে পারলাম, এখানকার শিক্ষার্থীরা মুখস্থবিদ্যায় সময় ব্যয় না করে অল্প বয়স থেকেই নিজেদের শাণিত করছে ‘রিটেন’ ও ‘ওরাল’ কমিউনিকেশনের দক্ষতা বৃদ্ধিতে, যা নিশ্চিতভাবেই তাদের অনেক বেশি স্মার্ট করে তোলে। আর এই স্মার্টনেসই সব সময় চাকরির বাজারে ওদের রাখে এগিয়ে। ছোট থেকেই গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় তারা নানা রকম দাতব্য ও উপার্জনধর্মী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়। এটি তাদের একদিকে যেমন চাকরির বাজার সম্পর্কে অভিজ্ঞ করে তোলে, অন্যদিকে তৈরি করে প্রচুর কানেকশনস ও রেফারেন্স। তারা সময় দেয় এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজে। চাকরিযুদ্ধে নামার আগেই তৈরি হয়ে যায় অসাধারণ এক পোর্টফোলিও!

৬.

লেখাটা শুরু করেছিলাম বাংলাদেশের প্রিপ্রাইমারির ব্যাপ্তি নিয়ে। পাঁচ বছর লাগুক আর এক বছর লাগুক, এ লেখার উদ্দেশ্য সেটা নয়। আমার শুধু খটকা লাগে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আসলেই কি সঠিক দিশা পাচ্ছে? কয়েক বছর পরপরই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে চলছে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এর কতটুকু বিজ্ঞানসম্মত, তাতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সম্ভবত মুখস্থবিদ্যা থেকে শিক্ষার্থীদের ফেরাতেই সৃজনশীল পদ্ধতির যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু কিছু কিছু সৃজনশীল প্রশ্ন দেখে আমি নিজেও দ্বিধায় পড়ে যাই, মূল গল্প বা ওই বিষয়ের সঙ্গে আসলেই এর কোনো মিল আছে কি না!

৭.

আলবার্ট আইনস্টাইন সম্পর্কে একটা গল্প প্রচলিত আছে। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসায় ফেরার পথে ট্যাক্সিচালককে বললেন, আইনস্টাইন এর বাসা চেনেন কি না? চালক সানন্দে জানালেন, কেন চিনবে না, প্রিন্সটন শহরের সবাই চেনেন। চালক পাল্টা প্রশ্ন করলেন, যাত্রী এই শহরে নতুন কি না এবং তিনি বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করতে চান কি না? আইনস্টাইন নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, তিনি তাঁর নিজের বাসার ঠিকানা মনে করতে পারছেন না।!
পরবর্তী সময়ে আইনস্টাইনকে একবার জিজ্ঞাসা করা হলো, কেন তিনি বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্ট বা নিজের ব্যক্তিগত তথ্য মনে রাখেন না? আইনস্টাইন সাবলীলভাবে জবাব দিলেন, যে তথ্যগুলো বই বা ডায়েরিতে লেখা থাকে, সেগুলো মুখস্থ করার তো কোনো মানে হয় না!

৮.

আমার এ লেখার উদ্দেশ্য হলো আমাদের শিশুরা-শিক্ষার্থীরা যেন পড়াশোনাকে ভয় না পায়। মুখস্থবিদ্যার গণ্ডিতে যেন তারা আটকে না থাকে। তারা যেন উপভোগ করতে পারে তাদের শৈশব আর কৈশরও। শিক্ষা যেন হয় আনন্দের সঙ্গে, চাপমুক্ত পরিবেশে। সঙ্গে যেন তারা খুঁজে নিতে আর বিকশিত করতে পারে নিজেদের এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজগুলো। আর এর জন্য পরিবর্তন দরকার আমাদের সবার। শিক্ষা যেন পায় একটি গবেষণাপ্রসূত কাঠামো, শিক্ষকেরা যেন হন আরও বেশি বন্ধুবৎসল এবং আমরা, বাবা-মায়েরা যেন মনের আয়নায় সন্তানের সঙ্গে নিজের সে বয়সের মানসিক অবস্থাটাও একটু বিবেচনা করে নিই।

পরিবর্তন আসবেই!

লেখক: শাহরিয়ার নজরুল, পিএইচডি শিক্ষার্থী, সেন্ট মেরিস ইউনিভার্সিটি, কানাডা।

দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারেন [email protected]