মাইল অ্যান্ড পার্কের এক শুভদিন

ব্রিটেনের মানুষ যেন দিন দিন রোবট মানুষে পরিণত হয়ে পড়ছে। ভালোবাসা এখানে বন্দী হয়ে যাচ্ছে পাউন্ডের কাছে। এখানে অনেক নারী আছেন, যাঁরা শুধু হিসাব করেন পাউন্ডের। তাঁদের কাছে অন্য সব হিসাব যেন অর্থহীন হয়ে পড়েছে। মানুষ টাকাপয়সার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে কখন যে একটি অশুভ প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়ে পড়ছে, তা তারা নিজেরাই জানে না। তাদের মধ্যে হয়তো অন্যতম অনন্যা। নতুন সংসার আর নতুন স্বপ্ন নিয়ে সে শুরু করেছে একটি নতুন জীবন। এই যুগলজীবনে আনন্দ–উল্লাসের চিত্রও দেখা যায়।

আরাফাত আর অনন্যার সাংসারিক জীবন চলছে, মন্দ নয়। একদিন দুজন মিলে পরিকল্পনা করল, বেড়াতে যাবে বাচ্চাদের নিয়ে। পরিকল্পনা হয়ে গেল। তাদের পার্শ্ববর্তী এলাকা মাইল অ্যান্ড পার্ক। একটি ফান ফেয়ার চলছে সেখানে। ওরা ফান ফেয়ার দেখতে যাবে। মূলত শিশুদের জন্য এই ফান ফেয়ার। তবে এখানে অভিভাবকেরাও আসেন তাঁদের সন্তানদের নিয়ে। এখানে বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চালানোর ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বয়সের অনেক শিশুর সমাবেশ ঘটে এ জায়গায়। এ বন্ধু সমাবেশে শিশুরা বেশ আনন্দ করে। এসব কারণে শিশু এবং তাদের মা–বাবাদের কাছে এই ফান ফেয়ারের গুরুত্ব অনেক। শীতের সকাল; ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে যায় সবার। সেদিনও তা–ই হলো। ঘরের কিছু নিয়মিত কাজ বাকি রয়ে গিয়েছিল, তাই অনন্যা তার স্বামীকে বলল, ‘আমি একটু পরে আসি, তুমি রাহিন আর হামজাকে নিয়ে সেখানে চলে যাও। ওদের জন্য কিছু রাইডিংয়ের ব্যবস্থা করে দিয়ো। এর মধ্যে আমি আলিফাকে নিয়ে চলে আসব।’ অনন্যার পরিকল্পনামতো আরাফাত মেলায় পৌঁছে সন্তানদের জন্য টিকিট কেটে কিছু রাইডিংয়ের ব্যবস্থা করে দিল। রাহিন আর হামজা অনেক খুশি। তারা ঘোড়ার গাড়ি ও কারে চড়েছে। কখনো কখনো অন্য শিশুদের সঙ্গে উচ্চগতিতে গাড়ি দৌড়ানোরও চেষ্টা করছে তারা। সব মিলিয়ে অনেক ভালো সময় কাটছে তাদের।

কিন্তু আরাফাত যেন অস্থির হয়ে পড়েছে অনন্যার জন্য অপেক্ষা করে করে। কখন যে বাজবে বন্ধুমিলনের বাঁশি! হঠাৎ অনন্যার ফোন আসে। আরাফাত জানতে চাইল, অনন্যা কোথায়? অনন্যা জানাল, ‘আমি তোমার মেয়েকে নিয়ে পার্কের ভেতর বসে আছি।’ এ ফোন যেন এক আনন্দের বন্যায় ভাসিয়ে দিল আরাফাতকে। অনন্যা হলুদ পোশাক পরে এসেছে আর পার্কও ছিল নানা রঙে সাজানো। ভেতরে চলছিল সার্কাস, গাড়ি রাইডিং ইত্যাদি। আর এসবের ভেতর ছিল ফাস্ট ফুড ও আইসক্রিমের দোকানে মানুষের ভিড়। ফান ফেয়ারের ভেতরের বিভিন্ন বোর্ডের রঙের সঙ্গে মানিয়ে যাচ্ছিল অনন্যার পোশাক। তাই তাকে অনেক সুন্দর লাগছিল। অনন্যার মিষ্টি হাসি কী যে অদ্ভুত সুন্দর ছিল! তাই আরাফাত সারা দুনিয়ার সব সৌন্দর্য যেন অনন্যার হাসির ভেতর দেখতে পাচ্ছিল। ভালোবাসার মানুষকে আরাফাত কখনো কখনো লোকচক্ষুর আড়ালে স্পর্শ করে আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। অনন্যাও কখনো কখনো আরাফাতের সঙ্গে চোখের ইশারায় দুষ্টুমি করতে থাকে। জায়গাটাকে যেন পৃথিবীর সেরা কোনো বিখ্যাত জায়গা ভাবছে দুজন, তাই তো এত খুশি, এত হাসি। সন্তানদের জন্য কিছু চকলেট আর ফাস্টফুড কিনল তারা। আরাফাতের কাছ থেকে অনন্যা একটা আইসক্রিম নিল নিজের জন্য। তার অর্ধেক খেতে দিল আরাফাতকে। একজন আরেকজনকে ভালোবাসাভরা চোখে দেখছে আর সেই সঙ্গে মেলার অপরূপ দৃশ্যটাও উপভোগ করছে। একসময় আলিফা জেদ ধরল যে সে ঘোড়ার গাড়িতে চড়বে। কিন্তু সেটা ছিল গোলাকৃতির এবং নিচ থেকে ওপরে ওঠে। আলিফার পক্ষে একা একা ওঠা সম্ভব নয়। তাই অনন্যাও উঠল তার সঙ্গে। যখন গাড়িটা ওপরে উঠতে লাগল, তখন আরাফাত একটু দূরে সরে গেল।

আলিফা পাপ্পা পাপ্পা বলে আনন্দে চিৎকার করতে থাকল। অনন্যা মুখের ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করল, ‘আমরা দুজন তোমাকে মিস করছি।’ তারপর যখন গাড়িটা ওপর থেকে নিচে নামল, তখন অনন্যা প্রথমে আলিফাকে আরাফাতের হাতে দিল এবং পরে আরাফাতের হাতে হাত রেখে বের হয়ে এল সেখান থেকে। তাদের মনে তখন সুর বাজছিল—‘সখী ভালোবাসা কারে কয়!’ এরপর সন্ধ্যা হয়ে গেলে তারা ফান ফেয়ার থেকে বেরিয়ে তাদের বাসার দিকে ফিরে চলে। তারপর অনেক দিন দুজনের মান-অভিমান চলছে। তাই এখন তারা আলাদা থাকে। কখন যে এ সমস্যার সমাধান হবে, আরাফাতের জানা নেই। কিন্তু যখন আরাফাতের স্মৃতিতে আসে মাইল অ্যান্ড পার্কের সেই শুভদিনের কথা, তখন সে অনেক কষ্ট পায় এবং অনন্যাকে মিস করে।

লেখক: আজিজুল আম্বিয়া, যুক্তরাজ্য