সকলই ফুরায়ে যায় মা!
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধরিত্রী মায়ের অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রচনা করেছিলেন বিদগ্ধ কাব্যরসে সিঞ্চিত তাঁর নান্দনিক কবিতা। তাঁর লেখনী সেদিন বিশ্ববন্দনায় মূর্ত হয়ে উঠেছিল,
‘আমার পৃথিবী তুমি বহু বর্ষের।
তোমার মৃত্তিকা সনে
আমারে মিশায়ে লয়ে অনন্ত গগনে
অশান্ত চরণে করিয়াছ প্রদক্ষিণ।’
(বসুন্ধরা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
আর আজ! কবির মননের সেই বিশ্বমাতা ‘পৃথিবী’ আছে। কিন্তু তাঁর বৈষয়িক সবকিছুই যেন হারিয়ে যাচ্ছে! এ মায়ের সন্তান যে মানুষ, যারা তার রূপ রস পেয়ে তারই অপত্যস্নেহে লালিত হয়ে আসছে, তারাই তাদের নিষ্ঠুর হাত উঁচিয়ে মায়ের সবকিছু ধ্বংস, লোপাট করে দিচ্ছে! মানুষ হয়ে মানুষের শান্তির নিবাস, তার হিরণ্ময় পরিবেশ বিষাক্ত করে তুলছে। কি প্রাকৃতিক, কি সামাজিক, সবকিছুকে আজ মানুষের করাল থাবা রাহুর মতো জেঁকে ধরেছে। যেন সবকিছুর অনিবার্য ধ্বংসই আজ সবার কাম্য। সবার সাধনা।
চিরায়ত সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের এ গ্রহ। এ পৃথিবী। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শূন্যে মহাশূন্যে বিজ্ঞানীরা আজও হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছেন আর কোথাও অন্য একটি এ রকম বাসযোগ্য পৃথিবী খুঁজে পাওয়া যায় কি না। যেখানে আছে, ঠিক এখানকার মতো প্রাণদায়ী মৃত্তিকা, অম্লজান আর জলের সামষ্টিক সুদূরবিস্তারি উপস্থিতি। যেখানে অনায়াসেই প্রাণিত উচ্ছ্বাসে বীজেরা অঙ্কুরিত হয়। যেখানে নৈসর্গিক লীলাভূমিতে বিচরণ করে যত প্রাণিকুল। পাখিরা মেতে ওঠে কলকাকলিতে। আছে কি এমন অসীম নির্ভরতায় পরিপূর্ণ আরেকটি পৃথিবী, অন্য কোথাও? অন্য কোনো গ্যালাক্সিতে?
আছে কি? বিজ্ঞানীরা তো হন্যে হয়েই খুঁজে মরছেন! এযাবৎ তাঁরা যা কিছু তাঁদের অভিজ্ঞানের আয়ত্তে পেয়েছেন, পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদ আর প্রতিবেশী গ্রহ মঙ্গলের অনেক তথ্য-উপাত্ত। মিলেছে সেখানে পাষাণময় বিস্তীর্ণ প্রান্তরের সন্ধান। বিস্তর শিলা, পাথরখণ্ড, পাহাড়-পর্বত, আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের সন্ধান। আরও কত কী! আবার সম্প্রতি মঙ্গলে বরফের অস্তিত্বও নাকি আবিষ্কৃত হয়েছে! তো, এত কিছু মানুষের জন্য অনেক প্রাপ্তি। ভবিষ্যতের জন্যও বিস্তর সাফল্যের উজ্জ্বল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেখানে কোথাও কী আছে, আমাদের পায়ে চলার উদার মেঠো পথ? পাশেই যে চরম অবহেলায় অতি সাধারণ দূর্বাঘাস, তার নিজস্ব স্বতঃস্ফূর্ততা নিয়ে বেড়ে ওঠে তার কোনো বিন্দুমাত্র অস্তিত্ব? আছে কি শাপলা, গোলাপ, জবা, জুঁই, চামেলির মনোরম মুগ্ধতা? মৎস্যকুলের, পাখপাখালির অবাধ বিচরণ কোথাও আছে কি? জীর্ণ দালানের স্যাঁতসেঁতে কার্নিশে বেড়ে ওঠা বটবৃক্ষের ছোট্ট চারাগাছ? আছে? শোনা যাচ্ছে শিগগিরই মানুষ নাকি চাঁদে, একান্ত নিরালায় তাদের অবকাশযাপনকেন্দ্র গড়ে তুলবে। অর্থ, প্রযুক্তি আর জ্ঞান–বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ কোন কোন দেশ নাকি চাঁদে হোটেল তৈরি করার পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে! তা হতেই পারে। তাতে সহসাই আমাদের প্রতিবেশী চাঁদের একাকিত্ব ঘুচে যাবে। শৌখিন, ভ্রমণবিলাসী পর্যটকদের পদচারণে মুখর হয়ে উঠবে তার কক্ষপথ! নরনারীর টানা হাস্য-কলকাকলিতে, মারদাঙ্গা মিউজিকে এবং খাবার টেবিলের টুংটাং শব্দে মুখর হয়ে উঠবে চাঁদের ধূসর, নির্জন প্রাঙ্গণ! বোধ করি, সেদিনও খুব বেশি দূরে নেই!
এখন প্রশ্ন, আজ মানুষের প্রকৃত অবস্থান কোথায়? পেছনের একটি শতাব্দী অতিক্রম করে আর একটি শতাব্দীর সিকি ভাগে দাঁড়িয়ে, মনের পাখা মেলে মানুষ, মুহুর্মুহু গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে ঊর্ধ্বে ছুটে চলার। পৃথিবীর সীমান্ত পেরিয়ে, মাধ্যাকর্ষণের, অভিকর্ষের নাগালের বাইরে হবে এই পার্থিব মানুষের অবস্থান। মহাশূন্যে শুধুই ভেসে বেড়ানো। ঠিক মাছ যেমন জলে ভেসে বেড়ায়। পাখি যেমন অবাধে আকাশে উড়ে বেড়ায়। তাই মানুষও স্বপ্ন দেখে অন্য আরেকটি গ্রহে নিজের ঠিকানার ভিত রচনা করতে। এই যেমন সে এখন পরিযায়ী হয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে নিরন্তর ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছুটে যাচ্ছে মহাকাশের অবারিত খোলা জানালায়। এত কিছুর পর সে কি অন্য আর একটি গ্রহে তার আবাস গড়বে না? তবে এ কথা ঠিক তার জানা, সে চাঁদ বা অন্য কোনো গ্রহ যা–ই হোক না কেন, এই পৃথিবীর মতো সে আর হচ্ছে না! আকাঙ্ক্ষিত সেই গ্রহান্তরে থাকবে না গাছ থেকে, উঁচু দালানের ছাদ থেকে মাটিতে পড়ে হাত-পা-কোমর ভাঙার বা অপমৃত্যুর সমূহ ভয়। কারণ, সেখানে তো মানবসন্তানকে মাতৃস্নেহে বুকে টেনে নেওয়ার মতো পৃথ্বীমাতা নেই! আছে চন্দ্রমাতা। অথবা হতে পারে মঙ্গলমাতা। তো সেই মায়েরা অভিকর্ষের তাড়নায় মানুষকে কেবল, দূরেই ঠেলে দিতে চাইবে। এই আমাদের পৃথ্বী মায়ের মতো, বোধ করি চন্দ্র, মঙ্গল মাতৃস্নেহে অতি দ্রুত মানুষকে নিজেদের বুকে টেনে নেবে না।
হ্যাঁ। এই পৃথিবী আমাদের মা! এটিই ধ্রুব সত্য। আমরা মানুষ, জন্ম নিয়েই ভর করেছি এই মায়ের কোলে। পরম আদরে নির্বিঘ্ন আশ্রয়ে ঠাঁই মিলেছে আমাদের, এই তারই বুকে। এবং তার আঁচলেই আমরা শান্তির পরশ লাভে ধন্য হয়েছি! অন্ন, জল, আলো, বাতাস, প্রশান্তির আশ্রয় ... প্রয়োজনে সবকিছুই পেয়েই পরম নির্ভরতায় বেড়ে উঠেছি ক্রমাগত এই মায়ের কোলেই। এভাবেই অনাদিকাল থেকে মানুষের পৃথিবী তার সন্তানদের, পরম স্নেহে লালন-পালন করে আসছে একান্ত মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে।
তো, আমরা কী দেখছি এখন? কিছু মানুষ এই মাকেই অবহেলা করছে! পৃথিবীমাতার চির সৌন্দর্যে নির্মম, কঠিন গাইতি চালিয়ে ক্ষতবিক্ষত, ভঙ্গুর করে দিচ্ছে সবকিছুই! যেন পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সবই মানুষের কাছে, একান্ত অপ্রয়োজনীয় হয়ে গিয়েছে। একেবারেই বাহুল্য, ঘৃণ্য, পরিত্যাজ্য মনে করে দূরে ঠেলে, ছুড়ে ফেলতে চাইছে নান্দনিক এই পৃথিবীর সৌন্দর্য সব! এই যেমন, চোখের নিমেষেই বনবাদাড়, টিলা-পাহাড়, নদী-বিল সব উজাড় হয়ে যাচ্ছে দ্রুত! সোনালি শস্যদানায় পরিপূর্ণ দিগন্তবিস্তারি উর্বর জমি এখন, নগরায়ণের, শিল্পায়নের গোগ্রাসে পড়ে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বনের চঞ্চলা হরিণী, অমিততেজী ব্যাঘ্র-সিংহ, বিশালাকায় হাতি আর অজগর, কচ্ছপ-শজারু, বানর-খরগোশ ... প্রাণভয়ে তারা সব কোথায় পালিয়ে যাচ্ছে! আবার মানুষের থাবার সামনে টিকতে না পেরে সমূলেই তারা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে! সভ্যতার বর্জ্য-আবর্জনায় প্রাণের অবাধ বিচরণক্ষেত্র নালা-খাল, বিল-নদী এমনকি সাগর-মহাসাগর কলুষিত হয়ে পড়ছে! মানুষের তৈরি যানবাহনের, কলকারখানার বিষাক্ত ধোঁয়া, শব্দ, যত সব বর্জ্য-আবর্জনা পৃথিবীর স্থল-জলভাগ, স্বচ্ছ নীল আকাশ, প্রাণদায়ী মুক্ত বাতাস প্রাণসংহারী আবহে ভারী করে তুলছে। বলতে গেলে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই এখন বিভীষিকাময় কর্কটের থাবার আয়ত্তে অবস্থান করছে!
আবার দেখি মাছসহ অন্য সব জলজ প্রাণী, এমনকি উদ্ভিদ সমূলে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে! বনের বৃক্ষরাজি যা মানুষ অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে রোপণ করেছে পরম আদরে এই ধরিত্রীকে বাঁচাবে বলে, কতক হিংস্র হায়েনার মতো মানুষ আবার এগুলোকে নির্বিচারে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়-টিলা, বনবাদাড় কেটে উজার করে দিচ্ছে!
শুধু কি তা–ই? এই পৃথিবীর বুক বিদীর্ণ করে মানুষ এখন, নিঃসীম সুদূরের অন্তরিক্ষে থাবা মেলছে! বলতে গেলে, অসীম অবারিত মহাকাশও এখন নিরাপদ নয়। নিচের পৃথিবীকে কেন্দ্র করে, দ্রুত ধাবমান বিমানের, মহাকাশ যানের এবং ক্ষেপণাস্ত্রের ধোঁয়ায়, শব্দে মহাকাশ আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে! যত সব সচল, বিকল ও বাতিল উপগ্রহ সব মিলে মহাকাশ এখন, সুবিশাল ভাসমান আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয়েছে! আমাদের পৃথিবীকে ঘিরে রাখা ওজোন-স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ফলে, সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি অবাধে এবং সরাসরি নেমে আসছে ভূমণ্ডলে। ফলে ওজোন-স্তর ঢাল হয়ে, পৃথিবীকে সুরক্ষা করতে পারছে না। এখন এই ওজোন স্তরের ভঙ্গুরতার কারণেই, পৃথিবী আক্রান্ত হচ্ছে নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগে। তার অধিবাসী মানুষ হচ্ছে প্রভাবিত। ক্যানসারসহ নতুন নতুন রোগব্যাধি ও মহামারির শিকার হচ্ছে তারা।
এই সব অনাচার-ব্যভিচারের মর্মন্তুদ পরিণতি এই জগতের অধিবাসী সবাই প্রত্যক্ষ করছে! এই অনিবার্য ও দুর্লঙ্ঘ পরিণতির প্রভাব, এ ধরিত্রীর সবুজ নিসর্গের ওপর দ্রুতই বিস্তার লাভ করছে। দিনে দিনে প্রকৃতির লীলাক্ষেত্র, চিরায়ত সৌন্দর্য হারিয়ে চূড়ান্ত ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে! ইতিমধ্যে অগণিত বিচিত্র উদ্ভিদের, প্রাণীর বর্ণিল প্রজাতি একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে এবং অগ্রসরমান সভ্যতার অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার এই চলমান প্রক্রিয়ার দ্রুত ধাবমান চাকার নিচে, কালে কালে পিষ্ট হয়েই যাচ্ছে অসহায় প্রকৃতির তাবৎ জীব-প্রাণিকুল! স্বার্থান্ধ এবং দুর্বিনীত চরিত্রের কিছু অর্বাচীন মানুষের দুর্বৃত্তপনার কারণেই পৃথিবীতে নেমে আসছে, যত প্রাকৃতিক ঝঞ্জা। রোগব্যাধি। মহামারি। এসব অপঘাতের কারণে, অসহায় সাধারণ মানুষকে বেঘোরে প্রাণ বিসর্জন দিতে হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এই পৃথিবীর আসন্ন অন্তিমদশাই দেখতে চায় এই দুর্বৃত্তরা! এই জগতের সব অধিবাসীকে নির্বিবাদে তা–ও প্রত্যক্ষ করতে হবে!
যে বিজ্ঞান মানুষের দুঃখ মোচন করতে কল্পনাতীত ভূমিকা রাখতে সক্ষম, সেই বিজ্ঞানই মানুষকে আজ চরম অনিরাপত্তায়; রোগের শোকের আর যন্ত্রণার মৃত্যুকূপে ঠেলে দিচ্ছে! তথাকথিত ‘পরাশক্তি’ অভিধায় পরিচিত দেশগুলো এবং তাদের প্রতিপক্ষ ছোটখাটো দেশগুলোও; নিজেদের অর্জিত শক্তির মহড়া দেখাতে গিয়ে, মারণাস্ত্রের ঝনঝনানিতে এই পৃথিবীকে করে তুলেছে উত্তাল ও বিপৎসংকুল। কোথায় একজনের বিপদে আর একজন ছুটে আসবে মানুষ, তা না করে তারা মানব–বিধ্বংসী নব নব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে এবং উন্নয়নে দিনরাত খেটে মরছে। যুদ্ধপ্রযুক্তিকে ভালোবেসে তারা, পুরোটাই আত্মনিয়োগ করে ব্যস্ত রাখছে নিজেদের। দূরপাল্লার অতি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে, আবার আকাশেই তাকে প্রতিহত করতে যত গবেষণায় জনবল, অর্থবল ও মানবকল্যাণে ব্যবহার্য সম্পদের লগ্নি করছে বিস্তর! দিন দিন মানবতার ধ্বজাধারী পরাশক্তিগুলো, মানবিক না হয়ে পারমাণবিক হয়ে পড়ছে! বলা যায়, বিশ্বের মোড়ল শ্রেণির তাবৎ মানুষ নৈতিকতায় মণ্ডিত মানবীয় জগৎ থেকে ছিটকে গিয়ে দানবের পোশাক পরিধান করেছে। তারা মানুষ হয়ে, মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত রাখছে নিজেদের!
তারা শান্তিবাদী মানুষের মনোজগতেও আঘাত হানছে অনবরত! তাতে বিশ্ববাসী সবাই চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে, অস্থির জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। শান্তিবাদী অসহায় মানুষ, কোথাও নিজেদের নিরাপদ মনে করতে পারছে না। জীবনের নিরাপত্তার জন্য তাই তারা, নিজেদের আপন ঠিকানা প্রিয় দেশ, আবাস এবং আত্মীয়-পরিজন পরিত্যাগ করে যে যেমন পারছে হন্যে হয়ে অন্য দেশে ছুটে পালাচ্ছে। তারা সব স্থাবর-অস্থাবরের মূল্য, দালালদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছে। তারপরও তারা পৌঁছাতে পারছে না আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। পথিমধ্যে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের, এমনকি মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের।
বর্তমান সময়ে দেশে দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক অস্থিরতা গোটা মানবসভ্যতাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। রাজনৈতিক, সামাজিক নেতারা, যাদের সাধারণ জনগোষ্ঠী সরল মনে বিশ্বাস করে, যাদের ওপর রয়েছে তাদের সীমাহীন এবং অকুণ্ঠ আস্থা, নির্ভরতা; তারাই নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য সাধারণ মানুষদের বিপথগামী, বিপদগ্রস্ত করছে। তাদের দখলদারত্ব সর্বত্র। সর্বব্যাপী। স্বার্থান্ধ ধনিকশ্রেণির লালসার শিকার হচ্ছে, হতদরিদ্র, অশিক্ষিত, প্রান্তিক জনগণ। কারও কারও ইচ্ছা-অনিচ্ছার জোরে চলছে সমাজ, রাষ্ট্র তাবৎ ব্যবস্থা। তারা ফতোয়াবাজ, ধর্মশাস্ত্রের ভুল ব্যাখ্যাদানকারী। তারা নারী-শিশু, অসহায়দের ওপর নির্যাতনকারী। তারা নারী, শিশু, অবৈধ অস্ত্রের এবং মাদক, সোনা, অর্থ পাচারের সিন্ডিকেট করে নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেয় দেশে দেশে। সবকিছুর গডফাদার হয়ে তারা মানবসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ জবরদখল করে নিজেদের ঐশ্বর্যের পাহাড় গড়ে তুলছে। অনাহারে, বিনা চিকিৎসায়, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত মানুষের লাশের ওপর গড়ে তুলছে স্বপ্নের অট্টালিকা। শিক্ষাঙ্গনে চৌর্যবৃত্তি, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে বই-খাতা-কলমের পরিবর্তে মাদক, অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র তুলে দেওয়া, সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত করে সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেওয়া, মানুষের সম্পদ বিনষ্ট করা ইত্যকার মুষ্টিমেয় এ কয়েকজনেরই কাজ। শান্তিবাদী সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, কী চায় তারা? তারা কি চায় শুধু তারা বাদে পৃথিবীর আর সব দুর্বল মানুষ মরে যাক? শুধু বেঁচে থাকবে কুচক্রী স্বার্থান্বেষী এই তারা?’
প্রকৃত চিত্র এখন তা–ই। সমাজের ও রাষ্ট্রের এই দুর্বৃত্তদের বসতবাড়ি, বিনোদনকেন্দ্র, সম্পদের পাহাড় আলিশান হিমালয়ের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে যায়! দেশে দেশে চলে তাদের অবাধ প্রমোদ-বিচরণ। সমাজের, রাষ্ট্রের ধনিক এ তারাই সিংহভাগ সম্পদ লুটে নিচ্ছে। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিচ্ছে। লুটেরা এই ধনিক শ্রেণির লাঞ্ছনার, বঞ্চনার, নির্মমতার শিকার হচ্ছে ভাগ্য বিড়ম্বিত দরিদ্র জনগোষ্ঠী। কালে কালে তারা, দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর পর্যায় নেমে আসছে। এখন এ দুর্বৃত্তরা, গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে তাদের সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছে।
এ যদি হয় আমাদের পৃথিবীর অবস্থা, তবে এই পৃথিবীর প্রকৃতিও আর মানুষের পক্ষে থাকবে না। ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে তার বিদ্রোহ করার পালা। এবার অনিবার্য এবং চূড়ান্ত ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে বুঝি প্রকৃতির। সে এখন অসহিষ্ণু! ক্ষুব্ধ! দ্রোহী! তাই দিনে দিনে সে, প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠছে! অতিবৃষ্টি, খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, দাবানল, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, ভূমিধস, সুনামি, বৈশ্বিক তাপমাত্রার বৃদ্ধি ... ইত্যাদি মাতিয়ে তুলছে এই পৃথিবীকে। মানুষের সভ্যতাকে, প্রকৃতি সে আজ দলিত-মথিত করতে চাইছে। অনাদরে–অবহেলায় যেখানে মানুষ শাণিত গাইতি চালায় প্রকৃতির বুকে, মা পৃথিবীর অন্তরে, সেখানে আর কত দিন চলবে মায়ের নীরবে চোখের জল ফেলা? মা কি আর নীরব থাকতে পারে?
সংগত কারণেই পৃথিবী-মাতা তাই আজ অস্থির! বিশ্বপ্রকৃতিও চরম বিরক্ত হয়ে উঠেছে মানুষের ওপর! এখন সে মেতে উঠতে চাইছে তাণ্ডবলীলায়। চূড়ান্ত ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে তার! তাই তার চরম আক্রোশ নিয়ে ভেঙে চুরমার, একেবারেই ধূলিসাৎ করে দিতে চায় সে মানুষের দর্পকে! মানুষকে তাই এখন, অভূতপূর্ব ভয়ানক চিত্র দেখতে হচ্ছে! তার ভয়াবহতার শিকার হতে হচ্ছে!
বিজ্ঞানের নামে অজ্ঞানের যত হোলিখেলা, নৈতিকতার, সামাজিকতার অবক্ষয়, রিপুর যন্ত্রণায় তাড়িত এ মানুষকেই এখন অজ্ঞাতনামা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে, যন্ত্রণায় ভুগে জীবন দিতে হচ্ছে অকালে! এই কি তবে সভ্যতার চরম বিকাশের চূড়ান্ত ফল এবং বিশ্বমানবের আকাঙ্ক্ষিত পরম প্রাপ্তি?
মানুষের সমাজের, রাষ্ট্রের কেউ কেউ সন্ত্রাসকে লালন করছে। তারা অন্তরালে, সন্ত্রাসীদের কাছে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের জোগান দিচ্ছে। নানা ইস্যুকে পুঁজি করে, এ বিশ্বকে অস্থির করে তোলার ষড়যন্ত্র করছে। আবার কিছু শান্তিবাদী মানুষ, প্রতিবাদ করছেন এত অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে। তাঁরা সরব হয়ে উদাত্ত কণ্ঠে শান্তির ললিত বাণী দিনরাত প্রচার করে যাচ্ছেন। এই পৃথিবীকে, প্রকৃতিকে, মানবসভ্যতাকে সুরক্ষা করার আকুল আহ্বান জানাচ্ছেন তাঁরা। প্রশ্ন, এখন আমরা কী করব? মানবতার কাছে, এই সব অশুভ শক্তির পরাজয় কি হবে না কোনো দিন? দুশ্চরিত্রসম্পন্ন ‘মানুষ’ কি তার দানবীয় চরিত্র ছুঁড়ে ফেলে; পরিশেষে মানব হয়ে উঠবে না?
এই চলমান চিত্র আমাদের আগামী পৃথিবীর এবং প্রজন্মের জন্য সুখকর নয়! মনে রাখতেই হবে আমাদের, আমরা ভবিষ্যতের এবং আমাদের উত্তর-প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি, একটি অনাবাদি, জরাগ্রস্ত এবং ধ্বংসোন্মুখ পৃথিবী! এই সময়ের জন্য, এটাই আমাদের জন্য চরম বাস্তবতা! তাই, এই পৃথিবীর অধিবাসী, আমাদের সবাইকে এখন এক কাতারে দাঁড়িয়ে বলতে হবে, ‘না! এভাবে আর নয়! আমাদের এই পৃথ্বীমাতাকে, এই মানবসভ্যতাকে আসন্ন ধ্বংস থেকে রক্ষা করতেই হবে। প্রতিহত করতে হবে সব ষড়যন্ত্র। এই সময়, সম্ভাব্য সব ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে হবে। পৃথ্বীমাতার বুকের ওপর জেঁকে, চেপে বসা দানবকে প্রতিহত করতেই হবে। এখন বিশ্বমানবকে সংঘবদ্ধ এবং দৃঢ় সংকল্পে সুসংহত হয়ে এই অচলায়তনকে ভাঙতে হবে! আমাদের প্রিয় পৃথ্বীমাতাকে রাহুমুক্ত করতেই হবে!’
অন্যদিকে এখন শুনি, বিশ্বমানবের কণ্ঠে আহাজারি, ‘আমাদের সকলের মমতাময়ী এই ধরিত্রী মায়ের, সব কিছুই কি ফুরিয়ে যাচ্ছে? নিঃশেষ হতে হতে কি একপর্যায়, এই পৃথিবী, মহাশূন্য থেকে ছুটে আসা কোন উল্কাপিণ্ডের আঘাতে জ্বলে-পুড়ে, ভেঙ্গে-চূরে একেবারেই ছাই হয়ে যাবে? তখন কোথায় থাকবো মানুষ আমরা? কোথায় থাকবে আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্বপ্ন-সাধনা-সভ্যতা?’
তাই তাঁরা, অসহায় সবাইকে একযোগে আজ কেঁদে কেঁদে আমাদের ধরিত্রীমাতাকে উদ্দেশ করে বলছেন,
‘মা, আমার সাধ না মিটিল;
আশা না পুরিল,
সকলই ফুরায়ে যায় মা ...!’
হ্যাঁ। এই সুন্দর পৃথিবীকে সুরক্ষার, অগ্রসরমান মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার পবিত্র দায়িত্ব বিশ্ববাসী আমাদের সবারই! এই শপথে দৃঢ়চিত্ত হয়ে, আমাদের এগিয়ে আসতেই হবে।
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]