প্যারিসে ঈদ: উৎসব আর নিঃসঙ্গতা
ঈদ মানেই উৎসব–আনন্দ। পরিবার ও আত্মীয়দের সান্নিধ্য। বাংলাদেশে ঈদ মানে ভোরে সেমাইয়ের সুগন্ধ, নতুন পোশাক, কোলাকুলি আর উৎসবের আমেজে মাখা একটি দিন। কিন্তু প্রবাসে সেই উৎসবের রং একই থাকে না, বিশেষ করে প্যারিসের মতো এক ব্যস্ত শহরে। যেখানে ছুটির দিনও অনেকে কাজে ব্যস্ত।
প্যারিসে ঈদের দিন শুরু হয় খুব ভোরে। বাংলাদেশি ও অন্যান্য মুসলিম কমিউনিটির মানুষ সকাল সকাল উঠে ঈদের নামাজের প্রস্তুতি নেন। কেউ যান গ্র্যান্ড মসজিদ অব প্যারিসে, কেউবা লা-কুরনোভ, ববিনি কিংবা সেন্ট ডেনিসের বাংলাদেশি মসজিদে। নামাজের পর কিছুক্ষণের জন্য মনে হয় যেন একটুখানি বাংলাদেশ ফিরে এসেছে এই শহরের বুকে। সবাই কোলাকুলি করেন একে অপরকে শুভেচ্ছা জানান। কিন্তু নামাজ শেষে যখন যার যার বাসায় ফিরে আসেন, তখন সেই উষ্ণতা যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে।
বাংলাদেশে ঈদের দিন মানেই আত্মীয়দের বাড়িতে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা উৎসবমুখর পরিবেশে সময় কাটানো। কিন্তু প্যারিসে প্রবাসজীবনে সেই সুযোগ খুবই সীমিত। অনেকের পরিবার বাংলাদেশে থাকে, কেউ একা, কেউবা ছোট পরিবার নিয়ে থাকলেও ঈদের দিনটিকে স্বাভাবিক কর্মদিবসের মতোই কাটাতে হয়। অনেকেই অফিস বা দোকানে যান। কারণ, ফ্রান্সে ঈদে কোনো সরকারি ছুটি নয়।
অনেক প্রবাসী ঈদের দিনটি কাটান স্মৃতিচারণে। হয়তো সকালে নামাজ পড়লেন। তারপর বাসায় ফিরে মায়ের হাতের সেমাই কিংবা বাবার সঙ্গে বাজারে যাওয়ার স্মৃতি মনে করলেন। একাকিত্ব যেন ঈদের দিন আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তবে সবকিছুই যে বিষাদময়, তা নয়। অনেকেই চেষ্টা করেন ঈদকে রাঙিয়ে তুলতে। প্যারিসের বাংলাদেশি কমিউনিটির কেউ কেউ বাসায় বন্ধুদের দাওয়াত দেন, কেউ রেস্টুরেন্টে মিলিত হন। বাংলাদেশি হালাল রেস্টুরেন্টগুলোয় বিশেষ আয়োজন থাকে—কাচ্চি বিরিয়ানি, হালিম, রোস্ট, মিষ্টি, যা ঈদের স্বাদকে কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনে।
কেউ কেউ লা ভিলেত পার্ক বা আইফেল টাওয়ারের আশপাশে বন্ধুদের নিয়ে সময় কাটান। হাসি-ঠাট্টা, স্মৃতিচারণ গল্পগুজবের মধ্য দিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু এসব আয়োজনেও যেন কোথাও একধরনের শূন্যতা থেকেই যায় পরিবারের স্পর্শ, মায়ের হাতের রান্না কিংবা বাবার ঈদ সালাম দেওয়ার সেই চিরচেনা মুহূর্তগুলোর অভাব কোনোভাবেই পূরণ হয় না।
প্রবাসজীবনে ঈদের আনন্দের একটি বড় অংশ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্দী। ভিডিও কলে দেশে থাকা পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে কথা বলা, ফেসবুকে ঈদের ছবি আপলোড করা, আত্মীয়দের ঈদ মোবারক জানানো—এসবের মধ্য দিয়েই অনেকে ঈদের আনন্দ অনুভব করার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাস্তবের ছোঁয়া ছাড়া ভার্চ্যুয়াল সংযোগ কখনো সেই শূন্যতা পূরণ করতে পারে না।
প্যারিসের ঈদ আসলে একধরনের মিশ্র অনুভূতির নাম। একদিকে ঈদের নামাজ বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা খাবার আড্ডা—এসব উৎসবের আমেজ তৈরি করে। অন্যদিকে পরিবারের অভাব কর্মব্যস্ততা একাকিত্ব আর সেই চিরচেনা উৎসবের উষ্ণতা না পাওয়ার বেদনা এই দিনকে খানিকটা বিষণ্ন করেও তোলে।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসীরা নিজেদের মতো করে ঈদকে সাজিয়ে নিয়েছেন। কেউ বন্ধুদের সঙ্গে ছোট আয়োজন করেন কেউবা কাজের ব্যস্ততার মধ্যেই ঈদের খুশি খুঁজে নেন। হয়তো এই ব্যস্ত শহরের কোলাহলে ঈদ তার চিরচেনা রং হারিয়েছে, কিন্তু স্মৃতির পাতায় এখনো জমে থাকে সেই সোনালি সময়ের ছবি—শৈশবের ঈদ বাবার সঙ্গে নামাজ মায়ের হাতের সেমাই আর ভাইবোনদের সঙ্গে হাসির খুনসুটি।
এই স্মৃতিগুলোই হয়তো প্রবাসী ঈদের আসল আনন্দ, যা আমরা বুকের গভীরে আগলে রাখি।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]