একজন প্রবাসীর গল্প

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রবাসে এসে কেউ উন্নতির শিখরে পৌঁছে যায়, কেউবা সব সময় জীবনযুদ্ধ  করতে থাকে। আবার কেউবা প্রবাসে কোনো কিছু করতে না পেরে বুকভরা কষ্ট নিয়ে দেশে চলে যায়।

অপুর বাবার বন্ধু একদিন তাদের বাসায় আসে এবং তার বাবাকে বলে তোমার ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে দাও। ভালো একটি দেশের ভিসা আছে। সে জন্য অনেক টাকা লাগবে। তিন দিনের মধ্যে আট লাখ টাকার ব্যবস্থা করতে পারলে তিন মাসের মধ্যে তোমার ছেলে বিদেশ যেতে পারবে। অপুর বাবা তার বন্ধুর কথায় বিশ্বাস করে রাজি হয়ে যায়। অপুর বাবা তার ব্যবসার পার্টনারদের কাছ থেকে ধার করে তিন দিনের মধ্যে আট লাখ টাকার ব্যবস্থা করে। তার বাবার বন্ধুকে ফোন দিয়ে বলে টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তুমি এসে নিয়ে যাও। তার বাবার বন্ধু এসে টাকা নিয়ে যায়।

তিন মাস হয়ে গেল কিন্তু অপুর বিদেশ যাওয়ার কোনো খবর নেই। অপু তার বাবার বন্ধুকে ফোন দেয়। উনি বলেন আর কিছুদিনের মধ্যে ভিসা হয়ে যাবে। তুমি রেডি থেকো। এভাবে আরও কয়েক মাস হয়ে গেল, তার ভিসার কোনো খবর নেই। ফোন দিলে রিসিভ করে ব্যস্ততা দেখায়। আমি তোমাকে পরে ফোন দিচ্ছি বলে কেটে দেয়। এক বছর কেটে গেল। অপু বিদেশ যাওয়ার আশা ছেড়ে দিল। একদিন অপুর বাবা ওনাকে ফোন দিয়ে অনেক বকাঝকা করেন। অবশেষে দেড় বছর পর বিদেশ যেতে পারে। এই দেড় বছর অপেক্ষা করাটা ছিল অপুর জন্য অনেক কষ্টের।

বিদেশ গিয়ে তার বাবার বন্ধুর এক পরিচিত লোকের বাসায় গিয়ে ওঠে। সে বাসায় তারা আটজন থাকত। কিছুদিন পর তার বাবার বন্ধু তাকে ফোন দেয়। তাকে আগামী তিন মাসের মধ্যে আরও দুই লাখ টাকা দিতে হবে। অপু তার বাবাকে ফোন দিয়ে জানায়। তার বাবা এ কথা শুনে রেগে তো পুরো আগুন। তার বাবার বন্ধুকে ফোন দিয়ে অনেক বকাঝকা করে। তিন মাসের কথা বলে এক বছর পরে আমার ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছ। কিন্তু তার বাবার বন্ধু বেশি কথা না বলে ফোন কেটে দেয়। কিছুদিন পর তার বাবার বন্ধু তাকে ফোন দিয়ে ভয় দেখাতে শুরু করে। তুমি যদি আগামী তিন মাসের মধ্যে দুই লাখ টাকা দিতে না পারো, তাহলে তোমাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

এদিকে বিদেশে এসে অপুর কোনো কাজ নেই। পরিচিত সবাইকে বলে আমাকে একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেন। তা না হলে আমাকে অনেক বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। এক মাস হয়ে গেল কিন্তু সে কোনো কাজ পেল না। দেশ থেকে যে টাকা সঙ্গে করে এনেছে, সে টাকাও শেষ হয়ে গেছে। এক মাস বাসাভাড়া দিতে পারলেও পরের মাসের বাসাভাড়া দিতে পারেনি। বাসার দায়িত্বে যিনি ছিলেন, তিনি অপুকে ডেকে এনে সবার সামনে অপমান করলেন। পরের মাসের বাসাভাড়া দিতে না পারলে তোমাকে বাসা ছেড়ে দিতে হবে। অপু অনেক চিন্তায় পড়ে গেল। একদিকে তার বাবার বন্ধুর দুই লাখ টাকা, অন্যদিকে বাসাভাড়া দিতে না পারলে বাসা ছেড়ে দেওয়া। এ যেন অপুর সামনে দাঁড়াল এক মহাবিপদ!

অপু পরিচিত সবাইকে একটি কাজ সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে। কিছুদিন পর একসঙ্গে দুটি কাজ পেয়ে যায়। একটি কাজ শেষ করে আরেকটি কাজে যেত। প্রতিদিন দু–তিন ঘণ্টার বেশি ঘুমানোর সময় পেত না। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করারও সময় পেত না। টাকার প্রয়োজনে জীবনযুদ্ধে নেমে পড়ে। সকালের কাজটা ছিল ফ্যাক্টরিতে। ভোরবেলা উঠে এক ঘণ্টা জার্নি করে ফ্যাক্টরির কাজে যেত। তখন ছিল গরমকাল। তাকে ফ্যাক্টরির থেকে একটু দূরে একটি গুদামঘরে নিয়ে গেল। তার কাজ হলো গুদামঘর থেকে ২০ কেজি ওজনের পেঁয়াজের বক্স বহন করে গাড়িতে তুলে দিতে হবে। অপু এ ধরনের কাজ এর আগে কখনো করিনি। ঘামে পুরো শরীর ভিজে যেত আর পানির পিপাসায় তার গলা শুকিয়ে যেত। তার এ কাজ করতে অনেক কষ্ট হয়ে যেত।

বিকেলের কাজটি ছিল রেস্তোরাঁয়। মেশিনের মাধ্যমে প্লেট ধুয়ে সেগুলোকে মুছে সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখতে হতো। এ ধরনের কাজও সে কখনো করেনি কিন্তু টাকার প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে এ কাজ করতে হচ্ছে। চাকরি করে যে বেতন পেত, তা দিয়ে বাসাভাড়া ঠিকমতো দিতে পারলেও তার বাবার বন্ধুর টাকা সময়মতো পরিশোধ করতে পারেনি। আরও কিছুদিন সময় নিয়ে সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

অপু প্রতি মাসে যা বেতন পেত, সব টাকা তার বাবার কাছে পাঠিয়ে দিত। তার বাবা ব্যবসায় সব টাকা ইনভেস্ট করত এবং অপুকে বলে তুমি দেশে এলে আমার ব্যবসায় বসতে পারবে। এভাবে তার প্রবাসে পাঁচ বছর কেটে যায়। তার বাবা ফোন দিয়ে বলে তার জন্য মেয়ে দেখে রেখেছে। বিয়ে করার জন্য তাকে দেশে আসতে হবে। তার বাবার কথামতো এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে যায় এবং তার বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে। এক মাসের ছুটি শেষ হওয়ার পর প্রবাসে চলে যায়। দুই বছর পর আবার দেশে আসে এবং তার বাবাকে বলে আমি আর প্রবাসে যাব না। আমি ব্যবসা দেখাশোনা করব। তার বাবা তাকে বলে ঠিক আছে। এভাবে তিন মাস কেটে যাওয়ার পর তার মা বলে তুমি বিদেশ চলে যাও। বিদেশে অনেক টাকা আয় করা যায় কিন্তু দেশে ব্যবসা করে এত টাকা ইনকাম করা যায় না। আরও বলে তোমার বাবার একজনের আয়ে সংসার চালানো অনেক কঠিন। অপুর অনেক মন খারাপ হয়ে যায়।

অপু বিদেশ গিয়ে একটি ফ্যাক্টরিতে লং টাইমের কাজ নেয়। দুই বছর কাজ করার পর ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে তার ভিসা নষ্ট হয়ে যায়। সে রিফিউজি ভিসা নিয়ে নেয়। এভাবে পাঁচ বছর কেটে যায়। অপু তার বউকে ফোন দিলে তার বউ বলে তুমি দেশে আসো। তোমাকে দেখতে মন চায়। অনেক দিন হলো তোমাকে দেখি না। কিন্তু অপুর রিফিউজি ভিসার কারণে দেশে যেতে পারছে না। দেশে যেতে হলে তাকে একেবারের জন্য চলে যেতে হবে। কিন্তু তার বাবা-মা তাকে দেশে যাওয়ার জন্য বারণ করত। তাই সে অনেক কষ্ট নিয়ে বছরের পর বছর বিদেশে পড়ে থাকত।

অপুর বাবা তার পাঠানো টাকা দিয়ে একটি জমি কেনে। সে বিদেশে ছিল বলে জমিটা তার বাবার নামে দলিল করে। তার একজন ছোট ভাই ছিল। অপু তার পড়াশোনার খরচ দিত। তার ছোট ভাই লেখাপড়া শেষ করে ভালো একটি চাকরি করে। তার ছোট ভাই তাকে না জানিয়ে বাবা-মাকে ম্যানেজ করে জমিটি নিজের নামে দলিল করে ফেলে। সে কথা অপুর বউ কিছুদিন পর জানতে পারে এবং তাকে ফোন দিয়ে সবকিছু খুলে বলে। অপু তার বাবা-মাকে ফোন দিয়ে জমির বিষয়ে আলাপ করে। তার বাবা-মা তাকে বলে তুমি তো বিদেশ থাকো, অনেক টাকা রোজগার করো। তোমার জমি কেনার ক্ষমতা আছে কিন্তু তোমার ছোট ভাই দেশে অল্প টাকার বেতনে চাকরি করে। তাই জমিটা তোমার ছোট ভাইয়ের নামে লিখে দিলাম।

এ কথা শুনে অপুর মনে অনেক কষ্ট হয়। তার বুক ফেটে কান্না আসতে লাগল। আর মনে মনে ভাবতে লাগল আমি প্রবাসে থাকি বলে আমাকে কেউ কোনো কাজে একবারও জিজ্ঞেস করে না। এমনকি নিজের পাঠানো টাকা দিয়ে জমি কিনে তার ছোট ভাইয়ের নামে দলিল করে দেয়। ছোট ভাইয়ের পড়ালেখার সব খরচ সে বহন করত অথচ তার ছোট ভাইও তাকে জিজ্ঞেস করেনি। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করলে, তার ছোট ভাই তার সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করে। তার ছোট ভাইয়ের ব্যবহারে সে অনেক কষ্ট পায়। শরণার্থী (রিফিউজি) ভিসার কারণে দেশে যেতে মন চাইলেও যেতে পারছে না। এ যেন এক মানসিক যন্ত্রণা!
অপু দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর বলে…হায় রে প্রবাসজীবন!