কৃষ্ণচূড়া

অলঙ্করণ: মাসুক হেলাল

চন্দ্রা চুপচাপ বসে আছে একটা হুড ফেলা রিকশায়, ক্রিসেন্ট লেকের মাঝামাঝি একটা জায়গায় কৃষ্ণচূড়াগাছের নিচে আর খুবই মনোযোগ দিয়ে রিকশাগুলোর আসা-যাওয়া দেখছে, পথচারীদের দেখছে, ঠিক রিকশা নয়, আসলে রিকশার যাত্রীদের দেখছে। যদি আবার একবার দেখা পায়...!

একটু দূরে নিচে বসে থাকা রিকশাওয়ালা চাচা বসে আছে, মাঝে মাঝে বলছে, ‘আপা আর কতক্ষণ বইসা থাকবেন? কেউ কি আইব!’

চন্দ্রা খুবই বিরক্ত হলেও ঠান্ডা গলায় বলল, ‘চাচা, ঘণ্টাপ্রতি যা বলেছেন, তা-ই তো দেব, আপনার সমস্যা কোথায়? আমি আরও এক ঘণ্টা থাকব। আপনাকে টাকা অ্যাডভান্স দেব? বাদাম খাবেন? চা বা ঝালমুড়ি? কিনে খান, টাকা দিচ্ছি, ভাড়ার টাকা ছাড়াই দিচ্ছি...তা-ও থাকেন প্লিজ, আর বেশি দূরে যাবেন না, বেশি কথাও বলবেন না, এদিকটাতেই থাকেন।’

রিকশাওয়ালা বিরস মুখে টাকা নিয়ে চা কিনতে গেল।

চন্দ্রা বসে রইল কৃষ্ণচূড়াগাছের দিকে তাকিয়ে..আগুনরঙা কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি উড়ে এসে তার হাতে পড়ল, মনের ভেতরটাও পুড়িয়ে আগুন করে দিল যেন..

আচ্ছা এমন কখনো হয়? যে কেউ শুনলে তো চন্দ্রাকে পাগল ভাববে। চন্দ্রা কাউকে বলতেও পারছে না...প্রতি মাসের ২৯ তারিখ চন্দ্রা এখানে এসে দুই ঘণ্টা বসে থাকে, বাসা থেকে শপিংয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়, এরপর আসাদ গেটের আড়ংয়ে এসে গাড়িচালককে বিদায় করে দেয়...এরপর বয়স্ক দেখে একটা রিকশাওয়ালাকে দুই ঘণ্টার চুক্তি করে ক্রিসেন্ট লেকের মাঝামাঝি কৃষ্ণচূড়াগাছের নিচে এসে বসে থাকে।

কেন?

ঠিক ১৫ বছর আগে ২৯ ফেব্রুয়ারি চন্দ্রারা কয়েকজন বান্ধবী মিলে লাল শাড়ি পরে ক্রিসেন্ট লেকে এসেছিল কৃষ্ণচূড়া ফুলের সঙ্গে ছবি তুলবে বলে, চন্দ্রাও এসেছিল, কিন্তু একটু দেরিতে...। যে রিকশায় করে এসেছিল, সেই রিকশার বারবার চেইন পড়ে যাচ্ছিল।

চন্দ্রা খুবই বিরক্ত হয়ে রিকশাওয়ালা মামাকে বলল, ‘কী রিকশা নিয়ে বের হয়েছেন, খালি চেইন পড়ে। দুইবার হলো ১০ মিনিটের মধ্যে...’

চাঁদের মতো গায়ের রং চন্দ্রার, তাই বুঝি নামও চন্দ্রা। পরেছিল আগুনরঙা শাড়ি, ঠিক যেন স্বয়ং কৃষ্ণচূড়া। মায়ের শাড়ির আলমারিতে কোনো লাল শাড়ি খুঁজে পায়নি চন্দ্রা, তাই খালার কেনা আগুনরঙা নতুন শাড়িটাই বেছে নিয়েছিল সে। আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে গেল—২১ বছরের ভয়ংকর রূপবতী কেউ। কাজল আর ছোট্ট কালো টিপ দিয়ে ঠিক সময়েই বের হয়েছিল চন্দ্রা, দুই ঘণ্টার জন্য মাকে বলে।

শেষ পর্যন্ত আবার যখন তৃতীয়বারের মতো ক্রিসেন্ট লেকে এসে রিকশার চেন পড়ল, তখন চন্দ্রার মেজাজ খুবই খারাপ হলো...। সে প্রায় এসেই পড়ছিল, আর একটু পরই নামতে পারত, আবার চেইন পড়ল! রিকশাওয়ালা মামা চেইন ঠিক করছে, চন্দ্রা বিরক্ত মুখে বারবার ঘড়ি দেখছে...এমন সময় দুটি ছেলে পাশ দিয়ে শিস দিতে দিতে যাচ্ছিল, যাওয়ার সময় চন্দ্রাকে দেখেই থেমে গেল। চন্দ্রার সেদিকে চোখ পড়তেই শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল...এত বিশ্রী চাহনি ছেলে দুটির, যেন চোখ দিয়েই গিলে ফেলবে।

চন্দ্রা রিকশাওয়ালা মামাকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি করেন মামা, তাড়াতাড়ি।’

ছেলে দুটি এগিয়ে আসছে চন্দ্রার দিকে, বলছে, ‘এই আগুন এখানে একা, মামা আর কী করবে...., আমরা আছি তো।’

চন্দ্রা খুবই ভয় পেল, কিন্তু বাইরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে, আড়চোখে চারপাশ দেখছে, ছেলে দুটি এগোচ্ছে...তার দিকে। রিকশাওয়ালা মামা বলে উঠল, ‘এদিকে আসেন কেন? ভদ্রলোকের মাইয়া, অন্যদিকে যান...’

ছেলে দুটি জোরে জোরে হাসছে...বলছে, ‘আমরা কি খারাপ নাকি? আমরাও ভদ্রলোক!’

মুহূর্তেই সবকিছু ঘটে যাচ্ছে...চন্দ্রা কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। ভেতরে পুরো শরীর ঘেমে ভিজে গেছে...ভয়ে কাঁপছে। মনে মনে আয়াতুল কুরসি পড়ছে...

হঠাৎ করে চোখ পড়ল ক্রিসেন্ট লেকের ফুটপাত দিয়ে একটা শ্যামলা, লম্বা, শুকনা ছেলে একটু অন্যমনস্ক হয়ে হেঁটে আসছে। চন্দ্রার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ছেলেটা থেমে গেল, চন্দ্রার কী যেন হলো। মনে হলো, অনেক দিনের চেনা কেউ, চন্দ্রা আগেপিছে কোনো কিছু চিন্তা না করেই রিকশা থেকে নেমেই দৌড় দিয়ে গিয়ে ছেলেটার হাত ধরে ফেলল। বলে উঠল, ‘তুমি এত দেরি করে এলে কেন? কেন? আমি সেই কখন থেকে বসে আছি, সময়ের কোনো কাণ্ডজ্ঞান হবে না কোনো দিন? দুটি বখাটে ছেলে কতক্ষণ ধরে জ্বালাচ্ছে আমাকে, এত অদ্ভুত তুমি! আমার কথা একবারও মনে থাকে না?’

টানা কথাগুলো বলে চন্দ্রা হাঁপাচ্ছে।

ছেলেটা খুবই শান্ত চাহনিতে চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে আছে, চন্দ্রা শক্ত করে ছেলেটার হাত ধরে আছে।

রিকশাওয়ালা মামা বলে উঠল, ‘ঠিক সময়ে আসছেন মামা, ছেঁচড়া পোলা দুইটা আপামণিকে জ্বালাইতেছিল, আমি মানা করছি, আমার কথা শোনে না। চেইন ঠিক হইছে, ওঠেন আপনারা...তবে এরপর আপামণির আগে আইসেন।’

বখাটে ছেলে দুটি যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানেই মুখ চুপসে দাঁড়িয়ে আছে।

চন্দ্রা ছেলেটাকে হাত ধরা অবস্থায় টেনে নিয়ে রিকশায় উঠে বসল, ছেলেটা এখনো চুপ। রিকশা এগোচ্ছে...একদম অচেনা-অজানা একটা ছেলের সঙ্গে রিকশায় বসতে চন্দ্রার একটুও খারাপ লাগছে না। মনে হচ্ছে, কত যুগের চেনা। শক্ত করে ধরে থাকা হাতটা ছেড়ে দিল এবার, সুনসান নীরবতা, শুধু নিশ্বাসের শব্দ।

একটু পর নীরবতা ভঙ্গ করে চন্দ্রাই বলে উঠল, ‘আপনি না থাকলে আজ যে কী হতো, আমি বান্ধবীদের সঙ্গে শাড়ি পরে ছবি তুলব বলে বাসা থেকে বেরিয়েছি। রাস্তায় রিকশার চেইন পড়ে যাওয়ায় থামতে হয়। হঠাৎ দুটি বখাটে ছেলে এসে জ্বালাচ্ছিল। তাই কোনো উপায় না দেখে দৌড়ে গিয়ে আপনার হাত ধরে ফেলেছিলাম, কিছু মনে করেননি তো?’

ছেলেটি এই প্রথম বলে উঠল, ‘আমি বুঝতে পেরেছি, কিন্তু আপনি কীভাবে বুঝলেন যে আমি বখাটে নই?’

চন্দ্রা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মেয়েরা ছেলেদের চোখ দেখলেই বুঝতে পারে কে কেমন!’

ছেলেটি বলে উঠল, ‘আপনার বাসায় আয়না নেই?’

চন্দ্রা অবাক হয়ে বলল, ‘কেন? আছে তো!’

‘এরপর বাসা থেকে বের হওয়ার সময় কাউকে সঙ্গে নিয়ে বের হবেন, আজ বোধ হয় আয়নায় নিজেকে দেখে বের হননি।’

চন্দ্রা চুপ হয়ে গেল, কোনো কথা খুঁজে পেল না।

কানে পড়ল বান্ধবীদের গলা, সে তার বান্ধবীদের দেখতে পাচ্ছে, চন্দ্রা রিকশাওয়ালাকে থামতে বলল। বুঝে উঠতে পারছে না বান্ধবীদের কী বলবে! ভাড়া দিয়ে রিকশাওয়ালা মামাকে বলল, ‘উনি কোথায় যাবেন, নামিয়ে দিয়েন, মামা।’

রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে চন্দ্রার দিকে...

চন্দ্রার বান্ধবীরা হইচই করতে করতে এগিয়ে এল। কেউ বলছে, ‘এত দেরি কেন?’ কেউ বলছে, ‘ওই ছেলেটা কে?’ কেউ বলছে, ‘কিরে, তুই তো নিজেই কৃষ্ণচূড়া হয়ে এসেছিস!’ কেউ বলছে, ‘আগে বলিসনি তো তোর কেউ আছে।’

প্রশ্নের ভিড়ে হারিয়ে গেল চন্দ্রা। শুধু জানতে পারল না তখন যে সে নিজেও কিছু হারিয়ে ফেলল জীবন থেকে!

পরে বান্ধবীরা সব শুনে খুবই অবাক হয়েছে। সুমি তো বলেই বসল, ‘তুই এত নিরামিষ কেন রে? ছেলেটাকে একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিবি না? ঠিকানা নিসনি, নামটাও জানিস না, এত সুন্দর একটা গল্পের শুরুতেই শেষ! তোকে দেখেই তো ছেলেটার প্রেমে পড়ে যাওয়ার কথা!’

চন্দ্রার যে আফসোসের শেষ নেই। আসলেই সে ছেলেটার নাম, কোথায় থাকে বা কী পড়ে, কিছুই জানে না। এমনকি নিজের নাম-ঠিকানাও দেয়নি, সারাক্ষণ মনের ভেতরের খোঁচা দেয়, দলা পাকানো গুমোট কান্নাকে টেনে আনে। এরপর কত রাত যে চন্দ্রা কেঁদেছে...কতবার যে ঠিক সেই এক জায়গাতেই এসেছে...জানতেও পারবে না কেউ তা।

একে একে কেটে গেছে ১৫টি বছর! ওই ঘটনার দুই বছর পর চন্দ্রার বিয়ে হয়ে যায় বেশ ধুমধাম করে। বিয়েতে না বলার কোনো কারণ নেই, কে বিশ্বাস করবে নাম না জানা, অজানা-অচেনা এক ছেলের প্রেমে পড়ে গেছে সে!

যে সারাক্ষণ মাথার ভেতরে থাকে।

চন্দ্রার বর বেশ ভালো, সুদর্শন, ব্যবসায়ী...নামকরা শিল্পপতির ছেলে। চন্দ্রার জন্য তার ভালো লাগা আছে, কিন্তু প্রেম নেই। ভয়াবহ ব্যস্ত সে, দম ফেলার সময় নেই। চন্দ্রার শ্বশুরের মৃত্যুর পর বড় ছেলে হিসেবে তাকেই ব্যবসার সবকিছু তদারকি করতে হয়; কিন্তু জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীর উপহার সময়মতো পায়। বছরে দুইবার বেড়াতেও নিয়ে যায় দূরে কোথাও, না দেখা কোনো শহর বা দেশে। সবচেয়ে বড় কথা, চন্দ্রাকে ঘাঁটায় না সে, তাকে তার মতো থাকতে দেয়, ভাগ্যিস দেয় । চন্দ্রার একটা ১০ বছরের ছেলেও আছে। সবকিছুই নিয়মমাফিক চলে। সবকিছুই আছে চন্দ্রার, কিন্তু কিছু একটা নেই, একদমই নেই...।

মনের ভেতরের দীর্ঘশ্বাস দিন দিন ভারী হয়ে আসে সেই ২৯ ফেব্রুয়ারির পর থেকে। চন্দ্রা প্রতি মাসের ২৯ তারিখ ক্রিসেন্ট লেক এসে বসে থাকে ঠিক বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা, যদি সে মনে করে একদিন আসে...,

আচ্ছা উনার কি মনে পড়ে চন্দ্রার কথা?

নাকি স্বার্থপর মেয়ে ভেবে চন্দ্রাকে ভুলে গেছে!

চন্দ্রা বসে বসে ভাবে, এমন হলো কেন তার জীবন? এক মুহূর্তের জন্য সে ভুলতে পারে না সেই চেহারা...চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে। সে কি আর কোনো দিন দেখা পাবে না? লম্বা, শ্যামলা, শুকনা নাম না জানা ছেলেটা কে? প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই কষ্টে চন্দ্রার বুক ফেটে যায়, সব ফেব্রুয়ারি মাসে ২৯ তারিখ নেই যে, অপেক্ষার পালা আরও দীর্ঘতর হয়!