ইলিশা

ইলিশ মাছ

বাংলাদেশে জরিপ করলে দেখা যাবে, একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন বয়সের মানুষ তাদের জীবনে কখনো ইলিশ মাছ খায়নি! কারণ, এই মাছ অনেক মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। অথচ ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ।

সাধারণত চাষের মাছ উৎপাদন করতে অনেক টাকা খরচ হয়। কিন্তু ভালো মানের একটি রুই বা কাতল মাছ যে দামে বিক্রি হয়, তার থেকে পাঁচ গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বিনা খরচায় উৎপাদিত ইলিশ। ইলিশ প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত হয়, এর জন্য কোনো খরচ লাগে না। শুধু মাছ আহরণ করতে খরচ হয়।

নব্বই দশকের শুরুতে স্কুলে থাকতে আব্বার সঙ্গে বাজারে যেতাম। সকালের বাজার বসত কুলাউড়ার দক্ষিণ বাজারে। বাজারে সকালে যেসব ইলিশ পাওয়া যেত, তা থাকত বরফে মোড়ানো আগের দিনের অবিক্রীত ইলিশ। সকালের অন্যান্য বাজার সেরে আমরা ইলিশ কিনতে যেতাম দুপুরের পর। কারণ চাঁদপুরের বাক্সভর্তি ইলিশ নিয়ে লোকাল ট্রেন কুলাউড়া স্টেশনে এসে পৌঁছাত দুপুর বারোটা–একটার দিকে। আবার কখনো ট্রেন দেরি করলে দুইটা–আড়াইটাও বাজত। ট্রেন থেকে ইলিশের বাক্স খালাস করে দ্রুত নেওয়া হতো বাজারে। বাক্স ভেঙে বরফের ভেতর থেকে রুপালি ইলিশ বেরিয়ে আসত। টাটকা কাঁচা ইলিশের গন্ধে বাজার সয়লাব হয়ে যেত।

তখন মাছ ওজন করে বেচার বালাই ছিল না। চোখের আন্দাজে ও হাত দিয়ে ধরে মাছের দাম নির্ধারণ করা হতো। ৫০ থেকে ৭০ টাকায় এক দেড় কেজি ওজনের ইলিশ কিনতাম আর বড় সাইজের দুই–আড়াই কেজি ওজনের ইলিশ কিনতাম ১০০ থেকে ১৫০ টাকার ভেতরে। সেই সময়ের এক শ টাকা দামের ইলিশ এখনকার বাজারে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকার ওপরে।

ইলিশের এই উচ্চমূল্যের জন্য যে কারণগুলোর কথা জানা যায়, তা হলো ইলিশের প্রাপ্যতা, নদী ও সমুদ্রের ইলিশের মধ্যে স্বাদের বৈষম্য, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহন ব্যয়, জেলে ও ট্রলারের খরচ তথা ব্যবসার বিনিয়োগ ও অন্যান্য ব্যয়।

জানা যায়, দশ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করতে প্রায় ছয় হাজার টাকা খরচ হয়।

ইলিশ ধরার জন্য আকৃতিভেদে একেকটি ট্রলার বানাতে ব্যয় হয় এক থেকে দেড় কোটি টাকা। সেগুলো দশ–বারো বছর পর্যন্ত ব্যবহারযোগ্য থাকে।

একটি বড় ট্রলার সমুদ্র গেলে জ্বালানিসহ এর পেছনে সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ টাকা খরচ আছে বলে জানা যায়। ফলে ট্রলারের বিনিয়োগ তুলে আনতে মাছের দাম বেড়ে যায়।

এদিকে জেলের জালে ধরা পড়া ইলিশ তিন থেকে পাঁচ হাত ঘুরে ক্রেতার কাছে আসে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এসব জায়গায় দামের তারতম্যের ওপর বাজারও ওঠানামা করে। এ ছাড়া সিন্ডিকেট তো আছেই।

অন্যদিকে দেশের চাহিদা না মিটিয়ে ইলিশের একটা বড় অংশ রপ্তানি করা হয়। আমরা বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীরা চাইলেই ইলিশ কিনে খেতে পারি বছরের বারো মাস। তবে রপ্তানি না করে যদি দেশের চাহিদা জোগান দেওয়া যায়, তাহলে দেশের অনেক মানুষের পাতে ইলিশ পৌঁছাবে এবং দামও কিছুটা কমবে। আমরা প্রবাসীরা নাহয় দেশে গিয়েই ইলিশ খাব।

ইলিশ মাছের দাম কমাতে হলে এর আহরণের প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে। আরও সহজে ও কম খরচে কীভাবে মাছ ধরা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জেলেদের আধুনিক ও স্বল্প খরচে মাছ ধরার টেকনিকগুলো আমাদের দেশে নিয়ে আসতে হবে। এ ছাড়া ইলিশের দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।

ইলিশ এখন জাতীয় মাছকে ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক হয়ে গেছে। শুধু আন্তর্জাতিকই নয়, ইলিশই পৃথিবীর একমাত্র মাছ, যা রাজনৈতিক মাছও! আবার উৎসবের মাছ হিসেবেও ইলিশ এক নম্বরে। জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক মাছ হিসেবে ইলিশ বিশ্বের সবচেয়ে দামি মাছে পরিণত হচ্ছে দিন দিন।

**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]