এক মায়ের কানাডা ভ্রমণ
১২ মে মা দিবস হিসেবে পালিত হয়। প্রবাস থেকে পাঠানো পাঠকের লেখা থেকে বাছাই করা লেখা প্রকাশিত হচ্ছে দূর পরবাসে।
আমার মা ছিলেন স্মার্ট। না, নিজের মা বলে বলা তা কিন্তু নয়। অত্যন্ত দূরদর্শিতাসম্পন্ন ছিলেন। অথচ লেখাপড়ায় ছিলেন তিনি অষ্টম শ্রেণি পাস। মা ছিলেন অনেক প্রতিভাদীপ্ত একজন সংগ্রামী মানুষ। ছিলেন একজন আদর্শ নারী। পৃথিবীর সব মায়েরাই সন্তান গড়ার কারিগর হন। আমার মা–ও আমাদের সব ভাইবোনদের তাঁরই আদর্শে গড়ে তুলেছিলেন। মায়ের কাছ থেকে আমরা শুধু স্নেহ আর ভালোবাসাই পেয়েছিলাম। শাসন পেয়েছিলাম বাবার কাছ থেকে। সেই স্নেহ, ভালোবাসা ও শাসনের যথাযথ সমন্বয়ের কারণে আমরা এত দূর পর্যন্ত আসতে পেরেছি।
মায়ের আট–আটটি ছেলেমেয়ে আমরা সবাই ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম। জীবদ্দশায় ছেলেমেয়েদের তিনি চাকরি করতেও দেখে গেছেন। শিখিয়ে গেছেন মানুষকে ভালোবাসতে। আর উপদেশ দিয়ে গেছেন মানুষের জন্য কিছু করতে।
যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে মা আমাদের আত্মবিশ্বাসী হতে বলতেন। বলতেন ধৈর্য ধরতে।
আমার মা সেই গুণাগুণগুলো পেয়েছিলেন সম্ভবত আমার নানাজানের কাছ থেকে। আমার নানাজান ছিলেন একজন উদার ও ধর্মভীরু মানুষ। ছিলেন খুব পরিপাটি আর ছিমছাম গোছের। আমার মা ছিলেন নানাজানের বড় মেয়ে। মাকে দেখেছি নানাজানের সঙ্গে খুবই সমীহ করে কথা বলতে।
২০০০ সালের আগস্ট মাসে দেশের সরকারি চাকরি ছেড়ে আমি স্ত্রী ও পুত্র–কন্যা নিয়ে কানাডায় অভিবাসী হয়ে চলে আসি। এসে কিছু একটা করার জন্য আমি মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
আমি কানাডায় আসার পরের বছরেই ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে আমার ছোট ভাই ও তার পরিবারের সঙ্গে মা একদিন ব্রিটিশ এয়ার ওয়েজে চেপে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ঢাকা থেকে টরন্টোতে এসে হাজির হলেন। আমাকেই দেখতে।
আমি তখন এক রেন্টাল অ্যাপার্টমেন্টে পরিবার নিয়ে থাকতাম। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের লিভিং রুমে বসে মা নামাজ পড়তেন আর খুব ভোরে কোরআন তিলাওয়াত করতেন।
টরন্টোতে আসলে মাকে নিয়ে আমি ভালো করে কোথাও বেড়াতে পারিনি। তখন আমার চাকরি ও গাড়ি কিছুই ছিল না। তবুও গাড়ি ভাড়া করে মাকে এদিক–সেদিক ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলাম। একদিন ভাড়া করা গাড়িতে করে নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখাতে নিয়ে গেলে পথে মা বমি করলেন বেশ কয়েকবার। তারপর এল কাঁপুনি দিয়ে জ্বর। জলপ্রপাত আর ভালো করে দেখা হলো না মায়ের। ছোট ভাইকে বললাম তোমরা যাও দেখতে। গিয়ে দেখে আসো। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে কত শত লোক এই নায়াগ্রা ফলস দেখতেই শুধু কানাডায় আসে। আর মাকে নিয়ে আমি পার্কিং লটে গাড়ির ভেতর বসে থাকলাম। একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে মা আমার কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে পড়ে রইলেন গাড়িটির পেছনের সিটে। শুধু পার্কিং লট থেকে ফেরার পথে গাড়ির জানালা দিয়ে কোনোরকম চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলেন নায়াগ্রা ফলস। অঝোরে পানি পড়ার সেই দৃশ্য।
মা বলেছিলেন কানাডা খুব ছিমছাম ও সুন্দর একটা দেশ।
যে কদিন থাকলেন আমার এখানে, মা যেন কেমন অসুস্থ আর কাহিল হয়ে থাকতেন। খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করতে পারতেন না। খেতে রুচি হতো না। আমি বলতাম, ‘মা, তুমি ঠিকমতো খাও না কেন?’
বলতেন, ‘আমার খেতে ইচ্ছা করে না রে বাবা।’
বুঝতে পেরেছিলাম মায়ের শারীরিক অবস্থা ভালো না।
কিন্তু আমার চাকরি নেই। ইনস্যুরেন্স ছিল না। ইচ্ছা করেছিল, কিন্তু মাকে আমি এখানকার কোনো ডাক্তার যে দেখাব বা ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা–নিরীক্ষা করাব, সেই সাহস বা শক্তি আমার ছিল না সেই ক্ষণে। বড়ই অভাগা আমি।
মাঝেমধ্যে আমি মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতাম। আমার দুই বছরের কন্যা তা দেখে আমার কাছে ছুটে আসত। আমার পিঠের কাছে গায়ে গা লাগিয়ে সে–ও শুয়ে পড়ত দাদির কাছে।
এভাবে এক মাস থেকে মায়ের দেশে ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে এল।
দেশে ফিরে যাওয়ার বিদায়ের সেই ক্ষণটা ছিল খুবই বেদনাদায়ক।
প্রাণের ভেতর থেকে খুবই কষ্ট পাচ্ছিলাম। কান্নায় বুকটা ফেটে যাচ্ছিল।
পিয়ারসন বিমানবন্দর পর্যন্ত যেতেও পারলাম না বিদায় দিতে।
অ্যাপার্টমেন্টের নিচ থেকে ট্যাক্সিক্যাবে মাকে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে বিদায় দিলাম।
সেটাই আমার সঙ্গে মায়ের শেষ দেখা।
তারপর খুব অসুস্থ অবস্থায় উড়োজাহাজে বসে মা ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। ঢাকায় গিয়ে পরে ডাক্তার দেখিয়ে নানা টেস্ট করিয়ে জানা গেল যে মায়ের গল-ব্লাডার টিউমার হয়েছে এবং তা অস্ত্রোপচার করে ফেলে দিতে হবে। অস্ত্রোপচার করা হলো। কিন্তু টিউমারটা ছিল বাজে। এক ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। অপারেশনের পর তা ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। দেখতে দেখতেই টার্মিনাল ইলনেসে পড়লেন মা।
আমার জীবনসংগ্রামী মা জননী ক্যানসারের সঙ্গে ফাইট করে জয়ী হতে আর পারলেন না। অপারেশনের ঠিক পাঁচ মাসের মাথায় পরাজিত সৈনিকের বেশে আমার মা চিরবিদায় নিলেন সবার কাছ থেকে। চলে গেলেন না–ফেরার দেশে। তারিখটা ছিল এপ্রিল ২৯, ২০০২ সাল।
বিশ্ব মা দিবসে দুনিয়ার সব মায়ের প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইল।
*লেখক: রানা টাইগেরিনা, টরন্টো, কানাডা
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস: [email protected]