কথোপকথন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কী হয়েছে, ইমরোজ ভাই?

কিছু না।

কিছু একটা তো বটেই। আপনাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছে... বলেন, বলে হালকা হন। এই বিদেশে তো আপনি সোল মেট পাবেন না। মাকিয়াতো, লাতে, কাপোচিনো কফি পাবেন...সসেজ পাবেন। সোল মেট না!!!
আপনি দেখি ফিলসফারদের মতো কথা বলছেন!!

আরে সবার মধ্যেই কম–বেশি ফিলসফি আছে, ইমরোজ ভাই।
কিছু হয়নি। তবে আপনার ভাবির বলা ছোট একটা কষ্টের কথা মাথার মধ্যে বসে গেছে। বের হচ্ছে না...পৃথিবীর সব রিলেশনের মধ্যে বোধ হয় শুধু মা–বাবার কাছেই আপনি বেশি হয়ে যান না। অতি প্রিয়জনের কাছে যখন আপনি বেশি কিংবা একঘেয়ে হয়ে যাবেন, সেই কষ্ট সবাই নিতে পারে না। আমি না পারার দলের। অনেকের অভ্যাস হয়ে যায় বোধ হয়।

কী বলেছেন ভাবি?

গভীর আবেগ নিয়ে তাকে বললাম, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারি না।

উত্তর দিলো:

আমি এখনো মরিনি...

কিছুই না, আবার অনেক কিছু!! অতি প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে আমি বেশি হয়ে গেলাম? কী কথার কী উত্তর!! মনটা তিতা হয়েছে গেছে রবিন ভাই। অথচ বিয়ের আগে এই মেয়ে শীতের সকালে আমার সঙ্গে শর্ষেখেতে হাঁটতে যাবে বলে সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটাত। একে বিয়ে করার জন্য সংসারের সঙ্গে কত যুদ্ধ!! ভালোবাসা হারিয়ে যেতে পারে ভেবে আমার দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া পর্যন্ত দেখতে পারত না। চুপচাপ কান্না করত! সেই কান্নাও দেখার মতো...কোনো শব্দ নেই...ফোঁপানো আর অনবরত চোখের পানি ফেলা!! একটা বয়স থাকে বুঝলেন, ভালোবাসাটাই সব মনে হয়, কিন্তু আমি ওই বয়সটা পাড় করতে পারিনি। এটাও আফসোস। তাই তো পেয়ে বসছে।

আরে কোনো কারণে ভাবির মন ভালো ছিল না, তাই বলেছে। এ নিয়ে এতটা মন খারাপ করা ঠিক নয়।
আমিও বুঝি, বুঝের মানুষ আমি, কিন্তু কথাটা মাথা থেকে যাচ্ছে না। ঢুকে বসে আছে। হয় না এমন? তুচ্ছ কিছু কাঁটা হয়ে বুকে বিঁধে থাকে?

ইমরোজ ভাই আর ঝরা ভাবি সুখী দম্পতি। বাংলাদেশিদের যেকোনো অনুষ্ঠানে তাঁরা পায়জামা–পাঞ্জাবি আর শাড়ি পরে আসেন। তার মানে এই নয়, দুজনেই সাংস্কৃতির মানুষ। বইপড়ার অভ্যাস ঝরা ভাবির আছে, ভাইয়ের নেই। তবে তাঁরা দুজনেই শিল্পের মানুষদের খুব কদর করেন। যাঁরা গান গান, আবৃত্তি করেন কিংবা লেখক...তাঁদের ওনারা ঘরে ডেকে আপ্যায়ন করেন। দেশ থেকে আসা অনেক শিল্পীই তাঁদের বাসায় আতিথ্য নেন। শুধু একটু কমতি যেটা আমার চোখে পড়েছে, প্রায় ১০ বছরের বিবাহিত জীবনে তাঁদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। এতে করে সুখ আটকে আছে এমন মনে হয়নি। এ রকম আবেগপ্রবণ কথা ইমরোজ ভাই আগে বলেননি। বিদেশে তো উপলক্ষ ছাড়া দেখা কম হয়। তাঁদের সঙ্গে বাজার করতে গিয়ে দেখা এবং কফি শপে বসা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বললেন, আমাদের ছেলেমেয়ে নেই, অথচ এর জন্য কিন্তু দুজনের শারীরিক সমস্যা নেই। ডাক্তার দেখিয়ে কনফার্ম হয়েছি কয়েকবার। কিন্তু হচ্ছে না!!

বুঝলেন ভাই, আমার মনে হয়, আপনার ভাবির মনে ইদানীং একধরনের কষ্ট ঘোরে, অন্য কারও সঙ্গে বিয়ে হলে হয়তো এত দিনে মা হয়ে যেত। আমি তাকে সেই সুযোগটা করে দিতে চাই!!

এটা শুনে নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগছিল, কিন্তু পাল্টা কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসই হয়নি আমার। খুব মন খারাপ হলে মানুষ অনেক সময় অতি আবেগে অদ্ভুত কথা বলে ফেলে। গুরুত্ব দিতে নেই...

এরপর বেশ কিছুদিন যোগাযোগ ছিল না। মাস তিনেক পরে হঠাৎ শুনি ইমরোজ ভাই হাসপাতালে ভর্তি! কেউ সঠিক বলতে পারল না, ঝরা ভাবিও তেমন কিছু বলেননি কাউকে। শুধু শরীর খারাপ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি? দেখতে গেলাম একদিন। চমৎকার করে হাসলেন।

বুঝলেন রবিন ভাই, আপনারা বিড়ি–সিগারেট খান, মাঝেমধ্যে ড্রিংকও করেন, আপনারা দিব্যি আছেন।

আর এই আমি? ওসব কোনো দিন স্পর্শ করিনি। আমার হলো লিভার সিরোসিস!! আর মাস ছয়েক টিকব। আমি চাইনি, তাই ডাক্তার আপনার ভাবিকে কিছু বলেনি। জানেন তো এ দেশে রোগী না চাইলে ডাক্তার কাউকে কিছু বলবে না। প্রতিদিন আসে, ইচ্ছামতো খারাপ ব্যবহার করে বিদায় দিই, যেন আমার মৃত্যুর পর সে কষ্ট কম পায়। নতুন জীবন শুরু করতে সুবিধা হয়। কিন্তু ওই খারাপ ব্যবহারটা করতে গিয়ে আমার বুকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। এই অভিনয় কঠিন অভিনয় ভাই, পেরে উঠি না অনেক সময়। তখন ঘুমের ভান করে পড়ে থাকি।

আমাকে এসব বলছেন কেন?

জানি না কেন? কোথায় যেন আপনাকে অন্য ভুবনের বন্ধু মনে হয়। কাউকে বলতে ইচ্ছা করল। ভাই, আপনি কাউকে কিছু বলবেন না। মৃত্যুর পর বলতে পারেন, আমি তো আর দেখব না। এই বলে ইমরোজ ভাই কাঁদতে থাকলেন।

অনিবার্য মৃত্যুর দিন–তারিখ যখন মানুষের জানা হয়ে যায়, তখন তার ভেতরে কেমন লাগতে পারে? আমিও কাঁদছিলাম তাঁর সঙ্গে...নিতে পারছিলাম না।

বুঝলেন ভাই, ভাবি, সেদিন কষ্ট দিয়ে কথাটা বলেছিল, বড় তাচ্ছিল্য ছিল। যেন আমি ঠিক বলিনি, তাকে ছাড়া বাঁচতে পারি না। মানুষটিকে ছাড়া আমার পক্ষে আসলেই বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। প্রকৃতি বলেন, আল্লাহ বলেন, ফট করে সেই মহান আমার মনের কথা শুনেছেন। ভাবি, মা হওয়ার একটা সুযোগ পেল। সুন্দর সমাধান প্রকৃতি করল। কেউ দোষী হলো না।

অদ্ভুত কষ্টে ছুটে বের হয়ে গেলাম।

ইমরোজ ভাই মারা যান ২০২০ সালের ২ জানুয়ারি। সারা পৃথিবী করোনার থাবায় বিপর্যস্ত! দাফনের সময় অল্প কয়েকজন কবরস্থানে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিল। আমি ছিলাম। প্রচণ্ড তুষারপাত হয়েছিল সেদিন। উপস্থিত সবার চোখের পানি নিমেষে তুষারের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল, কিন্তু পরিচিত সবাই ঘরে বসে তাঁর জন্য কেঁদেছিল।

আমি ইমরোজ ভাইকে বলতে পারিনি, আমার চরম দারিদ্র্যের সময় বউ আল্লাহর কাছে হাত তুলে কেঁদে কেঁদে বলেছিল, তিনি যেন আমাকে তুলে নেন, সে বাইরে থেকে বাসায় আসার আগেই। পরে সে এসে দেখে আমি বহাল তবিয়তে টিভি দেখছি। সে কি কান্না আমার বউয়ের!! কেন আমি জীবিত? মরে গেলে সে একা একা সারভাইভ করতে পারত সহজেই। স্বামী–স্ত্রী হলে বোধ হয় কথাবার্তায় সবাই বিবেচনা বোধ হারিয়ে ফেলে!

ভাই মারা যাওয়ার পর ঝরা ভাবি আক্ষরিক অর্থেই পাগল হয়ে গেছেন। যেকোনো শোক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হয়ে যায়। জীবনকে অনেক মনের কষ্ট চাপা দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে হয়। মানুষ তা পারে।

ভাবি কোনো দিন স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারবেন, এমন মনে হচ্ছে না। এক দিন শুধু বলেছিলেন, সহমরণ সিস্টেম রেখে দিলে হতো, বাধ্যবাধকতা ছাড়া। যার ইচ্ছা সে সহমরণে গেল এ রকম!! আমি নিশ্চয়ই আপনার ভাইয়ের সঙ্গে চলে যেতাম। কথাটা তাঁর আত্মা থেকে আসা, এটা বোঝা যায়। একটা মানুষের এক মুহূর্তের আচরণের জন্য তার সম্পর্কে সারা জীবনের ডিসিশনে আসা উচিত নয়। আমি বেশ বুঝতে পারি ইমরোজ ভাই ভাবির ভালোবাসা পরিমাপ করতে পারেননি। মিছে অভিমান বুকে নিয়ে চলে গেলেন।

**দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারেন [email protected]