হ্যাপি অ্যানিভার্সারি

জীবনেও প্রেম করব না—এই প্রতিজ্ঞা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়তে গিয়েছিলাম। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। আর্কিটেকচার ও কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং—দুই ডিপার্টমেন্টেই ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেলাম।

আমার আবার ছোটবেলা থেকেই শখ ছিল শিল্পী মেয়ে বিয়ে করার। চিত্রশিল্পী। যে সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকে আমার ঘরের দেয়াল সাজিয়ে ফেলবে! (পেইন্টিংয়ের যা দাম! এর চেয়ে ঘরের মানুষই ছবি আঁকুক!) তা ছাড়া আমাদের আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টে একের পর এক সুন্দরী মেয়ে পড়াশোনা করত।

পাছে কোনো ভবিষ্যৎ আর্কিটেক্টের প্রেমে পড়ে যাই, সেই ভয়েই সিএসই ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়ে গেলাম। প্রথম সেমিস্টার ভালোভাবে পার করে দিতে পেরেছিলাম। বিপত্তি ঘটল দ্বিতীয় সেমিস্টারে। আমাদের এক সেমিস্টার সাভারে আবাসিকভাবে কাটাতে হবে, বাধ্যতামূলক।

আমি এমনিতেও পরিবার থেকে দূরে থেকে পড়ালেখা করছি। আমার কাছে ঢাকাও যা, সাভারও তা, পরবর্তী সময় আমেরিকাও তা-ই হলো। সে যাক, আমার সহপাঠী অনেক ছেলেমেয়েই একে নিল প্রেমে পড়ার সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে! সেই সঙ্গে শেষ সুযোগ হিসেবেও। যেন সেমিস্টার শেষে সাভার থেকে ঢাকা ফিরে গেলেই আর প্রেম করা হবে না এবং এই প্রেম করার ওপরই যেন তাদের জীবনমরণ নির্ভর করছে!

আমি ও আমার কয়েক বন্ধু মজা দেখতে লাগলাম। দেখছিলাম ছেলে-মেয়ে উভয়ই কি রকম হন্যে হয়ে নিজের জন্য জোড়া খুঁজে বেড়াচ্ছে! ছেলেদের আগ্রহ তো ছিলই, আমি অবাক হতাম মেয়েদেরও আগ্রহ দেখে! এ ওকে প্রপোজ করছে। প্রথম প্রস্তাবে রাজি না হলে ভাবাভাবির টাইম নেই, অন্য কারও সঙ্গে ট্রাই মারা শুরু! তিনটি মাস মাত্র সময়, একজন মেয়ের বা ছেলের পেছনে কয়টা দিন ব্যয় করা যাবে? যদি সে না আসে? এর মধ্যে যে আসার সুযোগ আছে, তাকে আসতে দেওয়া হোক! যাবতীয় খুঁত কিংবা চারিত্রিক দোষত্রুটি—সব মাফ! ওসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আগে প্রেম তো শুরু হোক!

দেখতে দেখতে দুমাস কেটে গেল। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই তাঁদের জোড়া খুঁজে পেয়েছে। যদিও এখনো সেসব জোড়া থেকে খুব কমই টিকে আছে! আমরা কয়েক বন্ধু আড্ডা মেরেই কাটিয়ে দিলাম এ দুমাস। ঝামেলা বাধল, যখন ইন্টার-ডর্ম ফুটবল সিরিজ শুরু হলো। বেস্ট অব থ্রির প্রথমটায় আমাদের ডর্ম গো-হারা হারল! আমাদের বিপক্ষ ডর্মের দলটি ছিল মহা শক্তিশালী! এই দল যেকোনো সেমিস্টারকে চ্যালেঞ্জ করে জেতার ক্ষমতা রাখত! তাদের তিনজন খেলোয়াড় ছিল, যারা লীগে খেলেছে। সেই তুলনায় আমাদের দলে তেমন ভালো খেলোয়াড় ছিল না। আমি নিজেও দলে খেলিনি। আগ্রহই ছিল না খেলার। তবে হ্যাঁ, আমাদের গোলকিপার, যে কি না দলের ক্যাপ্টেন, সে ছিল দুর্দান্ত! খুব সম্ভব আমাদের ইউনিভার্সিটিরই সেরা গোলকিপার।

প্রথম ম্যাচে হারার পরে সে এক সকালে আমাকে ধমকের স্বরে বলল, ‘তুই খেলছিস না কেন?’
আমি বললাম, ‘ভালো লাগে না।’

সে বলল, ‘আমি কিছু শুনতে চাই না! কালকে সকালে তোকে আমি মাঠে দেখতে চাই! না হলে তোর খবর আছে!’

আমি খবর এড়াতেই পরদিন মাঠে উপস্থিত এবং দেখতে দেখতে আমরা সম্পূর্ণ নতুন দল নিয়ে দ্বিতীয় ম্যাচ খেললাম এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আমরা জিতে গেলাম!
এত লম্বা ভূমিকা টানার পেছনে কারণ আছে। সেটিই এখন বলছি।
আমার এক চাচাতো বোনও আমার সঙ্গে একই সেমিস্টারে ভর্তি হয়েছিল। সে নিজে ছিল সুন্দরী। তার দলের বান্ধবীগুলোও ছিল সুন্দরী!

আমি আমার চাচাতো বোনটির সঙ্গে জীবনেও তেমন কথা বলিনি। ফুটবল ম্যাচ জেতার পর, আমরা খেলোয়াড়েরা তখন খুব ফুর্তিতে আছি! নিজেদের হিরো মনে হচ্ছে! সেলিব্রিটিদের মতন ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়াই! এই সময়ে আমার বোনটি তাঁর বান্ধবীর দল নিয়ে এসে আমাকে বলল, ‘জিতেছ, আমাদের খাওয়াবে না?’

আমি তখন মোটামুটি বড়লোক মানুষ। টিউশনি করি। সপ্তাহে দুদিন মাত্র এক ঘণ্টা করে পড়াই, মাস শেষে দুই হাজার টাকা পকেটে ঢোকাই। তখনকার দিনের হিসেবে আমি অনেক এক্সপেনসিভ গৃহশিক্ষক ছিলাম। সাভারে চলে আসায় খরচের উপায় নেই। আমার আবার হাতে টাকা থাকলে মাথার হুঁশ থাকে না। খরচ না করে ফেলা পর্যন্ত শান্তি পাই না। আমার নিস্বতাতেই আনন্দ! হঠাৎ এতগুলো টাকা জমে গেছে আমার হাতে, এখন খরচ করার একটা সুবর্ণ সুযোগ এসেছে, কি করে হ্যালায় যেতে দিই! রাজি হয়ে গেলাম। বললাম, ‘দলবল নিয়ে চলে এসো সন্ধ্যায়। মূর্ছনায়। ঠিক আছে?’

মূর্ছনা হচ্ছে একটি ওপেন এয়ার মঞ্চ, যার এক পাশ ফুলের গাছে ঢাকা। অন্য পাশ থেকে খোলা মাঠ ছুঁয়ে গ্রামীণ বাতাস এসে চুল এলোমেলো করে দেয়। রাতের লাইটটাও বেশ রোমান্টিক। ব্র্যাক ছেলেমেয়েদের প্রেমে পড়ার সব ব্যবস্থা করেই রেখেছিল। প্রেম না করে শুধু আড্ডা দিতে চাইলেও জায়গাটা বেশ।

সে তার দল নিয়ে এল। আমি শুধু আমার রুমমেট দ্বৈপায়নকে (ক্যানভাসে মজার মজার ছড়া লিখে মাঝেমধ্যে) নিয়ে এলাম। অন্য বন্ধুরা আসতে লজ্জা পেল! দ্বৈপায়ন বলছিল, ‘মেয়েদের সঙ্গে পরিচয়ের এই সুযোগ মিস করা উচিত হবে না। দেখা যাবে সেমিস্টার শেষে আমরা ক্যাম্পাসে ফেরত গেছি। ক্যাফেটেরিয়ায় আড্ডা দিচ্ছি। সবার টেবিলে একটা দুইটা করে মেয়ে থাকবে। শুধু আমাদের টেবিলেই কয়েকটা ডিপ্রেসড পোলা মুখ ঝুলায়ে বসে থাকবে, আর তাদের সামনে মাছি ভনভন করে উড়বে।’

দ্বৈপায়নের যুক্তি আমার কাছে বেশ শক্তিশালী মনে হলো। ভবিষ্যতে যেন মাছি তাড়াতে না হয়, তাই আমরা উদ্যোগী হয়ে পরিচিত হলাম সবার সঙ্গে। নতুন বন্ধুত্ব হলো। মেয়েরা একে একে তাঁদের নাম বলল। বিথি, তাসনুবা, নাজ, তিন্নি, অন্তরা, ফাতেমা। আমি আবার কারও নাম মনে রাখতে পারি না। তাই আবার ভ্যারিফাই করলাম।
‘তোমার নাম তিন্নি। তাই না?’
‘হ্যাঁ।’

মেয়েটি হাসল। এত সুন্দরভাবে হাসতে আমি তখনো কাউকে দেখিনি! এখনো দেখিনি। ব্যস! আমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হলো। ‘জীবনেও প্রেম করব না’ ভুলে চিন্তা করলাম, ‘এই মেয়ের কি প্রেমে পড়া যায়?’

আমার ইচ্ছা ছিল কোনো আর্টিস্ট মেয়েকে বিয়ে করার। যে সুন্দর সুন্দর ছবি এঁকে আমার ঘর সাজাবে! ওকে দেখার পর মনে হলো, মেয়ে ‘বেগুন’ হলেও সমস্যা নেই। ছবি আমি পয়সা জমিয়ে কিনে দেয়ালে টাঙিয়ে নেব।

দিনটি ছিল ২০০৪ সালের ৬ ডিসেম্বর। আমাদের প্রথম পরিচয়ের তারিখ। প্রতিবছর ঘুরে ফিরে ফিরে আসে ৬ ডিসেম্বর! এখনো সেই মেয়েটির সেই হাসি দেখলে অবাক হয়ে ভাবি, মানুষ কি করে এত সুন্দর করে হাসতে পারে!
আল্লাহ তাঁর মুখে এই হাসি চিরস্থায়ী করুন!