বাংলাদেশে হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভরশীলতা আর ভূরাজনীতি খাদ্যনিরাপত্তায় হুমকি হতে পারে

ফাইল ছবি

বলার অপেক্ষা রাখে না যে হাইব্রিড ধানের উচ্চ ফলন ধান চাষাবাদে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। হাইব্রিড ধান প্রচলিত উচ্চ ফলনশীল ধানের চেয়ে ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি ফলন দেয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ধানের রোগবালাই ও পোকামাকড় প্রতিরোধের ক্ষমতা এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে বৈকি।

বাংলাদেশে প্রধানত বোরো মৌসুমে হাইব্রিড ধানের চাষ করা হয়। এক হিসাব অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে বোরো মৌসুমে দ্বিগুণ জমিতে হাইব্রিড ধানের চাষ হয়েছে, যা মোট বোরো ধানের জমির প্রায় ২৫ শতাংশ। অবশ্য আমন ও আউশের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম, ৪ শতাংশের মতো। বর্তমানে সব মৌসুম মিলিয়ে ১২ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড ধানের চাষ হয়। কারও কারও মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে এর পরিমাণ ২০ শতাংশে দাঁড়াবে (Financial Express, 29 June 2022)।

আমি এখানে হাইব্রিড ধান ও প্রচলিত উচ্চ ফলনশীল ধানের বৈজ্ঞানিক আলোচনায় যাব না। যাঁরা এ ব্যাপারে আগ্রহী, তাঁরা আমার সুহৃদ, অনুজ ও উদ্ভিদ প্রজননবিদ ড. তানভীর হোসেনের ফেসবুকের (https://hossaintanvir.blogspot.com/2022/06/blog-post_28.html?m=0) লেখা পড়ে দেখতে পারেন। তিনি খুব অল্পকথায় সহজভাবে এ দুই ধরনের ধানের জাতের পার্থক্য তুলে ধরেছেন। মোদ্দাকথা হলো, এ দুই ধরনের ধানের অনেক পার্থক্যের মধ্যে অন্যতম পার্থক্য এগুলোর বীজ সংরক্ষণে। প্রচলিত উচ্চ ফলনশীল ধানের বীজ, যেটাকে বলা হয় ইনব্রেড (inbred), কৃষকেরা নিজেরাই পূর্ববর্তী ধান থেকে এর বীজ সংরক্ষণ ও পরের মৌসুমে বপন করতে পারেন।

ভূরাজনীতিতে চীন ও পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ্ব সর্বজনবিদিত। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ফলে এবং রাশিয়াকে চীনের সমর্থন দেওয়ায় এই দ্বন্দ্ব আরও বেড়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব সম্প্রতি রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে আগের চেয়ে অনেক বেশি একজোট।

অন্যদিকে হাইব্রিড ধানের বীজ প্রতিবছর বীজ কোম্পানির কাছ থেকে ক্রয় করতে হয়, আগের মৌসুমের ধান থেকে পরের মৌসুমের জন্য বীজ সংরক্ষণ করা যায় না। সংরক্ষণ করলেও সেই বীজ থেকে আশানুরূপ ফলন হবে না। এর পেছনে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে এবং সাধারণ কৃষকের পক্ষে এ বীজ উৎপাদন করা সম্ভব নয়। কারণ, হাইব্রিড ধানের বীজ উৎপাদন অপেক্ষাকৃত জটিল প্রক্রিয়া এবং এর প্রধান যে প্রযুক্তি, তা এর আবিষ্কারকেরা নিজেদের মধ্যেই সীমাবব্ধ রেখেছেন। আমাদের দেশে হাইব্রিড ধান প্রধানত চীন থেকে আমদানি করা হয়। আমাদের দেশের বীজ কোম্পানিগুলো হাইব্রিড বীজ উৎপাদন করলেও প্রযুক্তিগতভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল। আর কোনো কারণে যদি চীন হাইব্রিডের প্রযুক্তি বন্ধ করে দেয় বা না দিতে পারে, তাহলে হঠাৎ করে বাংলাদেশে হাইব্রিড ধানের উৎপাদন ব্যাহত হবে। ফলে খাদ্যশস্যের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। অর্থাৎ হাইব্রিড ধানের প্রযুক্তি নিজেদের না হলে এ ধানের বীজের নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়। আর এটা সত্যি যে বীজের নিরাপত্তা না থাকলে খাদ্যের নিরাপত্তাও নিশ্চিত নয়।

মাঠ থেকে বোরো ধান কেটে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন কৃষকেরা।  রিধইল গ্রাম, নন্দীগ্রাম, বগুড়া, ১৩ জুন
ছবি: সোয়েল রানা

আর এখানেই আসছে ভূরাজনীতির ব্যাপার। ভূরাজনীতিতে চীন ও পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ্ব সর্বজনবিদিত। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ফলে এবং রাশিয়াকে চীনের সমর্থন দেওয়ায় এই দ্বন্দ্ব আরও বেড়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব সম্প্রতি রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে আগের চেয়ে অনেক বেশি একজোট। সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশনে (ন্যাটো) যোগদানের সিদ্ধান্ত এবং কয়েক দিন আগে হয়ে যাওয়া ন্যাটো সম্মেলনে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াকে আমন্ত্রণই এর প্রমাণ। অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, চীন যেকোনো সময় তাইওয়ানে সামরিক অভিযান চালাতে পারে।

আর তা যদি সত্যি হয়, তাহলে ভূরাজনীতির মেরুকরণ আরও প্রবল হবে এবং সারা বিশ্বে ব্যবসা–বাণিজ্যে নানারকম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হবে। উল্লেখ্য, চীন তাইওয়ানকে সব সময় নিজের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ফলে পশ্চিমা বিশ্ব যেমন রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। চীন তাইওয়ান আক্রমণ করলে পশ্চিমা বিশ্ব তেমনি চীনের বিরুদ্ধে আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে এবং তা যথাযথ পালনে সব দেশের ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করবে। শুধু তা–ই নয়, সে অবস্থায় পশ্চিমা বিশ্ব তাইওয়ানকে সামরিকসহ সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করবে। ব্রিটিশ বিদেশমন্ত্রী লিজ ট্রাসের ন্যাটোর সম্মেলনে তাইওয়ানকে অস্ত্রশস্ত্র দেওয়ার মন্তব্য এরই আভাস দেয় (The Guardian, 30 June 2022)। সে রকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য চীনের কাছ থেকে হাইব্রিড বীজের প্রযুক্তি পাওয়া দুরূহ হতে পারে, এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হবে ও দেশে খাদ্যাভাব দেখা দিতে পারে এবং দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যেতে পারে। যেমনটি সম্প্রতি দেখা গেছে শ্রীলঙ্কায়। এ সমীকরণে ভারতের কথাও বিবেচনায় আনতে হবে। আমরা সবাই জানি, ভারতের চিরশত্রু চীন। চীনের বিরুদ্ধে যেকোনো নিষেধাজ্ঞা যাতে যথাযথ পালন হয়, সেজন্য ভারত তার আশপাশের দেশগুলোতে প্রভাব খাটাতে চাইবে। যদিও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ভালো সম্পর্ক, কিন্তু চীনের বিরুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে চাপ দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না। অর্থাৎ ওই রকম অবস্থায় আমাদের যদি বিকল্প না থাকে, তাহলে অতিমাত্রায় চীন থেকে আমদানি করা হাইব্রিড ধানের ওপর নির্ভরশীলতা বাংলাদেশের জন্য খাদ্যনিরাপত্তার হুমকি হবে, এটা একরকম নিশ্চিত।

উপরিউক্ত পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে এখন থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। তা নেওয়া যেতে পারে প্রধানত দুভাবে।

প্রথমত, হাইব্রিড ধান উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া যেতে পারে এবং তা যেন সব মৌসুম মিলিয়ে কোনোভাবেই ৩০ শতাংশের বেশি না হয়। এতে করে হাইব্রিড প্রযুক্তির অনিশ্চয়তার সময় অল্পতে তা থেকে উদ্ধার পাওয়া যেতে পারে। সম্ভব হলে চীন ছাড়াও অন্য কোনো সূত্র থেকে হাইব্রিড প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে কত পরিমাণ আমদানি করবে, তার একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে।

দ্বিতীয়ত, নিজেদের হাইব্রিড প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হতে হবে। আমার জানামতে, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এ ব্যাপারে কিছু গবেষণা করেছে এবং তাদের হাইব্রিড ধানের কয়েকটি জাত আছে, যদিও সেই ধানের ফলন আমদানিকৃত হাইব্রিড ধানের ফলনের চেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম। এখন যেটা করা যেতে পারে, তা হলো এ গবেষণায় আরও জোর দেওয়া। প্রয়োজন হলে সম্ভাবনাময় উদ্ভিদ প্রজননবিদদের উন্নত মানের প্রশিক্ষণ দিয়ে এ গবেষণায় নিয়োজিত করতে হবে।

অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে যেসব বাংলাদেশি অভিজ্ঞ উদ্ভিদ প্রজননবিদ আছেন, যাঁরা হয়তো ইতিমধ্যে অবসর নিয়েছেন, তাঁদের এ প্রকল্পে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। তাঁরা হয়তো বিদেশ থেকে এ নতুন বিজ্ঞানীদের পরামর্শ ও গবেষণার দিকনির্দেশনা দিতে পারবেন। বছরে একবার হলেও এসব অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী যাতে দেশে যেয়ে এ গবেষণার পর্যালোচনায় অংশ নিতে পারেন, তার ব্যবস্থা করতে হবে। আর একটা ব্যাপারে নজর দিতে হবে, তা হলো ব্রির উদ্ভাবিত হাইব্রিড ধানের বাজারজাতকরণ। বাংলাদেশে এখন অনেক বীজ কোম্পানি আছে, যারা হাইব্রিড ধানের বীজ বিক্রি করে। তাদের ব্রির উদ্ভাবিত হাইব্রিড ধানের বাজারজাতকরণে সম্পৃক্ত করতে হবে। তবে এ ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও নীতিমালা থাকতে হবে।

*লেখক: ড. মোয়াজ্জেম খান, অস্ট্রেলিয়া সরকারের একজন কৃষিবিজ্ঞানী