মুদ্রাস্ফীতি: করণীয় ও বর্জনীয়
কোভিড-১৯ গোটা বিশ্বকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। গত দুই বছরের বেশি সময় ভয়, আতঙ্ক এবং নানা রকম কষ্টের মধ্য দিয়ে মানবজাতি সময় পার করে চলতে পথে নতুন দুর্ভোগের মুখোমুখি। রাশিয়া আক্রমণ করেছে ইউক্রেনকে, যা গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।
সুইডেন একমাত্র দেশ, যারা করোনা মহামারিতে লকডাউন দেয়নি। ফলে মাশুল দিতে হয়েছে ছয়-সাত গুণ মানুষের জীবন, প্রতিবেশী দেশগুলো ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক বা নরওয়ের তুলনায়। এখনো কোভিড-১৯ গোটা বিশ্বে বিরাজমান ঠিক এ রকম একটি দুঃসময়ে বেধেছে যুদ্ধ, যার প্রতিক্রিয়া পৃথিবীর সর্বত্র কোনো না কোনোভাবে শুরু হয়েছে। তবে সুইডেনে এর প্রভাব এত বেশি পড়েছে, যা বর্ণনা করা সম্ভব নয়, তবু বিষয়টির ওপর আলোকপাত করব এবং তুলে ধরব এর ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া।
এ বছরের শুরুতেই জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলেছে। জ্বালানি তেল, গ্যাসের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, যোগাযোগের মাধ্যম তথা প্লেন, ট্রেন, বাসসহ বোটের টিকিটের দাম বেড়েছে। বাড়েনি কারও আয়, তাহলে কী দাঁড়াল? সহজ করে বলি, যাতে বুঝতে সহজ হয়। পেঁয়াজের কেজি সাধারণত ১০ টাকা, হঠাৎ হয়ে গেল ৫০ টাকা। কী দাঁড়াল? দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি লাভ করল এবং অর্থের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকল। টাকার মূল্য হ্রাস পেতে থাকাকে বলা হয়ে থাকে মুদ্রাস্ফীতি বা ইনফ্লেশন।
মুদ্রাস্ফীতি বা ইনফ্লেশন নানাভাবে হতে পারে এবং এ বিষয়ে নানাজনের নানা রকম ব্যাখ্যা রয়েছে। যেমন কারও মতে উৎপাদনপ্রচেষ্টা অপেক্ষা মানুষের আয় যদি বেশি হয়, তবে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। কারও মতে, ক্রয়ক্ষমতার অস্বাভাবিক পরিমাণ বৃদ্ধিই হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি। কারও মতে, মুদ্রাস্ফীতি হলো এরূপ একটি পরিস্থিতি, যেখানে অত্যধিক পরিমাণ অর্থ অতি সামান্য পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রীর পশ্চাতে ধাবিত হয়। কারও মতে, মুদ্রাস্ফীতি এমন একটি অবস্থা, যখন অর্থের মূল্য ক্রমেই হ্রাস পায় অর্থাৎ দ্রব্যমূল্য ক্রমে বৃদ্ধি পায়। আরও নানা ধরনের ব্যাখ্যা রয়েছে মুদ্রাস্ফীতি বা ইনফ্লেশন নিয়ে, তবে সব সংজ্ঞার বিশ্লেষণ করলে মুদ্রাস্ফীতির ওপর নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়।
সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, যখন একটি দেশে বা বিশ্বে পরিচালিত অর্থের পরিমাণ উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর তুলনায় অধিক হয় এবং এর ফলে দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি প্রাপ্ত হলো তখন তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা হয়। এটা মূলত নতুন কিছু নয়, তবে ভাবতে হবে কেন এমনটি হয় এবং কী কারণ এর পেছনে?
আমেরিকার বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি এত বেশি, যা গত ৪০ বছরে দেখা যায়নি, কী করছে দেশটি এ সময়? ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিতে গেলে বা যাদের ধার রয়েছে, তার ওপর সুদের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা করছে ইউরোপে এমনকি সুইডেনে। আমি সদ্য একটি ফ্ল্যাট কিনেছি হঠাৎ সুদের পরিমাণ দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেছে, ফলে আমার বসবাসের খরচ অতীতের তুলনায় দুই গুণ বেশি হয়েছে। এদিকে আমার বেতন বাড়েনি। অন্যদিকে জিনিসপত্রের দাম আগুনের মতো গরম। ভাবুন তাহলে আমিসহ জনগণের বর্তমান অবস্থা? হ্যাঁ, অবস্থা খুবই করুণ!
ইউরোপের মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতি এবং তা মোকাবিলায় দেশগুলো বিভিন্ন রকম পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন বিশ্বের অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো ইউরোপের ব্যাংকগুলোরও মূল লক্ষ্য হলো মুদ্রাস্ফীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় অর্থনীতিতে বিদ্যমান মুদ্রাস্ফীতির প্রত্যাশার মানদণ্ড হিসেবে কাজ করা এবং মুদ্রাস্ফীতি প্রতি বছর ২ শতাংশের কাছাকাছি রাখা। সুইডেনের বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি ৮ শতাংশের বেশি। সে ক্ষেত্রে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ বাড়িয়েছে এবং বলছে বছরের শেষে আরও ১ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়াবে যদি তার আগে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসে।
রাজনীতিবিদসহ সারা বিশ্ব বিশ্লেষণ দিচ্ছে কোভিড-১৯ এবং ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ এর জন্য দায়ী। কোভিডে না হয় মানুষের তেমন করণীয় ছিল না, কাজকর্ম ছাড়া ঘরে বসে সঞ্চিত অর্থ দিয়ে সীমিত দ্রব্যমূল্য কিনতে বেশি অর্থের প্রয়োজন পড়েছে তখন। এখন সবকিছু দ্রুতগতিতে উৎপাদিত হওয়ার কথা এবং তার জন্য দরকার যেমন জ্বালানি তেল ইত্যাদি, ঠিক তেমনি একটি সংকটময় সময় যুদ্ধ?
সারা বিশ্বে যেমন কোভিড-১৯ এবং ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, তেমনি বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে। যেমন তেলের দাম বেড়েছে, নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, যাতায়াত খরচ বেড়েছে। কিন্তু এখানেও একই অবস্থা। কারোরই দৈনিক আয় কিন্তু বাড়েনি, আর সেটা বাড়ানোও খুব কঠিন। তবে অন্যান্য দেশে বা বলতে পারেন ইউরোপ–আমেরিকায় যেমন মুদ্রাস্ফীতির মারাত্মক প্রভাব দেখা দিয়েছে, তেমন প্রভাব কিন্তু বাংলাদেশে এখনো দেখা দেয়নি। দ্রব্যমূল্য বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু ইউরোপ–আমেরিকার মতো কড়াকড়ি প্রভাব এখনো আমাদের দেশে পড়েনি।
ইউরোপ–আমেরিকার মতো যেমন এত কড়াকড়ি প্রভাব এখনো আমাদের দেশে পড়েনি, তাই এটাই একটা সুযোগ আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার। বাংলাদেশ ব্যাংকও এসব বিষয়ের ওপর নজর রাখছে। তারাও যত দূর সম্ভব নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। কয়েক ধাপে সুদহার বাড়িয়েছে এবং ২০২২ সালের শেষ নাগাদ সুদহার আরও বাড়াবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
আর বলা হয়ে থাকে, সুদহার বাড়ানোই হচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অব্যর্থ ওষুধ। তবে আমি মনে করি এই ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, সেগুলো খুঁজে বের করা এবং দ্রুত সেগুলো আরোপ করার এখনই সময়।
মানবজাতির ওপর দিয়ে একের পর এক মানবসৃষ্ট কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ যাচ্ছেই। থামাথামির যেন কোনো কথাই নেই। যেমন মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং এর নেতিবাচক প্রভাব, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ইত্যাদি। আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ যেন আংশিকভাবে হলেও বৈশ্বিক যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। এটা আরও ছড়িয়ে পড়লে না জানি কী হবে। আর এই সব প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর।
আধুনিক ঔপনিবেশিক শক্তি, পুঁজিবাদী শক্তি, দুর্নীতিবাজ, অত্যাচারী শাসক, একনায়কতন্ত্র বা এই ধরনের যত অপকর্মকারী রয়েছে এবং এরা যত রকমের অপকর্ম করে, এর সব প্রভাব শেষে গিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর এবং অনেক সময় এদের লালসার কারণেই চলে যায় হাজার হাজার মানুষের জীবন। বলা হয়ে থাকে, জনগণই সব ক্ষমতার উৎস, তাই জনগণকেই এসব অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে জেগে উঠতে হবে। এদের পতন ঘটাতে পারলেই আসবে স্বস্তি।
বর্তমান বিশ্বে যে সমস্যাগুলো মানুষের সৃষ্ট, তার সমাধান সমস্যার মধ্য দিয়ে শেষ হলেও এর ধারাবাহিকতা নতুন সমস্যার বীজ বপন করে চলেছে। যুদ্ধের অবসান এক প্রান্তে হলেও শুরু হচ্ছে অন্য প্রান্তে।
পৃথিবীর সবাই জানে আমাদের জীবনের সংকটময় সময়টি, তারপরও জেনেশুনে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ এবং এর জন্য শুধু রাশিয়াকে দায়ী করলেই কি সমস্যার সমাধান হবে?
বরং সময় এসেছে ভাবার, কারা মূলত এই সর্বনাশের জন্য দায়ী। মনে হচ্ছে গোটা বিশ্বের সর্বনাশের জন্য পুঁজিবাদীরাই মূলত দায়ী।
আমরা সাধারণ মানুষ অনেকটা তিমির ফাঁদে পড়েছি। তিমি খাদ্য সংগ্রহের সময় তার মুখ খুলে দেয়, অন্যান্য মাছ সেখানে এসে খেলা করে, সময়মতো তিমি মুখ বন্ধ করে দেয়। পুঁজিবাদীদের আমরা তিমির সঙ্গে তুলনা করতে পারি। পুঁজিবাদীরা ভালো মানুষের মুখোশ পরে আমাদের বিভিন্নভাবে ফাঁদে ফেলে। এভাবেই চলছে যুগের পর যুগ ধরে।
বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো তাদের অতীতের অস্ত্রপাতি বর্তমান যুদ্ধে ব্যবহার করছে নতুন অস্ত্রপাতি তৈরি করার জন্য। একটি দেশকে ধ্বংস করা হচ্ছে আবার নতুন করে গড়বে বলে। পুঁজিবাদীরা এভাবেই বিনিয়োগ করে থাকে। একদিকে মানুষের জীবন বাঁচাতে বিনিয়োগ চলছে, অন্যদিকে মানুষকে ধ্বংস করার জন্যও পুঁজিবাদীর পুঁজিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। চমৎকার বিশ্বে আমাদের বসবাস!