জাতীয় ফল কাঁঠালই বলে দিবে আমরা কেমন জাতি!
সুন্দর জীবন গড়তে কে না চায়! সুন্দর জীবনের জন্যই তো এ পারাপারে প্রাণে বেঁচে থাকা! খুঁজে ফেরা সহস্র ক্রোশ পথ। জীবন আর মৃত্যুর পার্থক্য যেমন সর্বজনীন সত্য, তেমনি সুন্দর আর অসুন্দরের পার্থক্য বুঝতে হবে, অনুভব করতে হবে। আমাদের জন্ম ও বেড়ে চলা জীবনের শুরু হয় নানা শাসন-শোষণ আর ভাষণের এক সামাজিক, পারিবারিক এবং নানা জটিলতার মধ্য দিয়ে। সেই জটিল জটে সৃষ্ট এক অভিন্ন মিশ্র অনুভূতি আমাদের মধ্যে গেড়ে বসেছে। তাই একই মানুষ কখনো ভালো, কখনো মন্দ, কখনোবা মিশ্র অনুভূতির মধ্যে নিজেকে হারায়। কর্ম–ধর্ম-আবেগ-অনুভূতির এক মিশ্র হৃদয়ে জীবনভেলায় ভাসতে ভাসতে খুঁজে চলে সুন্দর জীবনের লক্ষ্য নিয়ে।
তবে অনুভূতিটি হতে পারে ভালো বা মন্দ। কারণ, তা নির্ভর করছে আমাদের চারপাশের সৃষ্ট সামাজিক প্রভাব, ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়; তথা পারিবারিক নানা প্রভাব প্রভাবিত করছে মানবিক আচরণের ওপর। আচরণ নির্ভর করে কাজের ওপর। কাজ কী? কেন কাজ করি? ভালো কাজ ও মন্দ কাজের মানে কী। সবকিছুই কাজ, যা–ই করি না কেন! এখন কীভাবে মানবজাতি শুধু ভালো কাজ করবে! ভালো কাজ কি সত্যি করা সম্ভব? তা–ও সব সময়? পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ; যা–ই করি না কেন, সবই হচ্ছে এ কাজের প্রতিফলন।
এখন যদি আমরা কিছু না করি, হবে কি কোনো ফলন? হবে না। কর্ম ও প্রতিক্রিয়া মানে, কিছু করলে কিছু ঘটে, তা আর যাচাই-বাছাই করার দরকার নেই। কিছু করলে কিছু ঘটে। এখন জানতে হবে, এই ‘কিছুটা কী’? কিছুটা হচ্ছে কর্মের ফল। এখন এই কর্মের ফল—এটি খারাপ না ভালো? ভালোমন্দের যাচাই-বাছাই করার মতো দক্ষতা না থাকলে তো বিপদ!
বিপদে শুধু প্রার্থনা করলে কি বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়? যাবে না। মানবজাতি বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করেছে নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে। কর্ম ও প্রতিক্রিয়ার ফলে পরিণতি যা–ই হোক না কেন, কিছু করতে যেন ভয় না করি! বিপদ-দুঃখ–তাপে বা ব্যথিত চিত্তে সান্ত্বনা দেওয়ার সঙ্গে দুঃখকে জয় করার মতো শক্তি অর্জন করতে হবে। কিছু না করলে কিছু ঘটছে না। এ বিষয় নিশ্চিত। আবার কিছু করার সঙ্গে সঙ্গে কিছু ঘটছে। এখন এই ‘ঘটা’ নিয়ে কিছু কথা, যা না বললেই নয়।
আমি প্রায় কয়েক বছর ধরে লিখছি এবং বলছি—কুশিক্ষা নয়, সুশিক্ষাই হোক মানবজাতির আলোর পথ।
কিন্তু শুধু সুশিক্ষাকে প্রতিফলিত করা সম্ভব হবে কি? যেখানে সবকিছুর আবির্ভাব হয়েছে জোড়ায় জোড়ায়। বিশ্বে যা কিছু মহান ও কল্যাণকর, তার সবকিছুই জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি হয়েছে। সঙ্গে আমাদের কর্মের ফলন হচ্ছে আমাদের আচরণ, যা ভালো বা মন্দ দুটিই হতে পারে এবং তারও ফলন হচ্ছে জোড়ায় জোড়ায়!
আমাদের মুখ একটি, চোখ দুটি, হাত-পা দুটি, মাথা একটি এবং সেখানে যা খুশি তা–ই জমা করছি। শেষ নেই ভান্ডারের। ভান্ডারে যা জমা আছে, অর্থাৎ মাথার ভেতর যা আছে, তা যদি কারণে-অকারণে গড়গড় করে বেরোতে থাকে মুখ দিয়ে, তখন ঝামেলা সৃষ্টি হয় বা হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে আমাদের জানতে হবে আর জানতে হলে শিখতেই হবে। আমাদের জানা–অজানার রয়েছে অনেক বাকি। যে জাতির পরিবারের ভেতরে কলহ, হিংসা, ঈর্ষা কাজ করছে এখনো, সেখানে কীভাবে গোটা দেশের মানুষের পরিবর্তন আনা সম্ভব? সময় এসেছে ভাবার! হবে কি পরিবর্তন যদি ঘরের শত্রু হয় বিভীষণ? আমরা নিজেরাই নিজেদের পরিবারের শত্রু। মা–বাবা, ভাইবোনের মধ্যে যখন বিশ্বাস, ভালোবাসা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও আস্থা হারাতে চলেছি, সেখানে কীভাবে সম্ভব হবে একটি জাতির পরিবর্তন আনা!
আমাদের নিজেদের পৃথক পৃথকভাবে প্রশ্ন করে জানতে হবে এবং শিখতে হবে আমাদের কর্মের ফলন সম্পর্কে, সঙ্গে মাথার চিন্তা আর মুখের বুলি—এ দুটিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য ব্যবহার করতে হবে আমাদের নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্বকে। তার জন্য লার্নিং বাই ডুইং কনসেপ্টকে কাজে লাগানো শিখতে হবে এবং তার জন্য দরকার নিজের পরিবারের ওপর বেস্ট প্র্যাকটিস করা। কিসের ওপর বেস্ট প্র্যাকটিস? নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্বের ওপর। স্রষ্টার ও তার সৃষ্টির ওপর কৃতজ্ঞতা, দায়িত্ব ও কর্তব্য—এর ওপর খুব গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের। আমাদের ধ্যান-জ্ঞান এবং হৃদয়ে নৈতিকতার প্রভাব বিস্তার করার মতো কাজ করতে হবে। আমরা যে কিছু করছি না, তা বললে ভুল হবে, আমরা দরগায় প্রদীপ জ্বেলে পূজা করছি, ফুল দিচ্ছি, আমরা সত্যের সঙ্গে মিথ্যার মিশ্রণে ফকির সেজেছি, আমরা নামাজ, রোজা, হজ করছি ও জাকাত দিচ্ছি। আমাদের অন্তর যদি সুন্দর না করতে পারি, হবে কি আমাদের সাধনা সফল! সুন্দর ও সুশিক্ষার মধ্যে এক বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিশ্বাস ও মর্যাদাপূর্ণ নেতৃত্ব।
এখন আমরা বলছি, পুঁথিগত বিদ্যার সঙ্গে আমাদের দৈনন্দিন কাজ ও আচরণের প্রতিফলন হোক সুন্দর ও সুশিক্ষার চাবিকাঠি, কিন্তু হচ্ছে কি সেটা?
আসুন তাহলে একটি অপ্রিয় সত্য ঘটনা শেয়ার করি।
কাঁঠাল মূলত একটি অত্যন্ত উপকারী ও রসাল ফল। এই ফলের পুষ্টিগুণও অনেক। তারপরও কাঁঠাল কিছু কিছু মানুষের জন্য ক্ষতিকর। এই ফলে নানা ধরনের খনিজ, ভিটামিন ও অ্যান্টি–অক্সিডেন্টের ভান্ডার রয়েছে। তাই নিয়মিত কাঁঠাল খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে বেশ ভালো। তবে জানলে অবাক হবেন, কাঁঠাল অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে দেহে একাধিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া যাঁদের অ্যালার্জি রয়েছে, তাছরা কাঁঠাল খেলে উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি। শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতার অদ্ভুত ব্যবহারের কারণে অনেকেই অ্যালার্জিতে ভোগেন। আসলে অ্যালার্জিতে আক্রান্ত ব্যক্তির ইমিউনিটি নিরীহ কিছু উপাদানের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করে, ফলে শরীরে একাধিক লক্ষণ দেখা দেয়। আর এমন অ্যালার্জি কিন্তু কাঁঠাল খেয়েও হতে পারে। আসলে কাঁঠালে রয়েছে পোলেন ও ল্যাটেক্স আর এই দুই উপাদানের কারণে অনেকের শরীরে অ্যালার্জি দেখা দেয়। এ ছাড়া যাঁদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাঁদের জন্যও কাঁঠাল ক্ষতিকর। সে ক্ষেত্রে বেশি পরিমাণে কাঁঠাল খেলেই অসুস্থ হবেন। কেননা, এই ফলের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অনেকটাই বেশি। ফলে ব্লাড সুগার বৃদ্ধি পায় দ্রুতগতিতে। আবার সার্জারির পর কাঁঠাল খেলেই সমস্যা। কারণ, সার্জারির পরপর রোগীকে কিছু ওষুধ দেওয়া হয়। আর সেই ওষুধের সঙ্গে বিক্রিয়া করতে পারে কাঁঠাল। এ ছাড়া সার্জারির আগেও কাঁঠাল খেলে সমস্যা বাড়ার আশঙ্কা থাকে। যেকোনো সুস্থ ব্যক্তি, অর্থাৎ যাদের ডায়াবেটিস, প্রেশার, কোলেস্টেরল বা অন্যান্য ক্রনিক রোগ নেই, তাঁরা প্রতিদিনই কাঁঠাল খেতে পারেন। চীন, জাপান, মালয়েশিয়াসহ পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশই কাঁঠালকে প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে ব্যবহার করায় উৎপাদন চলমান রাখতে বিভিন্ন দেশ থেকে কাঁঠাল আমদানি করে। গোটা বিশ্বে বছরে প্রায় ৩০ লাখ টনের বেশি কাঁঠাল উৎপাদিত হয়, যার অধিকাংশই উৎপাদিত হয় ভারত ও বাংলাদেশে। এ ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট মানের ও সুনির্দিষ্ট জাত উদ্ভাবন এবং সঠিক পরিপক্বতা নির্বাচনের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে, যা দেশের কৃষক ও উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করার কথা। দেশে উৎপাদিত কাঁঠালের খুব অল্প পরিমাণে বিদেশে রপ্তানি হয় এবং এর ক্রেতা অধিকাংশই প্রবাসী বাংলাদেশি। বলা হচ্ছে, দেশের কাঁঠালের মধ্যে বড় ও ভালো মানের কাঁঠাল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে কাতার, ওমান, বাহরাইন, সৌদি আরব, দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
আমি দেশ ছেড়েছি ৪০ বছর আগে। এখনো সেই ছোটবেলার কাঁঠালের স্বাদ জিহ্বায় লেগে আছে। কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। স্বাভাবিকভাবেই কাঁঠাল খেতে মন চায়, কিন্তু কেন দেশ থেকে ভালো কাঁঠাল বিদেশে পাঠানো হয় না, কারণ কী? জাতি কতটা ভালো বা মন্দ, সেটা কিন্তু একটি কাঁঠাল বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে পারে। জাতির দুর্নীতির মাত্রা কত বেশি, জানতে হলে একটি জাতীয় ফল কাঁঠাল কিনতে হবে, ব্যস হয়ে গেল জানা। আমি সেই ৪০ বছর ধরে চেষ্টা করে চলছি—কবে একটি ভালো কাঁঠাল কিনতে পারব! সুইডেনে বাংলাদেশের মাছ, শাকসবজি ও ফল পাওয়া যায়, বিশেষ করে গ্রীষ্মে। আম, লিচু ও কাঁঠাল গ্রীষ্মে আসে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সেগুলো খাওয়ার উপযোগী নয়। আমি লন্ডনেও গিয়েছি, কিন্তু ভালো আম, কাঁঠাল বা মাছ কিনতে পারিনি এ পর্যন্ত। জাতির চরিত্র এত খারাপ হতে পারে, এটা জানতে দেশে যাওয়ার দরকার নেই। কাঁঠালসহ সবকিছু নিয়ে লিখতে গেলে লেখা শেষ করতে পারব না, বরং কাঁঠাল নিয়ে থাকি। সুইডেনে কাঁঠাল কেজি দরে বিক্রি হয়। এর আগে পাঁচ কেজি ওজনের একটি কাঁঠাল কিনেছি, স্টকহোমের অদূরে একটি বাঙালি দোকান থেকে। এ বছর কাঁঠালের কেজি ৬৫ সুইডিশ ক্রোনার (১ ক্রোনার = ১০ টাকা)। কাঁঠাল বাড়িতে এনে ভেঙেছি, কিন্তু কাঁঠাল মেলেনি, এমনকি বিচিগুলোও বড় হতে পারেনি। জানি না কেমিক্যাল ঢুকিয়ে এত কচি কাঁঠাল নরম করেছে কি না। কাঁঠালটি শেষে ফেলে দিতে হয়েছে। আমের অবস্থাও ঠিক একই। সুইডেনে যারা এ ব্যবসা করে, তারা বলে ঠিক এভাবে, আমরা ভেতরের দায়িত্ব নিতে পারব না। দেশ থেকে যা পাঠিয়েছে, আমরা সেটাই বিক্রি করছি, এখন আপনার ভাগ্য ভালো হলে ভালো, না হলে আমাদের কিছু করার নেই। সুইডিশ কর্তৃপক্ষ কিছু করবে না, কারণ তারা তো জানেই না কাঁঠাল খেতে কেমন।
দেশের মানুষ মনে করে, তারা ব্যবসা করে হালাল রোজগার করছে। আসলে কি তা–ই? দেশের একটি জাতীয় ফল, তার প্রতি এত অত্যাচার এবং অবিচার? আজ প্রথম মাথায় চিন্তা এসেছে, কেন এত দিনেও একটি ফল এক্স-রে মেশিন তৈরি করিনি? তাহলে দুষ্ট লোকদের থেকে রেহাই পেতাম। মনে হচ্ছে, এ অন্যায়ের প্রতিবাদ করা উচিত। তাই অতি অপ্রিয় সত্য কথাগুলো লিখতে বাধ্য হলাম। আমার মনে হচ্ছে, ব্যবসা করে যারা, দুর্নীতি বেশি করে তারা। দেশের সবকিছু পেতে চাই, খেতে চাই, চড়া দামে কিনতে চাই। কিন্তু খাবার ভালো হোক, সেটাই কিন্তু আশা করি। সেটা সম্ভব হচ্ছে না, কারণ কী? কীভাবে সম্ভব—এ ধরনের খাবার দেশ থেকে আসতে পারে? কোটি কোটি টাকা পাচার হয়, কেউ জানে না। পচা ও জঘন্য খাবার বিদেশে পাঠানো হয়, প্রশাসন জানে না। তাহলে তারা কী জানে? আর কী করে? সরকার কি তাদের বেতন দেয় না? কী পরিমাণ দুর্নীতি এর পেছনে জড়িত? দেশে কখনো আলোচনা হচ্ছে না যে দুর্নীতি ও ভেজালমুক্ত না হলে উত্তম কৃষিচর্যা, উন্নত প্যাকেজিং প্রযুক্তি, সঠিক পরিপক্বতা নির্ধারণ, সুনির্দিষ্ট জাত নির্বাচন, প্যাকিং হাউস সুবিধাসহ যথাযথ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রযুক্তি প্রয়োগ করার মাধ্যমে জাতীয় ফল কাঁঠালকে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে না এবং কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি যেমন নিশ্চিত করবে না, করবে না তেমনি অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ কাঁঠালের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা। কাঁঠাল এক অমৃত স্বাদের রসে ভরা স্বর্গীয় নিয়ামত, কিন্তু সেই নিয়ামত অতি আনন্দ এবং তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়ার সুযোগ হাজার টাকা দিলেও পাওয়া যাবে না, যদি সেটা দুর্নীতিযুক্ত হয়।
কাঁঠালও কি তাহলে দুর্নীতির কবলে পড়েছে? কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল, তাকে আমরা দুর্নীতিমুক্ত রাখতে চেষ্টা করি।