বাবা হয়ে ওঠা একটি নিরন্তর যাত্রা
১৬ জুন বাবা দিবস। পাঠকের পাঠানো লেখা থেকে বাছাইকৃত লেখা প্রকাশিত হচ্ছে দূর পরবাসে।
গ্রামের মানুষ বাবাকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আব্বা বলে সম্বোধন করে। অবশ্য সেখানেও একটা ধর্মীয় ব্যাপার আছে। আব্বা ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান। দাদা অকালপ্রয়াত হওয়ার পর ভাই বোনদের দায়িত্ব এসে পড়ে আমার তৃতীয় শ্রেণি পাস আব্বার ঘাড়ে। এরপর তাই আর পড়াশোনাটা চালিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। আব্বা পুরোপুরি কৃষি কাজে মনোনিবেশ করলেন। কিন্তু তিনি আমার দেখা একজন আধুনিক মানুষ। আজও পাড়াগাঁয়ের মানুষ হয়েও বিয়ের পর মাত্র দুটি সন্তান নিয়েছিলেন। আমাদের দুই ভাইয়ের অনেক পর অবশ্য আমাদের তৃতীয় ভাইটা জন্ম নেয়।
আব্বা সব সময়ই আমাদের লেখাপড়া করানোর পক্ষে ছিলেন এবং সেটা কোনো ধর্মীয় শিক্ষা না। আমরা দুই ভাই যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছিলাম, তখন নদীভাঙনে কবলিত হয়ে আমাদের শহরতলিতে স্থানান্তরিত হতে হলো। আব্বা অনেক ধরনের ব্যবসার চেষ্টা করে শুধু ক্ষতির মুখই দেখতে লাগলেন এবং একসময় পুঁজি হারিয়ে ফেললেন। এরপর বাধ্য হয়েই আব্বা রাজমিস্ত্রির জোগালি দিতে শুরু করলেন। তখন আমাদের দুই ভাইকে কোনো একটা কাজে লাগিয়ে দিলেই কিন্তু উনি সচ্ছলভাবে চলতে পারতেন। কিন্তু উনি সেটা করেননি। যার ফলাফল একজন রাজমিস্ত্রির সন্তান হয়েও আমাদের তিন ভাইয়ের দুই ভাই বুয়েট থেকে এবং একজন বিআইটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে আজ প্রতিষ্ঠিত।
জীবনের প্রবহমানতায় এরপর নিজেই একসময় বাবা হলাম। প্রথম বাবা হওয়ার অনুভূতি অতুলনীয়। সেটার সঙ্গে অন্য কিছুর মিল নেই। ধানমন্ডির সেন্ট্রাল হাসপাতালের করিডোরে যখন প্রথম মেয়ের মুখ দেখলাম, তখনকার মুহূর্তটা এখনো আমার চোখে ভাসে। নার্স এসে বলল, মেয়েবাবু হয়েছে। বলেই তোয়ালের মুখটা খুলে মুখটা দেখালেন। মেয়েটা তখন চোখ বন্ধ করে ঘুমাচ্ছিল। আর বাঁ হাতটা মুখের পাশে মুঠি করে রাখা ছিল। কয়ক মুহূর্তেই মধ্যেই নার্স তাকে আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেল। এভাবেই তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হলো। আব্বা বলেছিলেন আমি জন্ম নেওয়ার পর আমার জন্মের তারিখটি বালিশের কাঁথায় লিখে দিয়েছিলেন। আর মা সূচিকর্মের মাধ্যমে সেটাকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। এরপর বারবার নদীভাঙনের কবলে পড়ে সেই কাঁথা হারিয়ে যায়। কিন্তু আব্বা মনে রেখেছিলেন সন এবং তারিখ, যদিও সেটা ছিল বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী। পরের দুই ভাইয়ের ক্ষেত্রে আর সেটা সম্ভব হয়নি। আসলেই প্রথম সন্তানের বাবা হবার অনুভূতি একদমই আলাদা।
দ্বিতীয়বার বাবা হলাম প্রবাসের মাটিতে অবশ্য সেটাও আমার জন্য স্মরণীয় ঘটনা। ভেবেচিন্তে কাজ না করা আমি হুট করেই প্রবাসে পাড়ি দিলাম। যেহেতু পরিবার নিয়ে এসেছি, তাই একটা কাজেও ঢুকে পড়লাম। এরপর দিন আনি দিন খাই অবস্থায় দিন কাটাতে শুরু করলাম। তখন পর্যন্ত ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষায়ও পাস করতে পারিনি। দুই কিলোমিটার দূরের শপিংমল থেকে বাজার করে ট্রলি ঠেলে বাসায় ফিরি। অবশ্য আমি আর মেয়ে মিলে সেই যাত্রাটাকেও আনন্দময় করে তুলতাম। ডাক্তার, হাসপাতাল সব দরকারি কাজে আমরা গণপরিবহনে করে যাতায়াত করি। এমনই একদিন গিন্নীকে নিয়ে রেগুলার চেকআপের জন্য ক্যাম্বেলটাউন হাসপাতালে গেলাম। পরিস্থিতি বিবেচনা করে ডাক্তারেরা সিদ্ধান্ত নিলেন সেদিনই সিজার করবেন।
এ দেশে সন্তান হওয়ার সময় বাবাদেরও থাকার নিয়ম কিন্তু মেয়েকে একা ফেলে আমি যেতে পারলাম না। আমরা বাইরে অপেক্ষা করতে থাকলাম। একসময় নার্স বেরিয়ে এসে আমাদেরকে নতুন অতিথির মুখটা দেখিয়ে নিয়ে গেল। তাকে দেখে মেয়েটার মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল। এরপর একসময় মা এবং ছেলেকে কেবিনে পাঠিয়ে দিল। সিজারের এনেস্থিসিয়া দিতে যেয়ে গিন্নীর স্নায়ুতে ভুল করে বাড়তি তিনটা ছিদ্র করা হয়েছিল। এতে করে অনেক তরল বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর টানা তিন দিন সে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। দ্বিতীয়বার সন্তানের বাবা হবার কথা মনে হলেই আমার কানে তার গোঙানির শব্দ ভাসে।
বাবাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য আসলে কী? এই বিষয়ে অনেক ভেবেছি। অবশেষে যেটা বুঝতে পেরেছি, সেটা হলো সন্তানকে দুনিয়ার বাস্তবতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ায় তার মূল কাজ। পাশাপাশি সন্তানের জীবনকে আনন্দময় ও উপভোগ্য করে তোলাও বাবাদের দায়িত্ব। বলা হয়ে থাকে মানুষ একবারই বাঁচে শৈশবে। বাকি জীবন সেই স্মৃতিই তাকে চালিয়ে নেয়। তাই বাবাদের কাজ হলো সন্তানের শৈশব–কৈশোরের সময়টা স্মৃতিময় করে তোলা। তাদের জন্য কাড়ি কাড়ি সম্পত্তি না রেখে যেয়ে তাদেরকে সুস্থ–সবলভাবে বড় করে তোলায় বাবাদের প্রধান দায়িত্ব। এরপর বড় হয়ে নিজেরটা যখন নিজেই অর্জন করবে, তখন অনেক বেশি আনন্দ ও সুখ পাবে।
আমি তাই শুরু থেকেই বাচ্চা দুটিকে দুরন্ত এবং আনন্দময় শৈশব উপহার দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। যেটা আব্বা আমাদের ক্ষেত্রে করেছিলেন। আমাদের পাড়ায় একমাত্র টেলিভিশন ছিল সালামদের বাড়িতে। টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যেত। আব্বা তখন পাশের ঘর থেকে হাত বাড়িয়ে আমাদের কক্ষের দরজার খিল খুলে দিতেন। আবার কখনো তিনিও আমাদের সঙ্গী হতেন। সেদিন ঝড়টা যেত আব্বার উপর দিয়ে। এরপর আমরা বড় হয়ে যাবার পর আব্বা হয়ে উঠেছিলেন আমাদের খেলার সঙ্গী। আমরা তিন ভাই আর আব্বা মিলে তাস খেলে কত দিন যে পার করেছি, তার হিসাব নেই।
দেশে কিংবা প্রবাসে বাবাদের দায়িত্ব আলাদা কিছু নয়। দেশে থাকতে দিন শেষে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমি আর মেয়ে মিলে মশারির মধ্যে ল্যাপটপ নিয়ে বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে ছবি দেখা ছিল আমাদের নিয়মিত অভ্যাস। ওর মায়ের নাইট ডিউটি থাকলে রাত্রে উঠে পানি খাওয়ানো, টয়লেট করানোর মতো কাজগুলোও করতে হতো। সপ্তাহান্তের দিনগুলো বাড়তি আনন্দের উপলক্ষ বয়ে নিয়ে আসত। সকাল সকাল উঠেই আমরা হাঁটতে বের হতাম। সারা পাড়ায় আমরা হেঁটে বেড়াতাম। ঘুরতে ঘুরতে আমাদের অনেক বন্ধুও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। পাড়ার কুকুর, বিড়াল থেকে শুরু করে পাখির খবরও আমাদের কাছে থাকত।
এভাবেই আমরা পাড়ার সব খবর রাখতাম। কোথায় সবজির চাষ হচ্ছে, কোথায় নার্সারিতে নতুন ফুল গাছ এসেছে, সবই ছিল আমাদের নখদর্পণে। এ ছাড়া বিভিন্ন ঋতুতে আমরা বিভিন্ন রকমের খাবারের স্বাদ নিতাম। শীতকাল এলেই আমরা সকাল বেলায় বের হয়ে পাড়ার মোড় থেকে ভাপা পিঠা কিনতাম। আর খেঁজুরের গাছ খুঁজে বের করে তার রসেরও স্বাদ নেয়া হতো। এ ছাড়া পাড়ার মসজিদের তালগাছের রসও বাদ পড়তো না। পাড়ার মাজারের মেলা বাড়তি আনন্দের উপলক্ষ নিয়ে আসত। তখন প্রতিদিন আমি অফিস থেকে ফিরে মেয়েকে কাঁধে নিয়ে মেলায় বেড়াতে যেতাম আর ফেরার সময় সস্তার কোনো খাবার বা খেলনা কিনে আনতাম।
প্রবাসী বাবাদের দায়িত্ব সীমাহীন। প্রবাসী বাবাদের হতে হয় সবজান্তা এবং সব্যসাচী। তাঁদের বাবা হওয়ার পাশাপাশি একই সঙ্গে আত্মীয়–স্বজনের ভূমিকাও পালন করতে হয়। সর্বোপরি সন্তানের বন্ধু হয়ে যেতে হয়। তবে সন্তানদের শৈশবটাকে আনন্দময় করে গড়ে তোলা প্রবাসী বাবাদের জন্য একটা কঠিন কাজ। কারণ, এখানে বাবাকে অহোরাত্র জীবিকার সন্ধানে ছুটতে হয়। তার কর্ম দিবসগুলোতে বাচ্চাদেরকে দেওয়ার মতো সময় হাতে থাকে না। আর সপ্তাহান্তে বাচ্চাদের এত বেশি কর্মব্যস্ততা থাকে যে তখন আবার তাদের দম নেওয়ার সময় থাকে না। এভাবেই কেটে যায় সপ্তাহ, মাস, বছর। তাই দিন শেষে বাচ্চাদের বলতে শুনি, আই এম বোরড।
প্রবাসী বাচ্চাদের এটা খুবই সাধারণ একটা সমস্যা। এর থেকে মুক্তির জন্য আমি নিজে নিজে কিছু উপায় বের করেছিলাম। চেষ্টা করেছিলাম আমার অনাড়ম্বর শৈশবটাকে ওদের মধ্যে পুনর্নির্মাণ করতে। পাইনগাছের খোলে করে ওদেরকে টেনে নিয়ে বেড়ানো। বৃষ্টি হলেই বল দিয়ে তাদের বাসার সামনে নামিয়ে দেওয়া। অনেক সময় কাগজের নৌকা বানিয়ে রাস্তার পাশের ড্রেনের পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া। বাসার মধ্যে লুডু, ক্যারম খেলা। এ ছাড়া ছোট ছোট কাগজের টুকরায় নম্বর লিখে চোর–পুলিশ খেলা। পাশাপাশি অনেক গল্পের বই কিনে দেওয়া। যতটা পারা যায় তাদেরকে ডিভাইস থেকে দূরে রাখার চেষ্টা আর কি।
প্রবাসে সবাই একক পরিবারে বাস করেন। বাবা, মা আর সন্তান। এর বাইরে মানুষের আনাগোনা খুবই কম। তাই প্রবাসী বাবাদের সন্তানকে তার দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করার পাশাপাশি মাকেও সাহায্য করতে হয়। আমি সব সময়ই রান্নাকে একটা শিল্পের সঙ্গে তুলনা করি, কারণ, সেখানে সবকিছুই পরিমাণ মতো দিতে হয়। উপরন্তু সেই উপাদানগুলোকে সঠিক তাপে রান্না করতে হয়। তার ওপরই নির্ভর করে রান্নার স্বাদ। আমার কখনোই এতটা ধৈর্য ছিল না যে সন্তানদের কোনো কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবো বা কোনো কিছু রান্না করব। সেই আমিই এখন প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে সন্তানদের দিনলিপি শুনি আবার প্রয়োজন মতো ভাত তরকারিও রান্না করি। এ ছাড়া বাচ্চাদের বিভিন্ন মেলায় নিয়ে যেতে হয়। সপ্তাহান্তে একটু অবসর পেলেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি। একসময় রুটিন করে সপ্তাহের একটা সকাল আমরা বনেজঙ্গলে হাইকিং করতাম। বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতে মিশতে রাগ দেখানোটা কমে এসেছে। এখন আমি মোটামুটি সর্বংসহা। অবশ্য বয়স বেড়ে যাওয়াটাও একটা কারণ।
কাহলিল জিবরান সন্তান সম্মন্ধে সবচেয়ে সুন্দর কথাগুলো বলেছেন। আমাদের সন্তানেরা আসলেই আমাদের সন্তান নয়। তাই তাদের আমাদের মতো বানানোর চেয়ে আমাদের হয়ে যেতে হবে তাদের মতো। আমার আব্বাকেও দেখেছি আমাদের কর্মকাণ্ডে সহায়কের ভূমিকা পালন করতে। রাত জেগে টিভি দেখা, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে কখনো বাধা দেন নাই। বরং নিজে এসে মাঝেমধ্যে যোগ দিতেন। আর ভরসা পেয়ে আমরাও তার সঙ্গে সবকিছুই ভাগাভাগি করে নিতাম। এই শিক্ষাটাই আমি আমার সন্তানদের পালন করার বেলায় মনে রাখি। এতে ওরাও নিঃসংকোচে আমার সঙ্গে সবকিছু ভাগাভাগি করে নেয়। এখন আমি তাদের বাবার চেয়ে বন্ধুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছি। এতে করে নিজেও প্রতিদিন শিখছি। এই শেখাটা একটা নিরন্তর যাত্রা। পরিশেষে কাহলিল জিবরানের কথাগুলো দিয়ে লেখাটা শেষ করি:
‘তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়।
তুমি তাদের মতো হওয়ার সাধনা করতে পারো, কিন্তু
তাদের তোমার মতো বানানোর চেষ্টা কোরো না।
কারণ, জীবন পেছনের দিকে যায় না, গতকালের জন্যে বসেও থাকে না।’
*দূর পরবাসে ছবি, লেখা ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]