যাবার বেলায় বাবা হাত ধরে বলেছিলেন—‘দেখতে এসো, বাবা, তোমার মাকে।’

লেখকের মায়ের কবরস্থানছবি: লেখকের পাঠানো

সে বহু বছর আগের কথা। বাংলাদেশ ছাড়ার আগে গিয়েছিলাম ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে বাবা–মা, ছোট ভাইবোনদের বিদায় দিতে। মা বলেছিলেন, ‘নিয়মিত চিঠি দিও, বাবা।’

১৯৮৫ সালের ১৯ মে আমি সুইডেনে আসি। সেই থেকে চিঠির মাধ্যমে মা–বাবা, ভাই-বোন ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম। পরে কোনো এক সময় চিঠি লেখার অভ্যাস কমে আসে—প্রথমে টেলিফোন, পরে প্রযুক্তির সহায়তায় পৃথিবীর দূরত্ব আরও সংকুচিত হতে থাকে।

১৯৯৩ সাল থেকে আমার মা–বাবা এবং বেশির ভাগ ভাইবোন দেশের বাইরে আসা-যাওয়া শুরু করায় চিঠি লেখার প্রথা আরও কমে যায়। পরবর্তী সময়ে যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে ওঠে টেলিফোন, এসএমএস, ই-মেইল, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

২০০৬ সালে বাবা-মা মারা যান। ভাইবোনেরা বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে আছেন। মাঝেমধ্যে যোগাযোগ হয়, তবে সেই ছোটবেলার মতো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে বললে বড় ধরনের মিথ্যাচার হবে। আমরা সবাই যার যার পরিবার নিয়ে ব্যস্ত, সবাই এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। দরকার ছাড়া কেউ কারও সঙ্গে যোগাযোগ করি না। আমাদের বেশির ভাগ প্রয়োজন এখন জমিজমা নিয়ে। আমি যেহেতু দেশে যাই না, তাই সবাই আশা করে থাকে কবে আমি দেশে যাব আর জমিজমার ঝামেলাগুলো মিটাব। যদিও সরাসরি আমার সঙ্গে কারও কোনো লেনদেন নেই, তবে আমার যেহেতু কিছু সম্পদ রয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই সেগুলো যাতে ভোগদখল ও বিক্রিতে কারও কোনো ঝামেলা না হয়—মূলত সে কারণেই মাঝেমধ্যে পরিবার থেকে হৃদয়ছোঁয়া কথা শুনতে হয়।

দেশের প্রসঙ্গে পরিবারের ভাবখানা এমন যে আমার জন্য সবাই বসে আছে শুধু একনজর দেখার অপেক্ষায়। মা মাঝেমধ্যে বলতেন—‘মার চেয়ে মাসির দরদ।’

মায়ের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। মনে পড়ার শত শত কারণ রয়েছে। মা ১৯৯৩ সাল থেকে সুইডেনে আসা-যাওয়া করতেন। তবে তাঁর বাংলাদেশের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এতটাই গভীর ছিল যে পৃথিবীর কোনো কিছুই তাঁর কাছে ভালো লাগেনি। তিনি বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন, বহু কিছু দেখেছেন, কিন্তু বলতেন—‘ছায়াঘেরা, সবুজে ভরা, মায়ামমতায় আবদ্ধ বাংলাদেশের মানুষের মতো মানুষ কোথাও দেখিনি। আর তোমার বাবার মতো বাবা তো পৃথিবীতে আর নেই।’

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

দেশের জন্য এত কিছু করা সেই নারীই হঠাৎ স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন এবং সুইডেনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলেন। ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে নিজ হাতে কবর দিই সুইডেনের লিনশোপিং শহরে। লিনশোপিং-এ এখন আর কেউ থাকেন না। আমি এবং আমার সহধর্মিণী মারিয়া মাঝেমধ্যে স্টকহোম থেকে লিনশোপিং-এ যাই, মায়ের কবর জিয়ারত করতে।

লিনশোপিং আমার সুইডেনের প্রথম শহর, যেখানে আমি লেখাপড়ার সুবাদে পাঁচ বছর থেকেছি—যেন আমার হোম টাউন। মায়ের কবর জিয়ারতের পর বাবা বাংলাদেশে ফিরে গেলেন। যাবার বেলায় মায়ের কোটটা গোছাচ্ছিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম—‘কেন নিচ্ছেন?’ উত্তরে বাবা বললেন, ‘যখন তোমার মায়ের কথা মনে পড়বে, তখন ওটা দেখে মনে করব।’

আমরা তখন সবাই শুধু আবেগে ভাসছিলাম। গভীরভাবে চিন্তা করতে পারিনি। তবে পরে বহুবার ভেবেছি—একসঙ্গে জীবনের এতটা বছর কাটালে ভালোবাসার বন্ধন স্বাভাবিকভাবেই এভাবে প্রকাশ পায়।

শেষবার কবর জিয়ারত করতে গিয়ে বাবা আমাকে বলেছিলেন—‘তুমি সময় পেলেই তোমার মায়ের সঙ্গে দেখা করে যেও, বাবা।’

শুধু সে কারণেই আমি বারবার লিনশোপিং-এ যাই তা নয়। আমি মাকে দেখতে যেতে পছন্দ করি। কেন যেন মনে হয় মা এখনো আছেন আমার প্রথম হোম টাউনে—আমি আজ লিনশোপিং-এ মাকে দেখতে এসেছি।

*লেখক: রহমান মৃধা