লালমিয়ার দ্বিতীয় বিয়ে-১ম পর্ব
বসন্তের শুরুতেই ঢাকার আবহাওয়া গরম হতে থাকে। মে মাসে তা চরম আকার ধারণ করে। কয়েক দিন ধরে প্রচণ্ড গরম পড়েছে। গরম যত বাড়ে বিদ্যুৎ বিভ্রাট তত বেশি। এমন একটা সময় আসে, যখন বলতে হয় বিদ্যুৎ কখন আসবে। একে তো গরমের উৎপাত, তার ওপর কাস্টম হাউজের উৎপাত। বন্ডেড ওয়্যার হাউজের অডিট। এ সময় অডিট হওয়ার কথা না। সব কিছুর মূলেই রয়েছে তাদের উপরি আয়ের পথ। একসময় ছিল বেতন কম বলে সরকারি চাকরিতে কেউ আগ্রহী হতো না। সবাই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ খুঁজত। আজকাল সরকারি চাকরির বাজার রমরমা। ক্ষমতা ও অর্থ—দুটোই আছে। এখন ঘুষকে উপরি আয় বলা হয়, যা একটি ছেলের বিবাহের পাত্র হিসেবে বিশেষ যোগ্যতা। সে যাই হোক, বর্তমান অডিট, শেয়ার বাজার আর আমার এক্সপোর্ট এইড প্রতিষ্ঠান নিয়ে বেশ ব্যস্ততা যাচ্ছিল। প্রচণ্ড গরমও একটি উটকো উপরি আয়।
এই প্রচণ্ড গরমে একটি বাস্তব কৌতুক মনে পড়ে গেল। আমরা কিছু বন্ধু সে সময়ে ঢাকা শেরাটন ক্লাবের সদস্য হয়েছি। সেখানে কাজের পর নিয়মিত ব্যায়াম করতে যাই। আমি তখন শেরাটন ক্লাবের অন্যতম সেরা টেবিল টেনিস প্লেয়ার। সে কারণে সবাই আমাকে বিশেষ খাতির করতেন। সে যা হোক আমাদের এক সিনিয়র ভাই ছিলেন, নাম পান্না। আমি ব্যায়াম শেষ করে সুইমিং পুলের ধারে বসে আছি। এমন সময় পান্না ভাই এসে পাশে বসলেন। আমাকে বললেন, ব্যবসা গরম, তাই না? আমি বললাম, না পান্না ভাই ব্যবসা তো নেই ভালো হবে কেমন করে? তিনি আবার বললেন, না না আমি বলতে চাইছি ব্যবসা গরম। আমি আবার একই সুরে বললে, তিনি বিরক্ত হয়ে চলে গেলেন। হঠাৎ আমার মনে হলো তিনি হয়তো বলতে চাইছিলেন ভ্যাপসা গরম। মনে পড়ে একদিন শেরাটনে বসে আছি লালমিয়ার ফোন। আমি বললাম, কি ব্যাপার ভাই আপনি তো কখনো রাতে ফোন করেন না! ব্যাপার কী? সে বললো, কিয়ের ব্যাপার ভাইসাব, মনডা চাইল আপনারে দেহি তাই ফোন করলাম। আমি বললাম, শেরাটনে সুইমিং পুলে বসে আছি, আসেন কথা বলা যাবে। কিছুক্ষণ পর লালমিয়া এলে আমি বললাম, এদের ক্লাব স্যান্ডউইচের সঙ্গে চা ভালো, আসেন খাই। সে বললো, স্যান্ডউইচ খাইবার পারি, মাগার চা খামু না। আমি বললাম, চা খাইতে সমস্যা কী? সে বলল, যেইহানে কাপের চাইতে চায়ের দাম বেশি হেইখানে চা খাওনের ফায়দা কী?
এমন ভাবনার মধ্যে আমাকে অবাক করে সশরীর প্রবেশ করল লালমিয়া। সে আগে কখনোই আমার শান্তিনগর অফিসে আসে নাই। তাঁর আসার কারণ বুঝতে পারলাম না। উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললাম, কি এমন জরুরি ব্যাপার যে এখানে এলেন? একটু পরই তো স্টক এক্সচেঞ্জ অফিসে দেখা করতে পারতাম। লালমিয়া বললো, হেইডা তো আমি জানি। তয় ভাবলাম আপনার লগে নিরিবিলি কথা কওনের দরকার। আমি একটু চিন্তিত হলাম, কী এমন কথা যে তার নিরিবিলি পরিবেশ দরকার! সে সময় বেইলি রোডে নতুন এক বেকারি হয়েছে, নাম ঠিক মনে পড়ছে না, সম্ভবত ফ্রেঞ্চ বেকারি। তাদের চিকেন পেটিস খুবই সুস্বাদু ছিল। আমার পিয়নের বাড়ি ছিল ফরিদপুরের কোনো এক অঞ্চলে। আমি পিয়নকে বললাম, আমাদের জন্য চিকেন পেটিস নিয়ে আসো তারপর চা দাও। কিছুক্ষণ পর পিয়ন ফিরে এসে বললো, স্যার, ‘ওই চেকন চেকন তা পাওয়া যাচ্ছে না, মুটা মুটা বার্গা আছে নিয়ে অসপো?’ আমি হাসি চেপে বললাম, দরকার নেই চা দাও।
আমার হাতের কাজ শেষ করে লালমিয়াকে বললাম, বলেন কী বলতে চান। তার মুখে লজ্জার আভা দেখতে পেলাম। সে বললো, ‘কী যে একখান শরমের ভিত্রে হান্দাইছি, আপনারে কইতেও সরম লাগে। তবুও তো কইতে হইব।’ আমিও তাকে সময় দিলাম কিছু না বলে। তারপর সে গলা কেশে পরিষ্কার করে বলল, ‘বাইসাব আপনারে তো কওনই যায়। আইজকাল আমার গিন্নি বড়ই বেলাজ হৈছে। কথায় কথায় মুখ ঝামটা দেয়। আমার লগে উচা গলায় কতা কয়। সোয়ামি হিসাবে আমারে গোনায় ধরে না।’ আমি বললাম, এটা তো আপনাদের পারিবারিক ব্যাপার, এ ক্ষেত্রে আমার কী করার আছে? আপনারা নিজেরাই বসে আলোচনা করে সমাধান বের করেন।’ সে বললো, ‘হ্যায় তো আগুনের গোলা, কতা কওনের আগেই ছ্যাত কইরা জইল্লা উঠে, হে লাগ্গাই নিজেই একখান সিদ্ধান্ত লৈছি।’ জানতে চাইলাম, কী সিদ্ধান্ত? তার ফর্সা মুখ গোলাপি হয়ে গেল। তারপর বললো, ‘ভাবতাছি দ্বিতীয় সাদি কইরাই ফালাই। তহন দেখবেন ডরে গিন্নি ঝগড়াবিবাদ থাইকা ক্ষ্যামা দিবো। আমার কইলাম দ্বিতীয় সাদি করণের খায়েশ আছিলো না, কি করুম ভাই, এক্কেরে মাইনকার চিপায় পইড়্যা গেছি গা, অহন আর উপায় নাইক্যা। এইবার দেইখ্যা শুইন্যা শান্ত স্বভাবের মাইয়া আনতে অইবো, কি কন ভাইসাব? ঘটকরে খবর পাঠাইছি। আপ্নেরে পরে বিস্তারিত জানামু নে। বিষয় খান আপনারে না কৈলে আমার মন শান্ত ওইতো না।’ লালমিয়া মেশিন গানের গুলির মতো এক নিশ্বাসে অনেক কথা বলে ফেললো, আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই। আমি বললাম, ‘আমার তো বলার মতো কিছু রাখেন নাই। আপনি সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেই এসেছেন। এখানে আমার কি বলার আছে।’ আমি বিস্ময়ে তার দিকে তাকালাম। তার কোনোই ভাবান্তর দেখলাম না। সে আরও বললো, ‘আমার লগে কইন্যা দেখতে আপনার যাওনি লাগবো, অস্বীকার যাইবেন না কইলাম।’ ভাবলাম তার এমন ভীমরতি পছন্দ করছি না, তার উপর কন্যা দেখতে সঙ্গে যাবো? প্রশ্নই উঠে না।
বয়সকালে মেয়েরা কেন এমন আচরণ করে সে কথা বলে যদি তাঁকে শান্ত করা যায়। আমি বললাম, মেয়েরা একটু বয়স হলে এমন হয়। হঠাৎ হঠাৎ তাদের আচরণ পাল্টে যায়। এর কারণ হরমোনের ভারসাম্যহীনতাসহ মেয়েলি কিছু পরিবর্তনের কারণে। শুধু আপনার স্ত্রী কেন এমন বয়সে লক্ষ করবেন আপনার মা-বোনও এমন করছেন। তাঁদের এমন দেখলে মনে হতে পারে উনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন, আসলে তা না। একে ইংরেজিতে বলে মুড সুইং। আর এই মুড সুইংয়ে ভোগা মেয়েরা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় প্রাণী। ওরা নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে আপনার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করতে চায়। কিন্তু পেরে ওঠে না। এবং এই অস্বাভাবিক আচরণ করে তাদের প্রিয় মানুষের সঙ্গে। ওরা ইচ্ছে করে এমনটি করে না। এমন সংকটময় সময় তাদের কথা শোনার জন্য একজন মানুষ দরকার। আপনি সেই ভূমিকা পালন করেন, তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করেন, দেখবেন তিনি বেশ কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছেন। কথায় আছে না! চোরায় না শুনে ধর্মের কাহিনি! আমার কথা শুনে মনে হলো না যে লালমিয়া বিশ্বাস করেছে। সে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘ভাইসাব, আপনি আমার সমস্যা বুজবার পারবেন না। বাইর থাইক্যা অনেক উপদেশ দেওন যায়, কিন্তুক ঘরের মইধ্যে এমন আজব জিনিসের মনরক্ষা করন যায় না।’ আমি আর কথা বাড়ালাম না। এর সঙ্গে তর্কে না গিয়ে চুপ থাকলাম। আমি বললাম, উঠি আমার অনেক কাজ। তার দিকে না তাকিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে গেলাম।
প্রচণ্ড গরম পড়েছে। গাড়িতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র চালিয়ে কিছুক্ষণ ভালো থাকা যায়। আজকাল প্রায় সবার বাড়ি, গাড়ি এবং অফিসে শীতাতপ যন্ত্রের ব্যবস্থা রয়েছে। পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যায়। তখন সমস্যা হয় যারা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ত তাঁদের। আমিও এ আওতার মধ্যে। তাই পারতপক্ষে বাসায় ওই যন্ত্র থাকা সত্বেও ব্যবহার না করে বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহার করার চেষ্টা করি। তাতে করে বিদ্যুৎ চলে গেলে গরম কিছুটা সহনীয় হয়। অফিসে যেহেতু জেনারেটর আছে তাই খুব একটা সমস্যা হয় না। শান্তিনগর অফিস থেকে মতিঝিল খুব একটা দূরে না। যানজট না থাকলে ১৫ মিনিটেই যাওয়া যায়। কিন্তু সে সৌভাগ্য কি আর ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের আছে? আজ প্রচণ্ড গরমের সঙ্গে অস্বাভাবিক যানজট। আমার লালমিয়াকে রেখে আসা ঠিক হয়নি। সঙ্গে নিয়ে আসলে কি এমন হতো! মনটা খারাপ হয়ে গেলো। তাকে সঙ্গে না নিয়ে আসার আরেকটা কারণ হচ্ছে যাবার পথে ব্যংকে যেতেই হবে। এই যানজটে ব্যাংকে যাওয়ার আশা বাদ দিলাম। যানজটে বসে আছি, হঠাৎ দেখি লালমিয়া পাশের রিকশায়। জানালা খুলে তাকে ডাকলাম। সে কিছুটা ইতস্তত করে উঠে এল গাড়িতে। আমি বললাম, আপনি গাড়ি নিয়ে আসেন না কেন? সে বললো, আমি তো ডেরাইবার রাহি না, নিজেই গাড়ি চালাই। বাইরে পার্ক করলে আজাইরা জিনিসপত্র চুরি হয়। তাছাড়া আমার রিক্সায় ঘুরতে বালা লাগে। তাঁর প্রতি আমার সাময়িক রাগ হয়েছিল তাঁর দ্বিতীয় বিয়ের কথা শুনে। আমি মনে হয় তাঁর সঙ্গে একটু বেশিই খারাপ আচরণ করে ফেলেছি। তাঁর চেহারায় সে ছাপ সুস্পষ্ট। আসলে প্রেম-ভালোবাসা, বিয়েশাদি সবই ব্যক্তিগত ব্যাপার। সব কিছু সহজ করে লালমিয়ার স্বাভাবিক আচরণে ফেরার চিন্তা করলাম। ‘আমি তো দেখছি আপনি রিকশা নিয়ে পরে রওনা হয়ে আমাকে ধরে ফেলেছেন।’ সে বলল, ‘হেলাইগাই তো ঢাকা শহরে রিকশাই ভালা। জ্যামে আইটক্যা গেলে রিকশা ছাইড়া হাঁটা দেওন যায়। তার কথায় যুক্তি আছে।’ চলবে....
**বায়াজিদ গালিব, ক্যালগেরি, ক্যানাডা
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]