আলাবামার মাছওয়ালা

সন্ধ্যার আলো তখনো সম্পূর্ণ মিলিয়ে যায়নি, পশ্চিমের শেষ আবিরটুকু আকাশকে লাল করে দিয়ে হালকা ম্রিয়মাণ আলোয় আলোকিত করে তুলছে আলাবামার ছোট্ট শহর মবিলকে। সেই আলোকচ্ছটা যেন প্রতিফলিত হয়ে মিশে যাচ্ছে শহর ধারের বিশাল নদী। এটাকে মবিল বে বলে চেনে সবাই। নিস্তরঙ্গ বে–এর পানিতে হালকা আন্দোলন তুলে ক্ষণে ক্ষণে জাল বিছিয়ে মাছ শিকারে ব্যস্ত এক যুবক। বে–এর পানিতে হালকা ভিজে গিয়ে সাগর থেকে ভেসে আসা লবণ জড়ানো শীতল বাতাসে কাঁপতে কাঁপতে পিয়ারের স্পটলাইটে দেখে নিতে থাকে সদ্য জালে উঠে আসা কিছু মাঝারি সাইজের বিভিন্ন মাছ। ওই যুবকটিই আমি।

বে–এর এখানটায় সাগরের কিছুটা আভাস সঙ্গে করে মবিল রিভার বেয়ে আসা মিষ্টি পানির প্রবাহ মিলেমিশে মিষ্টি একটা লবণ পানির আধার তৈরি করে দিয়েছে। এরা এ পানির নাম দিয়েছে ব্রাকিশ ওয়াটার। পানির এ প্রকৃতির কারণেই কি না জানি না, মিশেল প্রজাতির মাছের দেখা মেলে এখানটায়। সরপুঁটি সাইজের ক্রোক ক্রোক শব্দ করা ক্রোকার, বাটা মাছের মতো বিশালমুখী সাদা ট্রাউট, জ্যালজ্যালে বাইন মাছের জাত ভাই নিডল ফিশ, নদীর বেলে মাছের যমজ কিংফিশ, ছুড়ি আর সাপের সংমিশ্রণে পাতলা ফিনফিনে অথচ লম্বা বেল্ট ফিশ সঙ্গে আরও কত কি! ছিপ ফেলে বিশাল আর অদ্ভুত অদ্ভুত সব মাছ ধরা যায়। বিশাল জারুল পাতার মতো দুই চোখ এক পাশে থাকা ফ্লাউন্ডার এ অদ্ভুত মাছগুলো সবার আগ্রহের কেন্দ্রে। একটা পেলেই যেন জীবন সবার বর্তে যায়। যে পায় তার হাসি আর ধরে না। এ বিদঘুটে কেন সবার এত পছন্দ, আমার মাথায় আসত না। তবে শেষমেশ বুঝলাম যেদিন আমার ভাগ্যে একটা এসে পড়ল। এককথায় অসাধারণ। হালকা পেঁয়াজ দিয়ে ভেজে গরম গরম নলা ভাতের সঙ্গে মুখে দেওয়া হয়, চোখের পলকে মুখে মিশে গিয়ে অনাবিল এক আনন্দের আবহে যেন সবকিছু পরিপূর্ণ করে দেয়।

সবচেয়ে অপূর্ব লাগে জালে মাঝেমধ্যে উঠে আসা বে–এর স্বচ্ছ কুচো চিংড়ি আর প্রায় অদৃশ্য গ্লাস মিনো। সন্ধ্যা হলেই কুচো চিংড়িগুলো বে–এর গভীর জল থেকে উঠে আসে পিয়ারের স্পটলাইটের নিচে। জুলু জুলু চোখে ভেসে বেড়াতে থাকে পিয়ারের পায়ার চারপাশে, যেখানে জলজ পাঙ্কটনে ভরপুর। জাল ফেললেই চার–পাঁচটা করে দেখা মিলবে তাদের। আর সঙ্গে করে কয়েক থোকা গ্লাস মিনো। গ্লাস মিনোগুলো যেন বাংলার কাচকি মাছের এক্কেবারে পাশের বাসার আত্মীয়। চিকন করে কাটা টমেটো সঙ্গে করে কচি কচি ফালি করে কাটা ঝাল আর ধনেপাতার কুচি দিয়ে হালকা কড়াইয়ে ভেজে নেওয়া। এক ধাক্কায় যেন আপনাকে আমেরিকার কোনো এক অচিনপুর থেকে টেনে নিয়ে ফেলে দিয়ে আসবে আপনার মায়ের হাতের সেই রান্নাঘরে। এক গাল মুখে দিয়ে হয়তো ভুলেই যাবেন আপনি আর বাংলাদেশে নেই।

মাছ ধরার নেশায় পাগল হয়ে যাওয়া আমি জাল ফেলতে ফেলতে ভুলেই যাই সময়, কাল, আর আবর্তের সীমা–পরিসীমা। সন্ধ্যা গড়িয়ে সময় সময় মাঝরাত অবধি হয়ে যায়। জালের সুতোয় সুতোয় জমে ওঠা কাদাজল পা থেকে মাথা অবধি ছেয়ে ফেলে আমাকে। শীতল বাতাস এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যায় ক্ষণে ক্ষণে। পায়ের কাছে থাকা কুলায় ভর্তি হরেক রকমের মাছের মেলা আর কাদাভর্তি হাত, পা, মাথা কেন যেন মনে করিয়ে দিতে থাকে ঢাকার কোনো মহল্লায় ভোরবেলা মাথায় সিলভারের থালায় মাছ নিয়ে ফেরি করে বেড়ানো কোনো মাছের হকারের কথা। ওরা যখন মাছ ফেরি করে বেড়াত, শৈশবে সদ্য পা দেওয়া আমি তখন জানালার গরাদে গাল লাগিয়ে হা করে তাদের ডালির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বোঝার একটা অসম্ভব চেষ্টা করে যেতাম ডালির সেই মাছগুলোকে। সময় সময় হয়তো আমার মা তাদের ডেকে নিয়ে দরদাম করতেন মাছ। দরজার সামনে হাঁটু মুড়ে মাথায় গোল করে পাকানো গামছাটা দলা ছাড়িয়ে রোদে পোড়া ক্ষয়ে যাওয়া শরীরে জমে ওঠা ঘাম মুছে নিত তারা। আর গা দিয়ে সস্তা কোনো বিড়ির গন্ধ নাকে এসে লাগত তখন। অদ্ভুত নেশা ধরানো সেই গন্ধে তাদের ক্ষয়িষ্ণু মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কী উজ্জ্বল লুকানো আনন্দে ভরা তাদের চোখ দুটি!

কোনো এক সুদূর আমেরিকার মাটিতে কোনো এক নাম না জানা অর্ধেক ভেঙে পড়া কাঠের পিয়ারের এক পাটাতনে হাঁটু মুড়ে বসে নিস্তরঙ্গ মবিল বে–এর জলে পেছন থেকে এঁকেবেঁকে আসা স্পটলাইটের আলোয় নিজের কাদামাখা এলোমেলো চুলের প্রতিবিম্বে যেন আমি তাদেরই ছায়া খুঁজে পাই আচমকা।

* লেখক: ড. মইনুর রহমান, ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার ১, ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট, সিটি অব মবিল - গভর্নমেন্ট, মবিল, আলাবামা, যুক্তরাষ্ট্র