ব্লুবেরি ও স্ট্রবেরিবাগান দেখা
শৈশবে মসজিদের ওস্তাদজির হাতে, প্রাইমারি স্কুলের স্যারদের হাতে ও বার একাডেমি স্কুলে ইয়াসিন স্যারের হাতে দেখেছি মহার্ঘ্য বেত শোভা পেতে। কচি বেত ভাজি করেও খাওয়া যেত সে সময়। বেতগাছের ফলের নাম বেততুইন। পাকা বেততুইনের খোসা ছাড়িয়ে খেয়েছি অনেক। গাছে ব্লুবেরি ফল এবারই প্রথম দেখলাম। প্রথম দেখেই মনে হলো এ যেন আমার বাসার কাছে শৈশবে জঙ্গলে দেখা বেতগাছের বেততুইন ফলের মতো থোকায় থোকায় ঝুলে আছে। তখন মনে পড়ে বেততুইন খাওয়ার কথা—‘সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি’।
কাঁচা–পাকা ব্লুবেরি ও শুকিয়ে যাওয়া ব্লুবেরির মধ্যেও যে নেশাজাগানিয়া মনমাতানো রং লুকিয়ে আছে, সত্যি না দেখলে আদৌ জানতাম না। বাগানের ঘাসের ওপর ঝুড়ি ফেলে দিয়ে ছবি তোলায় মগ্ন হই। ব্লুবেরি তো গ্রোসারিতে কিনতে পারব, ছবি তো আর গ্রোসারিতে পাব না।
৪০ বছর বয়সী স্ট্রবেরিবাগানের আয়তন ২০০ একর। দ্বিতীয় জেনারেশন এখন বাগানের দায়িত্বে নিয়োজিত। ঋতুর বিভিন্ন সময়ে সবজি ও ফল তোলার ক্যালেন্ডার রয়েছে। বাগান ঘুরে বেড়ানোর জন্য রয়েছে ওয়াগন। ১৫–১৬ রকমের ফল ও সবজি রয়েছে বাগানটিতে। ফল ও সবজির পরাগায়নের জন্য রয়েছে বিভিন্ন রকমের ফুলের গাছ।
আমার বাসা থেকে ১০২ কিলোমিটার দূরত্বের বাগানটিতে যেতে প্রায় এক ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় হয়। ফিরে আসার সময় যানজটের কারণে সময় আরেকটু বেশি লাগে। বাগানের প্রবেশমুখে রয়েছে বাহারি জিনিসপত্র, মধু, সবজি, ফল ইত্যাদি বিক্রয়ের দোকান। আমি যখন পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করি, তখন দেখলাম, অনেকেই বাগান থেকে বের হয়ে চলে যাচ্ছেন। পার্কিং লটটিও গাড়িতে প্রায় পরিপূর্ণ।
বাগানে প্রবেশের আগে একটি কাউন্টার আছে। এখানে প্রবেশমূল্য পরিশোধ করে ফল ও সবজি তোলার জন্য হালকা বহনযোগ্য প্লাস্টিকের ঝুড়ি নিতে হয়। উল্লেখ্য যে ফল বা সবজির মূল্য প্রবেশমূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়। আমরা আপেলবাগানে গিয়েছিলাম। আপেলবাগানে প্রবেশমূল্যের সঙ্গে আপেলের মূল্য সমন্বয় করেনি। আপেলের জন্য আলাদাভাবে মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে। অভ্যর্থনা কাউন্টারে বালিকার কাছে ফলের মূল্য সমন্বয়ের গল্প জেনে ম্যাডামকে বললাম, এটি তো খুবই আশাব্যঞ্জক কথা। তাহলে আমরা স্ট্রবেরি ও ব্লুবেরি দুটোই তুলব। আমরা চারজন প্লাস্টিকের ঝুড়ি হাতে প্রথমে স্ট্রবেরি ক্ষেতে যাওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়াই ওয়াগনের অপেক্ষায়।
টাঙ্গাইলের মধুপুরের লালমাটির মতো ধুলা উড়িয়ে ওয়াগন ছুটে চলল। কোভিডের আশীর্বাদ মাস্ক। ওয়াগনে উঠে মাস্কের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। মাস্কের ব্যাপারে আমার ছেলের জ্ঞান টনটনে। স্ট্রবেরিখেতে আসার পর হাসি মুখে এসে যুবক এরিক ধারাবিবরণী দেয়। সে জানায়, এটি সম্পূর্ণ ধূমপানমুক্ত এলাকা। ছেলেটির হ্যাট ও তাঁর সানগ্লাস আমার দৃষ্টি কেড়ে নিলে বলি, শোনো হে যুবক, তোমার দুই-চারটা পোর্ট্রেট ছবি তুলতে পারি? সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
একটি স্ট্যান্ডে রাখা টেপরেকর্ডার থেকে সংগীত ভেসে আসছে। স্ট্যান্ডের গায়ে হেলান দেওয়া সাইকেলটি দেখে মনে হলো ছবি তোলা যায়। সাইকেলটি টেনে এনে আলাদাভাবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে বিফল হলাম। সাইকেলটির ছবি তুলে বাগানের প্যানোরামা ছবি তুলি। এরপর লাল টুকটুকে স্ট্রবেরি আমাকে হাতছানি দেয়। দু–একটা তুলে খেয়ে দেখি টক ও মিষ্টি স্বাদ রয়েছে পাশাপাশি। চেরি বাগানে গিয়েছিলাম অনেক আগে। সপরিবার এ রকম বাগানভ্রমণ বেশ আনন্দদায়ক। স্ট্রবেরি তোলা শেষ হলে এবার ব্লুবেরিখেতে যাওয়ার জন্য ওয়াগনের অপেক্ষায় লাইনে দাঁড়াই। ব্লুবেরিখেতে যাওয়ার সময় দেখি, ছোট্ট এক শিশু আনমনে স্ট্রবেরি খাচ্ছে। স্ট্রবেরির লাল রঙে রঞ্জিত তাঁর হাসিমাখা মুখ আমার দৃষ্টি কেড়ে নেয়। লাল ধুলায় আচ্ছাদিত হয়ে ব্লুবেরিখেতে পৌঁছাই।
ব্লুবেরিখেতের পাশেই হলুদ ও সবুজ রঙের বিন। অনেকেই দুই রঙের বিন তুলছে। আমি একাই ছুটে যাই সানফ্লাওয়ারগাছের কাছে। সানফ্লাওয়ার ফুলে মৌমাছির ওড়াউড়ি দেখে ছবি তুলি। ‘মৌমাছি, মৌমাছি/ কোথা যাও নাচি নাচি/ দাঁড়াও না একবার ভাই।/ ওই ফুল ফোটে বনে/ যাই মধু আহরণে/ দাঁড়াবার সময় তো নাই।’ তাঁর ধ্যানের ব্যাঘাত ঘটলে খবর আছে, ছবি তোলা বন্ধ করে ভয়ে সরে আসি। জুকিনি গাছের ফুল দেখতে অবিকল মিষ্টিকুমড়া ফুলের মতো। যদিও জুকিনি গাছের পাতা দেখতে গাঢ় সবুজ রঙের। এত বড় বিশাল জুকিনি আমি আজও গ্রোসারিতে দেখিনি। ‘আকাশ এত মেঘলা যেয়ো নাকো একলা, এখনি নামবে অন্ধকার।’ ফোনে ম্যাডামের কণ্ঠস্বর, ‘বৃষ্টি নামবে, চলে এসো।’ ফোনটা জানাল, মেমোরি ভরে গেছে। তাকিয়ে দেখি ওয়াগন সাহবে দাঁড়িয়ে, ছাতাসহ হাত তুলে দৌড় দিই।