১.
রসমালাই, রসমালাই, আগুন, আগুন; ওই কীরে, ওই কীরে, মধু, মধু! বাংলাদেশে তরমুজ বিক্রেতা রনি তাঁর বাহারি লাল রসালো তরমুজ বিক্রিতে অসাধারণ এই শব্দমালা ব্যবহার করে অনলাইনে ভাইরাল হয়েছিলেন। মধু, রস, রসমালাই এসব রসালো বিষয়ই রসায়নের জ্ঞান। তরমুজ বিক্রেতা রনি বেশ রসালো মানুষ, তবে রসায়ন বিষয়টা বেশ রসহীন আর কাঠখোট্টা। আশার কথা ব্যবহারিক রসায়ন বেশ মজার, রসে ভরপুর, তাই এটা রসালো রসায়ন। কিন্তু রসালো রসায়নের অনেক রাসায়নিক খুব ভয়ংকর, এসবের অসতর্ক ব্যবহার অতি ভয়ানক! সতর্কতা আর নিরাপত্তার নিয়মাবলি মেনে রসায়নবিদেরা রাসায়নিক নিয়ে কাজ করেন। রসালো রসায়নের পেশাজীবীরা কর্মক্ষেত্রের বাইরে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে রসিকতাকে ধারণ করেন, হাস্যরসে নির্মল আনন্দ খোঁজেন। রসিক রসায়নবিদদের রোজনামচায় থাকে সুচিন্তিত সুপ্রচেষ্টার কথা, ব্যর্থতায় অভিজ্ঞতার কথা, সফলতা অর্জনের কথা, পেশাদারত্বের কথা ও সামগ্রিক জীবনের কথা।
২.
ব্যবহারিক রসায়নকে খুব নিখুঁতভাবে গবেষণা করে প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ফলাফল তৈরি ও এর প্রকাশনা করা রসায়নবিদের কাজ। জীবন বাঁচাতে ওষুধ তৈরিতে, জীবনের প্রয়োজনে প্রসাধনী আর আসবাবপত্র তৈরিতে, জীবনকে টিকিয়ে রাখতে প্রকৃতি থেকে খাবার তৈরিতে, কীটপতঙ্গ থেকে রক্ষা পেতে, প্রযুক্তির উন্নয়নে—এ রকম সবকিছুতেই রয়েছে রসায়ন। জীবনের জন্য আবশ্যিক এত কিছু তৈরিতে রসায়নবিদেরা নিত্যদিন ব্যস্ত থাকেন। পেশাগত জীবনে বড়ই ব্যস্ততা থাকে। এই ব্যস্ততাই কাজে সফলতা এনে জীবনকে সুন্দর করে, আর অসফলতার ব্যর্থতা দেয় নতুন অভিজ্ঞতা ও নতুনের শিক্ষা।
শুধু সফলতা আর ব্যর্থতায় জীবন আটকে থাকে না। আনন্দ, বেদনা, সুখ, দুঃখ, পাওয়া, কিংবা না পাওয়ার অনুভূতিগুলোকে ভাগাভাগি করতে নিজেদের সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে অন্যদের সঙ্গে মিশতে হয়। ক্লান্তিকর গবেষণায় ব্যস্ততার পাশাপাশি রসায়নবিদেরা অন্যদের সঙ্গে মিশে জীবনের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করে। রসায়নবিদেরা কাঠখোট্টা বিষয় রসায়নের গ্র্যাজুয়েট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকেই সেখানে রসায়ন বিভাগের সৃষ্টি, আর এ বিভাগ থেকে শিক্ষা ও গবেষণা সম্পন্ন করা গ্র্যাজুয়েটরা ছড়িয়ে আছেন দেশসহ বিশ্বব্যাপী। এক বৃহৎ সংখ্যক ঢাবি রসায়নবিদ আছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশে গবেষণা, শিক্ষকতা ও ব্যবসাসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে। এই গ্র্যাজুয়েটরা প্রায় সবাই উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী এবং তাঁরা নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে কর্মদক্ষতায় সুপরিচিত।
সমাজে সুপরিচিতি হয়ে ওঠার পেছনের গল্পগুলো সহজ নয়। সুপরিচিত এই সার্থক মানুষগুলো তাঁদের ছাত্রজীবন ও কর্মজীবনে কঠোর অধ্যবসায় ও পরিশ্রম করেই সফলতা পেয়েছেন। স্বপ্নচারী সার্থক মানুষের পেছনে ফেলে আসা বিভিন্ন অভিজ্ঞতার গল্প শোনা আমার নেশা। ছাত্রজীবনে সিনিয়রদের কাছাকাছি হতে যেমনটা ছোটাছুটি করেছি, এখনকার কর্মজীবনেও এই একই নেশা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের আনাচেকানাচে অবস্থানরত সিনিয়র, সহপাঠী ও জুনিয়র অনেকের কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টায় থাকি।
সাম্প্রতিক সময়ে ম্যাসাচুসেটস প্রদেশে ভ্রমণে যাই, সেখানে ‘রসায়ন সন্ধ্যা’ আয়োজনে আমরা মিলিত হই বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন সিনিয়র ও জুনিয়র। রওশন ভাই ও শাথি ভাবির আমন্ত্রণে তাঁদের বাড়িতে আয়োজিত এই গেট টুগেদারে লিটন ভাই, রাহিদ ভাই, মংসানো ভাই, কামরুল ভাই, লর্ড, ইভা ও লাকি সবার পরিবারসহ অন্য অতিথিদের সংস্পর্শে দারুণ এক মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে। সুস্বাদু খাবার, হাস্যরস, রসায়ন, দেশীয় রাজনীতির সুফল-কুফল, প্রফেশনাল আলোচনা সবই ছিল দারুণ উপভোগ্য। একইভাবে ছুটে চলি অন্য কোথাও-নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, পেনসিলভানিয়া, মেরিল্যান্ড। ফোন বা অন্য উপায়ে যোগাযোগের চেষ্টাও চলে।
৩.
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বসবাসকারী সুশিক্ষিত ও কর্মদক্ষ এসব ঢাবি রসায়নবিদের মধ্যে আত্মার বন্ধন গড়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। অতীতেও চেষ্টা ছিল। প্রথম আলোতে ২০২৩ সালের ২৩ জুলাইতে ‘মিলনমেলা, অন্যেরা পারে, আমরা কেন নয়’ শিরোনামে লেখায় রসায়নবিদদের একতাবদ্ধ হওয়ার দারুণ এক আকাঙ্ক্ষার বিষয়টাই সেখানে স্পষ্ট! স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, মিলনমেলা কী? অতীত জীবনের বিভিন্ন স্তরে স্মৃতিমধুর দিনগুলোতে একসঙ্গে কাটানো মানুষগুলো কিংবা একই সংস্কৃতির জনগোষ্ঠীর আত্মার টানে আবারো কোথাও মিলিত হওয়াই মিলনমেলা। আত্মার বন্ধনে একতাবদ্ধ হয়ে চলাতেই আনন্দ। চলবে...
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]