প্রবাসে পরীক্ষা যেমন
নিজের পিএইচডি যাত্রার দুই বছর পেরোতে খুব বেশি দেরি নেই। এখনো কোর্স বাকি, স্বাভাবিকভাবে কোর্সের পরীক্ষাও দিতে হয়। তবে এখানকার পরীক্ষাগুলোর স্বাদ সাধারণত ভিন্ন রকম হয়। কখনো টেক-হোম এক্সাম (প্রশ্ন দিয়ে দেয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উত্তর করে খাতা জমা দিতে হয়), কখনোবা শর্ট কুইজের মধ্য দিয়ে পরীক্ষার ইতি ঘটে—অনেকটা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসটেস্টগুলোর মতো। কিছু কোর্সের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটে, যেমন কিছুদিন আগে যে কোর্সের পরীক্ষা দিলাম—তিন ঘণ্টার ‘মিড এক্সাম-১’ হলো। এই কোর্সে এ রকম আরও দুটি তিন ঘণ্টার পরীক্ষা হবে।
নিজের পিএইচডির গবেষণার চাপে বুয়েটের মতো আগের চার-পাঁচ দিন ধরে পড়ার সুযোগ না পেলেও অন্তত পরীক্ষার আগের দিন থেকে পড়া শুরু করতে হয়েছে। প্রশ্ন কঠিন হবে জানাই ছিল, তাই অনেক দিন পর বুয়েট-বুয়েট অনুভূতি হচ্ছিল।
পরীক্ষার দিন আমি সাধারণত খাওয়ার কথা ভুলে যাই, এবারও তা–ই হলো। দুপুরবেলা খিদে পেলে মনে পড়ল কিছু খাওয়ার কথা। কোনোরকমে হাতের সামনে যা পেয়েছি, একসঙ্গে করে খেয়ে নিলাম। ঝামেলায় পড়লাম মধ্যাহ্নভোজের পর একটা মিষ্টি খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। পরীক্ষার মধ্যে নিজের নিস্তেজ মস্তিষ্কে গ্লুকোজ স্পাইক দেওয়ার এ প্রচেষ্টা আমার পুরোনো অভ্যাস।
বাসায় থাকলে কোনো চিন্তাই ছিল না; মা ভাত খাইয়ে দিত আর বাবা আগের দিন তাজা মিষ্টি এনে রাখত। এখন সেসব দিন নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে পরীক্ষা দিতে গেলেও অন্তত খাবার রেডি করা নিয়ে ভাবতে হতো না, হলের ডাইনিংয়ে খেয়ে নিতাম। এখন সে ঝামেলাও পোহাতে হচ্ছে।
তবে সৌভাগ্যক্রমে এর আগের সপ্তাহের একটা অনুষ্ঠানের মিষ্টি থেকে গেছিল, খেতে পারলাম! হোক বাসি, মিষ্টি তো!
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
মিষ্টি জোগাড় হলেও কিছু মুহূর্তের আর প্রতিস্থাপন হয় না। পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় তো বটেই, বাসা থেকে বের হলে প্রায় সব সময়ই মা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে হাত নাড়ানোর জন্য। ছোট থেকে মায়ের মুখে শুনে আসছি—একবার বের হলে আর পেছনে ফিরতে নেই। পেছনে ফিরে মাকে দেখলে, মায়ের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ালে কখনো কারও খারাপ হয়? তাই আজ অবধি এ কথা কানে তুলিনি। প্রথম এর ব্যত্যয় হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে পরীক্ষা দেওয়ার সময়। এরপর এখন।
এখন অবশ্য সে সুযোগ একেবারেই নেই।
তবে কল্পনা করতে বাধা কিসের? তাই আমি কল্পনার আয়নায় স্পষ্ট দেখি, মা বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে যতক্ষণ আমাকে দেখা যায় ততক্ষণ হাত নাড়ছে। আমি ফিরে অন্তত দুইবার, কখনো কখনো তিনবার হাত নেড়ে মোড় ঘুরে চোখের নাগালের বাইরে গিয়ে গন্তব্যের দিকে পা বাড়াই।
ভালো লাগে, সাহস পাই।
আগের মতো রিকশা খোঁজার বদলে এখন অবশ্য নিজের দুই চাকার বাহনে উঠে পড়ি। দেরি করলে চলবে না, পরীক্ষা শুরু হতে বেশি বাকি নেই।
বোধ হয় একমাত্র কল্পনাই পারে দূরত্বের বাধাকে হার মানাতে!
*লেখক: অংকন ঘোষ দস্তিদার, পিএইচডি শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় আরবানা-শ্যাম্পেইন, আমেরিকা