প্রবাসী মন
আজ রোববার। খুবই আয়েশ আর অলসতার একটা দিন আমার কাছে ...সঙ্গে কিছুটা মন খারাপেরও। যতই দিনটা গড়াতে থাকে, ততই মন বিষণ্ন হতে থাকে। আবার কাল থেকে সেই গৎবাঁধা পাঁচ দিন,
ঘড়ির কাঁটা ধরে ছুটে চলা...
দম ফেলার ফুরসত দেয় না ক্ষণ...
এমনই প্রবাস জীবন।
এ জন্য আমি রোববার সকাল থেকেই বেশ ঢিলেমি করতে থাকি..., টেনেটুনে যতটা লম্বা করা যায় দিন...
যদিও ঘুম থেকে দেরিতে উঠি। ঘুম ভাঙলেও সহজে উঠি না। উঠলেও বসি না। বসলেও নড়াচড়া করতে ইচ্ছা করে না...
কিন্তু ওই যে, এক স্মার্টফোন জুটছে কপালে, যিনি জগতের সবাইকে আনস্মার্ট বানিয়ে নিজে একাই স্মার্ট হয়ে বসে আছেন, তার ডাকাডাকি অগ্রাহ্য করে কার সাধ্য!
অগত্যা সব টেক্সট আর নোটিফিকেশনে চোখ বোলাতে হয়,
মনে মনে ভাবছি, কীভাবে স্মার্টফোনের চেয়েও স্মার্ট হওয়া যায়, এই বেটা বড় জ্বালাচ্ছে...
এমন আগডুম বাগডুম ভাবতে ভাবতেই মাইক্রোওভেনে বানানো চা বা কফির মগ নিয়ে বাগানের চেয়ারে গিয়ে বসি। কেউ পাশে এসে বসলে ভালো, না বসলে আমার বয়েই গেল...
আজ আকাশ মনমরা। যদিও বাদলের ধারা বা মেঘের গর্জন নেই; কিন্তু কিরণও লাপাত্তা। হালকা ঠান্ডা থমথমে চারপাশ,
আজ ইচ্ছা পূরণের দিন...
ইচ্ছা হলে আকাশ দেখি,
ইচ্ছা হলে পাতা...
ফুলগুলো সব রাগ করে বলে
তুমি একটা যা তা!
হুম, অনেক ফুল চারপাশে...
তাদের দিকেও একটু নজর দিতেই হয়, নয়তো করবে গোস্সা!
আজ রোববার, তিতলি কঙ্কা ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলেছে...
করুক ঝগড়া, আমি থামাচ্ছি না...
নিজেরাই থেমে যাবে নিজেদের প্রয়োজনে,
আমি বরং টম অ্যান্ড জেরিকে থামাই...
অনেক তো হলো, আর কত পিছু লেগে থাকা!
সেই বালিকা কাল থেকে তাদের ঝগড়াঝাঁটি আর পিছু লেগে থাকা দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত,
নাটোরের বনলতা সেনও নেই যে দুদণ্ড শান্তি মিলবে!
নিদেনপক্ষে জীবনানন্দ দাশ এলেও পারত,
সবাই স্বার্থপর।
কি আর করার, মাঝপথে গিয়ে দাঁড়ালাম...
ডানে টম, বায়ে জেরি...
কী.... সমস্যা কী তোমাদের?
আর কত...!!
টম বলল: কই, কিছু হয়নি তো, আমরা বেশ আছি...
জেরি বলল: টম ছাড়া আমার চলেই না...
তাহলে যে সারাক্ষণ দেখি হিংসা, প্রতিহিংসা, ঝগড়া, মারামারি, পিছু নেওয়া...
ওহ, ওসব তো আমরা দেখাই দুনিয়াকে। কারণ, তোমরা ওগুলো দেখতেই পছন্দ কর... টম বলল,
জেরি মাথা নেড়ে সায় দিল!
্যাৎতারিকা ছাই...
আমি এখান থেকে পালাই,
আমার ফুলবাগানই ভালো
যদিও শিউলি, বকুল নাই...
কি যে হাহাকার লাগে শিউলি, বকুল, চাঁপা ফুলের জন্য,
মন কেমন করে ওঠে নদীর ধার, লেকের পাড়, বকুলতলা,
ইলিশভাজা, তিলের খাঁজা, রোজার দিনের ইফতার, স্কুল শেষে চালতার আচার, ঈদের সালামি, গ্রামের বাড়িতে শীতের সকালে খেজুরের রসের সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা, মা-বাবার মুখ, ভাইবোনের খুনসুটি, টিএনটি ফোনে রাত-বিরাতে নাম না-জানা রোমিওদের ফোনকলে হুদাই মায়ের কড়া বকুনি, সেবা বা হুমায়ূন আহমেদের নতুন বই আর একঝাঁক সদা আন্তরিক, উৎসুক ভালোবাসায় ভরপুর বন্ধুবান্ধবের দন্তবিকশিত বিরামহীন হাসি...
শুধুই দীর্ঘশ্বাস...
আমরা যারা বহু বছর দেশ ছেড়ে বিদেশে, অর্থাৎ প্রবাসী বা নিবাসী, আমরা আসলে না ঘড়কা না ঘাটকা...
বাবা, মা, আত্মীয়স্বজনের কাছে আমরা এখন দুই দিনের মেহমান...
নিজেদের ছেলেমেয়েদের কাছে আমরা খাঁটি বাংলাদেশি,
আর কারও কারও কাছে আমরা কঙ্কা-তিতলি অথবা টম অ্যান্ড জেরি।
যদিও অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে এ দেশে প্রাপ্তির পাল্লা হিসাব করলে সেও বেশ ভারী, এই প্রবাস জীবন আমাদের দিয়েছে নিরাপত্তা, স্বনির্ভরতা, আত্মবিশ্বাস, স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাস, নিশ্চয়তা, এমনকি ভালোবাসার প্রাপ্তিও নেহায়েত কম নয়, এখানে অনেকের কাছেই আমরা অনেক ভাবেই ঋণী।
তবু কেন যে ছাই, মন পোড়ে...
মায়ায় হৃদয় ছটফট করে
দেশে যাওয়ার সময় যেমন উজ্জ্বলতর হয় আঁখি,
তেমনই ফেরার পথে টলমলে টইটম্বুর অশ্রুজল কোথায় যে রাখি... গড়িয়ে পরে কপোল বেয়ে...
কিছুতেই লুকাতে পারি না, লুকাতে চাইও না...
সব চাওয়া, পাওয়া আর না-পাওয়ার হিসাব ছেড়ে এমন আলস্য ভরা দিনে পেছন পানে তাকালে হৃদয়ে শুধু বাজে...
তুই ফেলে এসেছিস কারে
মন..., মন রে আমার...
তাই জনম গেল,
শান্তি পেলি না রে...
মন..., মন রে আমার!