জননীর এক পেটানোতেই আজীবনের শিক্ষা…

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পাহাড়ের কোলঘেঁষে একটা বাঁশের বেড়া আর শণের ছাউনির ঘর। ঘরের সামনে আয়তাকারের ছোট উঠানের বাঁ পাশে একটা বয়স্ক আর ডান পাশে যৌবনে ভরপুর কাঁঠালগাছ, আর সেটির একটু দূরেই ঘরের চাল ছুঁয়ে আছে লিকলিকে পেয়ারাগাছটি।

উঠানের নিচেই গ্রামের মধ্য দিয়ে চলাচলের মেঠোপথ।

বাড়ির উঠান থেকেই দেখা যায় পিচঢালা সর্পিল আকারের রাস্তাটি। মুড়ির টিনের বাস চলাচল ঘণ্টার পর পর দেখা যায়। এদিকে যাত্রী খুব কম। সন্ধ্যা ৭টা–৮টার পর কোনো গাড়ির আওয়াজ থাকে না। বেড ফোর্ড ট্রাক চলাচল করে দিনের বেলায়। বাড়ি থেকে দেখা না গেলেও একটু দূরে অল্প পানি চলার ছোট একটি খাল; বর্ষায় পাহাড়ের পানিতে ঢল বয়ে যায় বিশাল আকার হয়ে, মেশে কর্ণফুলীতে।

ঘরের চালের ওপর ঝুঁকে পড়ে আছে ওপরের ঘরের সামনের কাঁঠালগাছটির ঘনপাতার ডালপালা। ওই ঘরের পেছনে ওপরের দিকের পাহাড়ে বনবীথিতে ভরপুর। বানর, হনুমানেরা আসে লতাপাতা খেতে সময়ে সময়ে। পাখিদের কলকাকলি তো আছেই। শেয়ালরা ডেকে ওঠে সন্ধ্যা রাতে আশপাশের পাহাড়ের ঝোপঝাড় থেকে নিত্য দিন!

গ্রীষ্মের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক এত কড়া হয় যে পৌঁছে যায় সূর্যদেবের কানে।

১৫ থেকে ২০ পরিবারের গ্রামটিতে কোনো বিদ্যুৎ নেই। ভোরে উঠে প্রায় সবাই যায় জমিতে কাজ করতে কিংবা বনে গিয়ে কাঠ খুঁজতে। গ্রামের মানুষের অভাব থাকলেও ঝগড়া–বিবাদ নেই বললেই চলে। সবাই মিলেমিশে থাকত। অথচ গ্রামে শিক্ষিত লোক নেই বললেই চলে। এক বা দুই পরিবারের মতো আর্থিকভাবে সচ্ছল।

সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, রাত ৮টার আগেই সবাই ঘুমিয়ে পড়ে।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

বাবা প্যারালাইজড হয়ে যাওয়ায় মায়ের ওপর সংসারের পুরো দায়িত্ব চলে এল। বড় ভাই একটু ট্যারা টাইপের ১০-১১ বছর, কথা কম শোনে, স্কুলে যায় প্রতিদিন; ছোটটা ৪ আর আমি ৮–এর মতো। মা বাবাকে সবকিছু ঠিকঠাক করে দিয়ে চলে যান জমিতে কাজ করতে। আমার ওপর দায়িত্ব ছিল বাবাকে বাথরুম নিয়ে যাওয়া আর পাশে থাকা ছোট ভাইকে নিয়ে। দুপুরে কাজ থেকে ফিরে এসে রান্না করেন মা।

বাবা হাঁটতে পারেন না।

সকালে পেয়ারাগাছটার নিচে বসে থাকেন পিচঢালা রাস্তার দিক হয়ে।

গরমের একদিন। বাবা বসে আছেন পেয়ারার গাছতলায়; শরীরটা অনেক দুর্বল হয়ে গেছে।

মা ফিরলেন কাজ থেকে। বাড়ির একেবারে সামনের ঘরটির নারীপ্রধান, খুব কড়া, এসে অভিযোগ দিলেন মাকে, তাঁর আদরের ছোট সন্তানের পায়ে আমি আঘাত করেছি। বাবা চুপচাপ শুনছেন। তিনি শান্ত মানুষ। একে তো কড়া রোদের দুপুর, তার ওপর সংসারের কড়া তাপে অনবরত দগ্ধজন জননী আমার, মাথা কি ঠিক আর থাকে!

আমি কাঁঠালগাছের নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছি। যখন অভিযোগগুলো দিচ্ছিলেন, আমি বললাম, আমাকে খেলা করার সময় নানাভাবে বিরক্ত করছিল তাঁর ছেলে। মাথা গরম হয়ে যাওয়ায় আমি এটা করেছি। আমি এটা বারবার বলার পরও মা মোটেও আমার পক্ষ নিচ্ছেন না দেখতে পাচ্ছি। আর অনবরত অভিযোগের চাপে মাকে রাখছে অপর পক্ষ।

মা এসে আমাকে ধরে ফেললেন। বেঁধে ফেললেন একটা দড়ি দিয়ে কাঁঠালগাছটির সঙ্গে। আর পেটাতে লাগলেন বেদমভাবে কঞ্চি দিয়ে। পেটানোর সঙ্গে সঙ্গে বলছেন, আর কোনোদিন কারও সঙ্গে ঝগড়া করবি।

‘না! না!..

আর বাবা বলছেন, হয়েছে, হয়েছে, থাম এবার!

অনেকক্ষণ পর কড়া নারীপ্রধান চলে গেলেন।

সেই কড়া রোদের মধ্যে অনেকক্ষণ বেঁধে রেখে কড়া শাস্তির শিক্ষা দিলেন আমার প্রিয় জননী। (আজ থেকে ৪০ বছর আগে ঘটনাটি ঘটে!)

*লেখক: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ক্যালিফোর্নিয়া, আমেরিকা