শীত আসছে সুইডেনে, খেজুর রসের কথা মনে পড়ছে আমার
ঋতু হচ্ছে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে ভূপৃষ্ঠের কোনো একটি স্থানের জলবায়ুর ধরন। মহাকাশে সূর্যের অবস্থানের সাপেক্ষে পৃথিবীর অক্ষের অবস্থানের পরিবর্তনের কারণে কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে ঋতু পরিবর্তন হয়। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ঋতুর আবির্ভাব ঘটে এবং সেগুলো পর্যায়ক্রমে আবর্তিত হয়। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে বছরকে ছয়টি ঋতুতে বিভক্ত করা হয়েছে—গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বসন্ত, গ্রীষ্ম, হেমন্ত ও শীত—এই চার ঋতু রয়েছে। সুইডেন তার মধ্যে একটি। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর মাস মিলে যে ঋতুটি, তাকে সুইডেনে বলা হয় ‘হোস্ত’। বাংলাদেশের শরৎ ও হেমন্তের সমন্বয়ে সুইডিশ হোস্ত ঋতুটি।
বাংলাদেশের মতো শরৎকালে সুইডেনেও নীল আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়। তবে এখানে শরতের ভোরে ঘাসের ডগায় শিশির দেখা যায় আর দেখা যায় কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। শরতের শেষে রোদের তেজ আস্তে আস্তে কমতে থাকে, ঠিক তখনই হেমন্তের আবির্ভাব হয়।
সুইডিশ আবহাওয়াবিদদের মতে, তাপমাত্রা কমপক্ষে ১০ ডিগ্রির নিচে একটানা পাঁচ দিন থাকতে হবে। তবেই চমৎকার সুইডিশ হোস্ত ঋতুর স্বাদ পাওয়া যাবে, যা এখন লক্ষণীয়।
আমি সুইডেনের শরৎ ও হেমন্তের সময়টুকুকেই বাংলাদেশের শীতকাল হিসেবে উপভোগ করে আসছি।
কারণ, ছোটবেলায় বাংলাদেশে যখন শীতকাল ছিল, তখন আমি সকালে ঘাসের ডগায় যেমন শিশির জমে থাকতে দেখেছি, তেমনি দেখেছি কুয়াশাও। কয়েক দিন ধরে সুইডেনের শরতের সময়টুকু আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে ছোটবেলার দিনগুলোর স্মৃতি। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে পৌষ ও মাঘ (মধ্য ডিসেম্বর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) এ দুই মাসের কথা বেশি মনে পড়ছে।
এর পেছনে যে কারণটি জড়িত, তা হলো খেজুরের রস এবং পৌষ মাসের পিঠা। মনে পড়ে যায় ছোটবেলার স্মৃতি, যখন খুব সকালে উঠে রস আনতে গিয়েছি। পৌষ মাসের পিঠা তৈরির ধুম পড়ত প্রতিটি বাড়িতে, যা আজও মনের মধ্যে গাঁথা রয়েছে।
ছোটবেলার কিছু স্মৃতি মনে পড়ছে, তাই একটু স্মৃতিচারণা করতে ইচ্ছা জেগেছে। ছোটবেলায় দেখেছি পৌষ ও মাঘ মাসে আকাশ থাকত পরিষ্কার। তারপর কনকনে শীতে খেজুরগাছ কেটে রসের ভাঁড়ের মধ্যে চুন দিয়ে তাকে আগুনে পুড়িয়ে সেই ভাঁড় গাছে ঝুলিয়ে রাখত বিকেলে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে গাছি হাঁড়ি ভরা রস পেড়ে হয় বিক্রি করতেন বাজারে বা বাড়িতে নিয়ে লম্বা কড়াইতে (তাফাল) ঢেলে তা জ্বাল দিয়ে তৈরি করতেন গুড় বা পাটালি। কখনো ঝোল গুড়, কখনো শক্ত গুড়, আবার কখনোবা রসপাটালি, যা খেয়েছি সেই ছোটবেলায় গ্রামে। সকালে ঘুম থেকে উঠে খেজুরের রস খেয়েছি। সে তো রস নয়, যেন অমৃত! তারপর পৌষ মাসে পিঠা তৈরি করা খেজুরের রস দিয়ে, যাকে রস পিঠা বা দুধ চিতই পিঠা বলা হয়। এসব অমৃত খাবার পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না বাংলাদেশ ছাড়া।
খেজুরগাছ রাস্তাঘাট বা মাঠের মধ্যে যেখানে–সেখানে দেখেছি। কখনো সারি ধরে, কখনো এলোমেলোভাবে, আবার কখনো একাকী। হয়তো অনেকে মনে করবেন, বিদেশে বহু বছর আছি, তাই এসব কথা মনে পড়েছে? না, ছোটবেলায় খেজুরগাছ, তালগাছ, আমগাছ, জামগাছ, লিচুগাছ, বেলগাছ, কাঁঠালগাছ আরও কত গাছ এবং এসব গাছের ফল ও রস খেয়েছি।
খেয়েছি কখনো কিনে, কখনো চুরি করে, কখনোবা চেয়ে। গ্রামে জন্মগ্রহণ করার মাঝে মজা তখনই, যখন তার সমস্ত কিছু হৃদয় দিয়ে অনুভব করার সৌভাগ্য হয়। বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম ইছামতী বিলের ধারে গ্রামের বাড়ি, তারপর প্রাণপ্রিয় নবগঙ্গা নদী, সঙ্গে খেজুর গাছ ও তার রস—এ স্বাদ যারা জীবনে একবার পেয়েছে, তাদের জন্ম ধন্য হয়েছে।
বহু বছর শীতের পিঠা খাওয়া হয় না, তবে অতীতে খেয়েছি, যার স্বাদ এখনো উপলব্ধি করতে পারি।
আজ মনে পড়ে গেল একদিনের একটি ঘটনা। সকালবেলা আমার এক চাচার বাড়ি থেকে চার ভাঁড় রস আনতে বললেন মা। কাল বাড়িতে শীতের পিঠা তৈরি হবে। সকালে উঠেই চলে গেলাম চাচার বাড়ি।
গাছিরা সাধারণত রসের ভাঁড় (ঠিলা) বাঁকের দুই পাশে ঝুলিয়ে বেশ হাঁটার তালে তালে দিব্যি তা বহন করে। আমার শখ হলো চাচার মত করে হাঁটার তালে রসের ভাঁড় বাঁকের দুই পাশে ঝুলিয়ে ঘাড়ে করে বাড়িতে আসব। জীবনে এর আগে বাঁকে ঝুলিয়ে ঘাড়ে করে এভাবে কিছু বহন করিনি, তবে দেখেছি।
চাচা বারবার বলতে লাগল, ‘বাবা তুমি কি পারবে এভাবে নিতে? বরং চলো আমি বাঁকে ঝুলিয়ে ঘাড়ে করে তোমাদের বাড়িতে দিয়ে আসি।’ আমি বললাম, ‘না চাচা, অসুবিধা নেই, আমি পারব।’
‘বিসমিল্লাহ’ বলে রসের ঠেলাসহ বাঁক ঘাড়ে তুললাম এবং ডান হাতটি বাঁকের সামনের দিকে রেখে দু–চার পা হাঁটতেই প্রথমে পেছনের দুটো ঠিলা পড়ে গেল। মুহূর্তেই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে সামনের দুটো ঠিলা। ফ্যালফ্যাল করে চাচার দিকে তাকাতে চাচা বলল, ‘অসুবিধে নেই, রস আরও আছে। চলো, আমি এবার নিয়ে বাঁকে করে রস তোমাদের বাড়িতে নিয়ে যাই।’
চাচা বুঝতে পেরেছিল, সেদিন আমি খুবই লজ্জিত হয়েছিলাম। ভুলিনি সেদিনের সেই কথা। পরে মাঝেমধ্যে চর্চা করেছি বাঁক ঘাড়ে করে হাঁটুপানির মধ্য দিয়ে হাঁটতে, বাঁকের থেকে ঠিলা পড়েছে, তবে ঠিলা ভাঙেনি। গাছে উঠে খেজুরগাছ কাটা এবং গাছে ভাঁড় বেঁধে ভাঁড়ভরা রস এনে তা দিয়ে গুড় ও পাটালি তৈরি করা, শহরের প্রিয় বন্ধু বা বান্ধবীকে পৌষ মাসের পিঠা খেতে নিমন্ত্রণ করা—সেসব সে কী আনন্দের! ভাবতেই গা শিউরে উঠছে। এসব ছিল ছোটবেলার মধুর ঘটনা, যা আজ শুধু স্মৃতি হয়ে হৃদয়ে ফুলের মালার মতো গাঁথা রয়েছে।
এত মধুময় স্মৃতি জড়িত খেজুরের রসের সঙ্গে, অথচ শুনেছি, যশোরের খেজুরের রস বিলীন হওয়ার পথে। প্রথমত, খেজুরের গাছ কেটে ফেলে ধানি জমির পরিমাণ বাড়ানো, অবশিষ্ট যেসব গাছ আছে, তা–ও গাছির অভাব, তার ওপর শীত খুব বেশি না, এদিকে আকাশ মেঘলা—এসব কারণে খেজুরের রস পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এসব শোনার পর মনটা খারাপ হয়ে গেল। গাছি ও গাছের অভাবে রস বিলীন হওয়ার পথে! এমন একটি সুন্দর কাজ কেউ করতে ইচ্ছুক নয় শুনে মনটা সত্যি খারাপ হয়েছে।
ভাবছি, আমাদের নিজেদেরই তো অনেক জমি রয়েছে দেশে, সেখানে তো আর কিছু না হোক খেজুরগাছ অগত্যা লাগাতে পারি। কিছু না হলেও খেজুরের রস ও যশোরের ঐতিহ্য ধরে রাখা যাবে।
খেজুর গাছ ছয়–সাত বছর বয়স থেকে রস দেওয়া শুরু করে। ২৫ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত রস দেয়। গাছ পুরোনো হয়ে গেলে রস কমে যায়। আবার অনেক পুরোনো খেজুরগাছের রস অনেক মিষ্টি হয়। তবে মাঝবয়সী গাছ থেকে সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়।
যতটুকু মনে পড়ে কার্তিক মাস থেকেই রস পাওয়া যায়। রসের ধারা চলতে থাকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। শীতের সঙ্গে রস ঝরার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। শীত যত বেশি পড়ে, ততই যেন বেশি রস ঝরে। রসের স্বাদও তত মিষ্টি হয়।
অনেক সময় দেখা গেছে, কুয়াশার কারণে খেজুরের রস ঘোলাটে হয়েছে। ঘোলা হওয়ার কারণে সেই রস দিয়ে পিঠা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। রসের রং ঘোলাটে হওয়ার কারণে খেতেও তেমন মজা লাগত না, বিরক্তিকর টক টক স্বাদ। যখন আকাশ পরিষ্কার থেকেছে, শীতও পড়েছে প্রচণ্ড, তখন ভোরে গাছি যদি রস পাড়তেন, সেই রস দেখতে ফিল্টার করা পানির মতো পরিষ্কার ঝকঝকে মনে হতো। সে রস কী যে অমৃত আর সুস্বাদু ছিল, ভাবতেই জিব দিয়ে পানি পড়ে আজও।
শীতকালীন গ্রামবাংলায় খেজুর রসের সুস্বাদু পিঠা উৎসব অনুষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি ঘরে ঘরেও জামাই–মেয়েদের নিয়েই যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক দৃঢ় করা হয়। গ্রামের মা-বোন, মেয়ে–বউ, নানি–দাদি বা ঝিয়েরা কনকনে শীতে গীত গেয়ে খেজুরের রস বা গুড় তৈরি করেন। আবার মেয়েজামাইকে কাছে পেয়ে শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল, বিকেল বা সন্ধ্যার মনোরম পরিবেশ উপভোগের পাশাপাশি পিঠা তৈরি করে।
এ যেন একটি চমৎকার দৃশ্যপট, যাকে শৈল্পিক উপাখ্যান বললেও ভুল হবে না। এবার বলি চিতই পিঠা সম্পর্কে। খেজুরের রসের মধ্যে পরিমাণমতো তেজপাতা, দারুচিনি ও এলাচ দিয়ে সেটি ভালো করে জ্বালানো হতো। অতঃপর তার সঙ্গে জ্বাল দেওয়া দুধ মিশিয়ে আবারও কিছুটা জ্বাল দিয়ে উত্তম মিশ্রণ তৈরি করা হতো। আতপ চাল ঢেঁকিতে গুঁড়া করে সেই চালের গুঁড়া দিয়ে গোলা বানিয়ে মাটির ছাঁচের সাহায্যে তৈরি করা হত পিঠা।
শীতের সকালে ‘রস বা পাটালি গুড়’ তৈরিতে জ্বালানির পাশে বসে বা মোটা লেপ মুড়ি দিয়ে চিড়া, মুড়ির মোয়া খাওয়ার নান্দনিক পরিবেশটা যেন গ্রামাঞ্চলের মানুষের সনাতনী ইতিহাস ঐতিহ্য।
শীত তার বিচিত্র রূপবৈচিত্র্য ও রস নিয়ে হাজির হয় গ্রামবাংলায়। নবান্ন উৎসব কিংবা শীতের পিঠা পায়েস তৈরির ‘উৎসবটা’ শীতেই হয়। শীতের চিরায়ত যা কিছু সৃষ্টি কিংবা নিয়ামত, তা উপলব্ধি করতে চাইলে অবশ্য গ্রামে যেতে হবে। আজও গ্রামাঞ্চলে শীতকালীন উৎসবের পাশাপাশি কোনো কোনো ক্ষেত্রে নীরবতার অস্তিত্বও বড়ই আনন্দদায়ক। বাংলাদেশের ‘গ্রাম’ সৌন্দর্যমণ্ডিত ষড়্ঋতুর ছোঁয়ায় শীতকাল এক ঐতিহ্য হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে এই খেজুরগাছ।
জানি না এমনটি অনুভূতি কি আজও আছে গ্রামবাংলায়? এখনো কি সকাল হলে নির্ভেজাল খেজুরের রস, গরুর খাঁটি দুধ এবং আতপ চালের ভেজালমুক্ত চালের গুঁড়া পাওয়া যায়? বড় সাধ জাগে একবার ফিরে যাই সেই বাংলার কোলে, যেখানে কেটেছে আমার মধুময় শিশুকাল।
শরৎ প্রতিবছরই সুইডেনে ফিরে আসে, তবে শীতের সেই দুধ চিতই পিঠা ফিরে আসেনি একবারও।
ছোটবেলার অনেক স্মৃতিই মাঝেমধ্যে হৃদয়ের মাঝে এসে বেশ জ্বালা দিয়ে যায়। মাকে পাব না। খেজুর রস, সেই দুধ চিতই পিঠা তা–ও হয়তো পাব না। হে বাংলাদেশ, হয়তো কিছুই নাহি পাবো, তবু তোমায় আমি দূর হতে ভালোবেসে যাব।